ইনসাইড থট

'অধিকার' সম্পাদকের দন্ডে মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতি কতটুকু যৌক্তিক?


প্রকাশ: 16/09/2023


Thumbnail

মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার' সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্র এবং সংগঠনটির পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সমাবেশ শেষে শর্তানুযায়ী সমাবেশস্থল ত্যাগ না করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা এবং নির্বাচিত সরকার কে উৎখাত ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচালিত অভিযানে হেফাজত কর্মীদের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে আদিলুর ও এলানের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে করা মামলায় এই সাজা পান তারা। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পরে সকল আইনি প্রক্রিয়া শেষে গত ১৪ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত এ রায় ঘোষণা করেন। আদালত প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিচারক এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।

অথচ মামলার রায়ের পরপরই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস! ১৪ সেপ্টেম্বর দূতাবাসের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতির মাধ্যমে এই উদ্বেগের কথা প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র মানুষের অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষায় মানবাধিকারকর্মী এবং সুশীল সমাজ সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। আমাদের ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্ট অন হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনে ‘অনলাইন এবং অফলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা’ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো ‘বিশেষ সরকারি বিধিনিষেধের সাথে পরিচালিত’ হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এ অবস্থায় ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস মানবাধিকার সংগঠন অধিকার’-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে আজকের রায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং মনে করছে এটি মানবাধিকারকর্মী এবং সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালনের সদিচ্ছাকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, অধিকার কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে এবং প্রতিবেদন তৈরি করেছে। গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ হিসেবে আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করি এবং মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করি।

এর আগে রায় প্রকাশের পর বিবৃতি দিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও। আদিলুরের রায় নিয়ে অ্যামনেস্টির বিবৃতিতে বলা হয়- অধিকার ২০১৩ সালে প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নথিভুক্ত একটি তথ্য-অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করার পরে মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। অধিকার এবং এর নেতাদের ওপর রাষ্ট্রের নিরলস দমন ক্ষমতার কাছে সত্য বলার অধিকারের ওপর একটি আক্রমণ।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের নথিভুক্ত করা কোনো অপরাধ নয়। আমরা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে খান ও এলানকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এ ধরণের বিবৃতি একটি স্বাধীন দেশের বিচার ব্যবস্থার উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ নয় কি? একটি স্বাধীন দেশের বিচার ব্যবস্থা কি বিদেশী দূতাবাসের প্রেসক্রিপশনে চলবে? কার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হবে আর কার বিরুদ্ধে হবে না তা কি আমেরিকান দূতাবাস, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং নোবেল বিজয়ীরা ঠিক করে দিবে? দেশের প্রচলিত আইনেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং অপরাধী এবং তাদের নিযুক্ত আইনজীবীদের উপস্থিতিতে আদালত মামলার রায় ঘোষণা করেছে। আদালত প্রাঙ্গণে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের পর্যবেক্ষকগণ আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছেন। পর্যবেক্ষণে আদালতে কার্যক্রম নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে কিংবা আদালতের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের কোনো অভিযোগ থাকলে তারা সে বিষয়ে বিবৃতি দিতে পারতেন। কিন্তু তাদের বিবৃতি আসলে সরকারের বিরুদ্ধে। মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা কি আইনের উর্ধ্বে? নোবেল বিজয়ীরা কি আইনের উর্ধ্বে? কিছুদিন পূর্বে আমরা নোবেল বিজয়ী ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুসের বিরুদ্ধে আদালতে চলমান একটি মামলা স্থগিত করার আহবান জানাতে দেখেছি বেশ কিছু নোবেল জয়ী সহ আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তিকে।

কোনো দেশের আইনেই কি অপরাধীদের এ ধরণের দায়মুক্তি দেওয়ার সুযোগ আছে? সরকার কিংবা আদালতের কাছে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে অপরাধ, অপরাধী নয়। একই অপরাধে একজনের বিচার হলে অন্যজনের কেন নয়? এক্ষেত্রে অপরাধীর পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা আন্তর্জাতিক অবস্থান বিবেচনায় নেওয়ার কোনো নজির কি যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য কোনো দেশের আদালতের আছে কি? আমরা কিছুদিন পূর্বেই দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কে একটি মামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিভাবে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে? তখন কি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়নি? তখন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কোথায় ছিল? তারা কি কোনো বিবৃতি দিয়েছিল ট্রাম্পের পক্ষে? মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কে কি দায়ী করা হয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের তখন কি ভূমিকা ছিল? এই প্রশ্ন কি আমরা করতে পারি তাদের কাছে? 

মার্কিন দূতাবাস মানবাধিকার সংগঠনের দুই নেতার আদালত কর্তৃক দন্ডপ্রাপ্ত হওয়ার ঘটনাকে মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, যা অত্যন্ত সাংঘাতিক অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর অভিযোগ তো আরো মারাত্মক! তারা এই দন্ডকে 

'অধিকার' এবং এর নেতাদের ওপর রাষ্ট্রের নিরলস দমন হিসেবে এবং সত্য বলার অধিকারের ওপর আক্রমণ হিসেবে দাবি করেছে, যা সম্পূর্ণ মনগড়া এবং ভিত্তিহীন। এই মামলা পর্যালোচনা করলে বিষযটি স্পষ্ট হবে।

চার্জশিটের তথ্য মতে, ২০১৩ সালে ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলাম সমাবেশ করে। শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষে শর্ত ভঙ্গ করে সমাবেশস্থলে রাত্রিযাপনের ঘোষণা দেন সংগঠনের নেতারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে বারবার সমাবেশস্থল ত্যাগ করার আহবান জানানো হয়। কিন্তু তারা সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে সেখানেই অবস্থান নেন। রাতে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিতে যৌথ অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই অভিযানে ৬১ জন নিহত হয়েছেন-মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে ‘অধিকার’। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদন কে অসত্য এবং ভিত্তিহীন বলে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং সত্যতা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয় মানবাধিকার সংগঠনটির প্রতি। তবে তারা তাদের দাবির পক্ষে উপযুক্ত তথ্য, প্রমাণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। 

অবশেষে ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন ডিবির তৎকালীন উপ-পরিদর্শক আশরাফুল ইসলাম। তদন্ত শেষে ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার আদালতে আদিলুর ও এলানের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। চার্জশিটে সাক্ষী রাখা হয় ৩২ জনকে। ওই বছর ১১ সেপ্টেম্বর মামলাটি বিচারের জন্য অভিযোগ আমলে নেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। ২০১৪ সালে দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। চার্জশিটে বলা হয়, আসামি আদিলুর ও এলান ৬১ জনের নিহত হওয়ার ‘বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা’ তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচার করে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা চালায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে চরমভাবে ক্ষুন্ন করে।’ পাশাপাশি তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি করে, যা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ও (২) ধারায় অপরাধ। একইভাবে ওই আসামিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে আইনশ্ঙ্খৃলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা চালায় এবং সরকারকে অন্য রাষ্ট্রের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালায়। 

বিবৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে মামলার অভিযোগপত্র কি তারা আমলে নিয়েছেন? অপরাধ কে কি তারা বিবেচনায় নিয়েছেন? মার্কিন দূতাবাস, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং নোবেল বিজয়ীদের এই বিবৃতি সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নগ্ন হস্তক্ষেপ এবং সরাসরি বাধা হিসেবে মনে করি। একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এ ধরণের বিবৃতির তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং ভবিষ্যতে এ ধরণের বিবৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনের খুঁটিনাটি দিকগুলো বিবেচনায় নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। 

 

মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, খুলনা মহানগর।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭