ইনসাইড থট

দেশের অর্থনীতি কীভাবে চাঙ্গা হবে!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 16/03/2018


Thumbnail

নিজের আশে পাশের মানুষের হাসি মুখ দেখতে পছন্দ করেন না, এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম এই দুনিয়ায়। নিজের পরিবারের আর আশেপাশের মানুষের হাসিমুখ দেখার জন্যই মনে হয় আমাদের তাবৎ কর্মকাণ্ড। আমরা পত্রিকায় নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে যে তার সমাধান চায়, তাও কষ্টে থাকা মানুষের হাসিমুখ দেখার জন্য। মানুষের এই হাসিমুখ দেখার জন্য লাগে সুস্বাস্থ্য, সুশিক্ষা, সীমিত চাহিদা, নূন্যতম আর্থিক সচ্ছলতা, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে আর্থিক সচ্ছলতার ব্যাপারটি খুব জরুরী, আমরা ‘অর্থের জন্য না বাঁচলেও’ আমাদের বেঁচে থাকতে নূন্যতম অর্থ লাগেই লাগে। আর এই অর্থ আসে সম্পদের বিনিময়ে। সে কারণে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের আর দেশের মানুষের কী পরিমাণ সম্পদ আছে তার হিসেব করার চেষ্টা করা যেতে পারে। তবে সবার আগে দরকার আমাদের দেশের সম্পদের চিহ্নিতকরণ। আমাদের চারপাশে যা দেখি তার কোনটা সম্পদ আর কোনটা সম্পদ নয় তা আস্তে আস্তে বুঝে নেওয়া জরুরী। আসুন মোটা দাগে দেখে নিই আমাদের দেশে অব্যবহৃত কিন্তু চিহ্নিত প্রধান প্রধান সম্পদগুলো কী কী।

উন্নয়নকর্মী হিসেবে প্রায় তিন দশকের কাজ আমাকে একটু একটু করে যা শিখিয়েছে তাতে আমি আমাদের চারপাশে দেখি অব্যবহৃত বিপুল সম্পদের ছড়াছড়ি। কিন্তু অব্যবহৃত সব সম্পদের ব্যবহার করার সামর্থ্য এখনো আমাদের হয়নি। জাপান আমাদের দেশের সম্পদের উপর একটা সমীক্ষা চালায় কয়েক বছর আগে। তা হোটেল শেরাটন নামে পরিচিত হোটেলের বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিনিধিদের সামনে প্রকাশ করা হয়। আমেরিকারও এমন একটা জরিপ করার কথা জানা যায়। জাপান সরকার পরিচালিত জরীপে আমাদের অনেক অব্যবহৃত সম্পদের তালিকা প্রকাশ করে। সেটা অনেক দীর্ঘ। তবে আমাদের দেশের অব্যবহৃত সম্পদের তালিকার শীর্ষে আছে মানব সম্পদ, পানি, বালি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা আমার’ আসলেই সোনায় মোড়া। আমাদের দেশের কত কিছু যে অব্যবহৃত হয়ে পোড়ে আছে তা বুঝতে পারলে, চিনতে পারলে আমার আপনার আয়ু বেড়ে যাবে। হবে দুশ্চিন্তাহীন জীবন। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আর ভাবনা থাকবে না। মাত্র কয়েক বছর আগেও কি আমরা জানতাম যে, বাংলাদেশ রেলওয়ের বা বিদ্যুৎ বিভাগের পড়ে থাকা অপটিক্যাল ফাইবার দিয়ে রাতারাতি মোবাইল টেলিফোনের এমন নেটওয়ার্ক তৈরি করা যায়! টেলিনর গ্রামীণ ফোন নিয়ে না আসলে আমাদের কাছে এই সম্পদের কথা অজানা থেকে যেত আর কতদিন তা কে জানে! আজ আমি তাই আমাদের দেশের অন্যতম সমস্যা আর সীমাহীন সম্ভাবনার ডেমোগ্রাফিক রিসোর্স বা জনসংখ্যা সম্পদ নিয়ে দুই একটি কথা বলতে ইচ্ছুক।

জাপানী ওই সমীক্ষায় উঠে এসেছিল যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান যে হার তা দিয়েই এই দেশ আগামী ৪০ বছর জনসংখ্যা সম্পদে সম্পদশালী থাকবে যদি সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে এই বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তিকে আধা-দক্ষ জনশক্তিতেও রূপান্তর করা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে বাংলাদেশের মোট প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ কর্মক্ষম। এছাড়া আমাদের দেশের জনসংখ্যাবৃদ্ধির যে হার (২.৪ এর কাছে) তাতে আগামী চার দশক ধরে এই বাংলায় কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা কমবে না বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। আমেরিকা বাদে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এমনকি জাপানসহ এশিয়ার কিছু দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক বা মাইনাস। ফলে অনেক দেশেই কর্মক্ষম লোকের অভাব হচ্ছে, আরও হবে। সব কলকারখানা কম্পিউটারাইজড হলেও কিছু লোক লাগবে যারা কম্পিউটারাইজড মেশিন চালাবেন। বাংলাদেশ সেই লোক সরবরাহের অন্যতম দেশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

বর্তমানে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত বা দক্ষ জনবল মাত্র ১৪ ভাগ। আর সার্বিক ভাবে দক্ষ জনশক্তি মাত্র ৩৮ ভাগ। তাও স্নাতক পরবর্তী সব শিক্ষার্থীর পরিসংখ্যান ধরে। যা উন্নত বিশ্বে শতকরা ৬০ ভাগ। কয়েকদিন আগে রাজধানী ঢাকায় দুই দিনব্যাপী দক্ষতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এমন তথ্য উঠে এসেছে বলে খবরে জানা গেছে। তবে আগামী দুই বছরের মধ্যে শুধু কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়াতে চায় সরকার, সেই লক্ষ্যে কাজ করছে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে।

কারিগরি শিক্ষা বাদেও অন্যান্য ক্ষেত্রেও আমাদের দেশের শিক্ষায় বাণিজ্য এসে জেঁকে বসো ওঠে কঠিন থেকে কঠিনতর। মাস্টার্সে একজন ৩.৮ সিজিপিএ (৪.০এর মধ্যে) পাওয়া বা এমবিএ করা ছেলে বা মেয়েকে চাকরী দিলেও ৫ লাইনের একটা বিজনেস লেটার লিখতে পারে না, যদিও তাঁরা খুব মেধাবী। আসলে কারিকুলামের দীনতা আর বাস্তব জ্ঞানের অভাব তাঁদের আধা-দক্ষ জনশক্তিও তৈরি করতে পারছে না।

একটা উদাহরণ দিলে মনে হয় বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার হতে পারে। আমাদের দেশে গাজীপুরের শালনায় আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা দানে এই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন ধরণের কাজ করা হয় ছাত্রদের দিয়ে। (১) অ্যাকাডেমিক বা লেখাপড়া (২) গবেষণা (৩) আউটরিচ কর্মসূচী। আউটরিচ কর্মসূচীর আওতায় লেখাপড়া যা শেখানো হয় আর গবেষণায় নতুন যা পাওয়া যায় তা গ্রামের আদর্শ চাষিদের সাথে শেয়ার করার মাধ্যমে উভয় পক্ষের জ্ঞান আদান প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া নেওয়া হয়। ফলে সদ্য পাশ করা একজন ছাত্র/ ছাত্রী তার ক্ষত্রের যে কোন নতুন চাকরীতে ঢুকেই পুরোদমে তার কাজ করতে পারে। সিএ ফার্মের গঠিত ইনস্টিউটের মাধ্যমে যারা সিএ পড়ে তারাও কিন্তু তাদের নিজেকে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে পারে। কিন্তু অন্যদের অনেকেই পারে না। এমনকি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতরাও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাবে কাজ করতে পারে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আর বেশী ব্যবহারিক ভিত্তিক (মানে হাতে কলমে শিক্ষাদান) করতে পারলে এই সমস্যার দ্রুত সমাধান পাওয়া সম্ভব। শিক্ষার সব ক্ষেত্রেই এটা সম্ভব, উন্নত দেশে এটা করেই তাঁরা উন্নত হয়েছেন।

এবার আসি কারিকুলামের কথায়। আইটির এই যুগে আমরা আমরা বিশ্বগ্রামের (গ্লোবাল ভিলেজ) সদস্য। তাই সারা দুনিয়ায় কে কীভাবে লেখাপড়া করছে তা আমাদের জানতে হবে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে। বিশ্বের কোথায় বা কোন দেশে কীভাবে বা কী কারিকুলামে লেখাপড়া হয় তা আমাদের জানতে হবে। কারণ আমাদের টার্গেট ঐ দেশে ডিগ্রী ষ্ট্যাণ্ডার্ডের বা তার নীচের যোগ্যতায় আমাদের দেশের জনশক্তি রপ্তানি করা। সেই হিসেবে তাঁদের তুল্য করে আমাদের দেশের শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম করতে হবে ডিগ্রী বা সেই ষ্ট্যাণ্ডার্ডে। ডিগ্রী ষ্ট্যাণ্ডার্ডের কারিকুলামের সাথে যাতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সেই মতো করতে হবে হাইস্কুল বা ইন্টারমিডিয়েটের শিক্ষা কারিকুলাম। একইভাবে হবে প্রাথমিক শিক্ষার কারিকুলাম, প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষার কারিকুলাম। বাঙ্গালী শংকর জাতি তাই এঁরা মেধাবী। ইউরোপ, আমেরিকা বা এশিয়ার অন্যান্য দেশের ছেলে মেয়েরা পারলে আমাদের ছেলে মেয়েরা পারবে না কেন? পারবে, আমাদের যে পারতেই হবে।

দক্ষ আর আধা দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করেই আমরা আমাদের এই দেশটাকে নিতে পারি এক অনন্য উচ্চতায়। এমনিতেই জনশক্তি রপ্তানি থেকে আমাদের দেশে বৈদেশিক মূদ্রার আয় সবচেয়ে বেশী। দরকার শুধু নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আর প্রায়োগিক ক্ষেত্রে পেশাগত নৈতিকতার সাথে শিক্ষা দেওয়া বা বাণিজ্য করা। পরিবার, প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে উন্নত নৈতিকতার পরিচয় দেওয়া। এটা করা গেলে দেশের অর্থনীতি শুধু এগুবে না, ‘দৌড়ুবে’ মানে চরমভাবে চাঙ্গা হবে। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে আর উন্নত হতে সময় লাগবে না, কারণ আমাদের এই সোনার দেশ অপার সম্পদে ভরা। আরেকদিন আরেক সম্পদ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো, যদি সুযোগ আসে।

উন্নয়ন কর্মী ও কলামিস্ট



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭