সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্টারসেপ্টের অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের গোপন এক চুক্তির তথ্য ফাঁস হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন ঐ চুক্তিতে বলা হয়েছিল, যদি পাকিস্তান ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেয়, বিনিময়ে পাকিস্তানকে আইএমএফের ঋণ পেতে সহায়তা করবে যুক্তরাষ্ট্র।
ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের মধ্যে হওয়া এই গোপন অস্ত্র চুক্তি সম্পর্কে জানে, এমন দুটি সূত্র ইন্টারসেপ্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। একই সঙ্গে এই অস্ত্র চুক্তি নিয়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একাধিক গোপন নথি থেকেও বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কথা জানিয়েছে ইন্টারসেপ্ট।
এদিকে পাকিস্তানের এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিনিময় চুক্তি প্রকাশ পাওয়াতে দেশটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। আইএমএফ এর ঋণের বিনিময়ে ইউক্রেনে অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ দিয়ে দেশটি প্রমাণ করে দিল, অর্থের বিনিময়ে বন্ধুর পিঠে ছোরা ধরতেও বিন্দু পরিমাণ কুণ্ঠিত হবে না দেশটি।
এই কিছুদিন আগেও পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিতে চেয়েছিল রাশিয়া। পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পাকিস্তানের সক্ষমতার উন্নয়ন ঘটাবে রাশিয়া। এ জন্য ইসলামাবাদকে বিশেষ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করবে মস্কো। অথচ, পাকিস্তান রাশিয়ার পিঠপিছেই চলমান রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনে অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ করার বিনিময় চুক্তি সাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে, যেটি বর্তমানে সামনে এল।
ইন্টারসেপ্ট বলছে, তিন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি আছে পাকিস্তানের। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংকটে ভুগছে ইউক্রেন। ঠিক এমন সময়েই জানা যাচ্ছে দেশটি পাকিস্তানের কামানের গোলা ও অন্য সামরিক সরঞ্জাম পেয়েছে।
গোপন নথির বরাতে ইন্টারসেপ্ট বলছে, গত বছরের গ্রীষ্ম থেকে এ বছরের বসন্ত পর্যন্ত সময়ে অস্ত্র দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয়। এ ছাড়া এসব নথিতে ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার বিনিময়ে পাকিস্তান কত অর্থ পাবে, লাইসেন্স, দুই দেশের কর্মকর্তাদের আলোচনাসহ বিস্তারিত সব রয়েছে।
ইন্টারসেপ্ট বলছে, মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখেছে তারা। ওই জেনারেল আগে সরকারি যেসব নথিতে স্বাক্ষর করেছেন, তার সঙ্গে গোপন এই নথিতে করা স্বাক্ষরের হুবহু মিল পাওয়া গেছে।
এই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার পরে এ বছরের শুরুর দিকে হঠাৎ করেই পাকিস্তানকে ঋণ দিতে রাজি হয় আইএমএফ। ইন্টারসেপ্ট দাবি করছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন অস্ত্র চুক্তি করার পরপরই পাকিস্তানের জন্য আইএমএফের ঋণের দরজা খুলে যায়। ওই অস্ত্র চুক্তিই পাকিস্তানকে এ ঋণ পেতে সাহায্য করেছে।
তবে আন্তর্জাতিক মহলে পাকিস্তানের এমন স্বার্থান্বেষী চুক্তি দেশটির বিশ্বাসঘাতকতারই প্রমাণ দেয়। রাশিয়ার সাথে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনে অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ করার এই গোপন চুক্তির প্রকাশই বলে দেয় দেশটিকে কোনোক্রমেই বিশ্বাস করা যায় না।
পাকিস্তানের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ যখন ৪৬০ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল তখন এই রাশিয়াই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। তেল ও জ্বালানী পাকিস্তানের আমদানির বৃহত্তম অংশ। রিজার্ভ কমে যাওয়ায় পণ্য আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছিল দেশটি। তখন রাশিয়া পরিশোধিত তেল ও পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য সরবরাহে পাকিস্তানের সঙ্গে নীতিগত সমঝোতায় পৌঁছায়। দুই পক্ষ এ বিষয়ে সম্মত হয় যে দুই দেশ তাদের নিজস্ব মুদ্রায় এর মূল্য পরিশোধ করবে।
যদিও পাকিস্তান রাশিয়ার জ্বালানী তেলের বৃহৎ আমদানিকারক না। পাকিস্তানের বেশিরভাগ জ্বালানী তেলই সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসে। তবুও পাকিস্তান প্রতিবছর যে ৭ কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ক্রয় করে এর ৩৫% রাশিয়া থেকে আমদানি করবে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছায় কারণ রাশিয়া পাকিস্তানকে তার অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থকে বের করে আনতে চেয়েছিল।
কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিশ্চয়তায় পাকিস্তান গোপনে যে ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে আইএমএফ থেকে ঋণ পেল এতে পাকিস্তান যে শুধু স্বার্থন্বেষী বিশ্বাসঘাতক নয় একটি একটি অকৃতজ্ঞ রাষ্ট্রও বটে তারই প্রমাণ দিল।
যদিও বাইরের কোনো চাপে পাকিস্তানকে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে আইএমএফ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমএফের এক মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানকে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে চাপ তৈরির যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা পুরোপুরি মিথ্যা।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন চুক্তির আওতায় ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেওয়ার বিনিময়ে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কিছু বলছে না পাকিস্তানও। ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের এক মুখপাত্রের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।