ইনসাইড বাংলাদেশ

আগামী নির্বাচনে জামায়াতের ভূমিকা ভারতের জন্য কী বার্তা দেয়?


প্রকাশ: 23/09/2023


Thumbnail

চলতি বছরের ১৪ আগস্ট কারাবাসে মৃত্যুবরণ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছিলেন তিনি।

এক দশক আগে বাংলাদেশের স্থানীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছিল। এই রায় ঘোষণার পর দেশজুড়ে সহিংস বিক্ষোভে শতাধিক মানুষ মারা যায়। বিবিসি জানায়, নিরাপত্তা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছিল। কোন কোন জেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে তা তারা অনুমান করতে পারেনি।

এক বছর পর বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তার মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে।

সাঈদী বেঁচে থাকার সময় জামায়াতে ইসলামী শক্তি দেখিয়েছে। তবে, গত মাসে তার প্রয়াণ ঘটে অনেকটা নিঃশব্দে। সরকার ঢাকায় তার জানাজার অনুমতি দেয়নি এবং জামায়াতের নেতৃত্ব কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল, যা ৮৩ বছর বয়সী নেতার শেষ নিশ্বাস ত্যাগে হাসপাতালে জড়ো হওয়া ব্যক্তিদের ক্ষুব্ধ করেছিল।

প্রতিবাদে, তারা নেতার মৃতদেহ দাফন করার জন্য তার গ্রামে নিয়ে যাওয়া গাড়ির একটি টায়ার পাংচার করে দেয়। তবে পরিস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করা হয়েছিল। এটা স্পষ্ট যে, জামায়াতের বিদ্যমান নেতৃত্ব রাজধানীতে সাঈদীর জানাজা আয়োজন করে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে চায়নি।

নেতার মৃত্যুতে মৃদু প্রতিক্রিয়া তৃণমূল পর্যায়ের সমর্থকদের কাছে জামায়াতের নেতৃত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। কারণ সাঈদী ছিলেন সংগঠনের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় নেতা।

তদুপরি, দলটি তার রেজিমেন্টেড প্রকৃতির জন্য পরিচিত। জামায়াত একটি ইসলামি দল। এটির একটি তিন-স্তরের সদস্যপদ প্রক্রিয়া রয়েছে এবং এখন পর্যন্ত ভিন্নমত শুধু দলীয় ফোরামেই প্রকাশ করা হতো।

যা হোক, সাঈদীর মৃত্যুতে জামায়াত নেতৃত্বের এই নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়া আশ্চর্যজনক। কারণ সাঈদী একজন ইসলামি ধর্মপ্রচারক-রাজনীতিবিদ। ১৯৭১ সালে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও সারা দেশে নেতাকর্মীদের মধ্যে তিনি বেশ প্রশংসা অর্জন করেছিলেন।

সাঈদীর বিচার শুরুর পেছনে জনমত গঠনে বড় ভূমিকা ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের। সেই ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে এবং এর জন্য তাদেরকে ছাত্রলীগ থেকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে।

জামায়াতকে বাংলাদেশে একটি শক্তি হিসেবে গণনা করা হচ্ছে এবং দিন দিন দলটি আরও শক্তিশালী হচ্ছে, যা ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত।

এটা সত্য যে, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দলটি এখনো শেষ হয়ে যায়নি। দলটির ২৩ হাজারের বেশি কর্মী মামলার সম্মুখীন এবং দলের বর্তমান শীর্ষ নেতাসহ অন্তত ৯০ হাজার কর্মী কারাগারে। বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে দলটি। জামায়াতে ইসলামী এই মুহূর্তে রাজপথে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো অবস্থানে নেই।

চলতি বছরের জুনে রাজধানী ঢাকায় জামায়াতকে একটি জনসভা করার অনুমতি দেওয়া হয়। এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে এটি ছিল দলটির প্রথম কোনো সমাবেশ। যে বিরল উদারতায় জামায়াতকে জনসভার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সে উদারতার আর পুনরাবৃত্তি করেনি সরকার। সেই সমাবেশের দুদিন পর বেনামী গোয়েন্দা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে স্থানীয় একটি সংবাদপত্র জানায়, দেশে এই মুহূর্তে জামায়াতের প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

এই সংখ্যাটি অত্যন্ত অতিরঞ্জিত বলেই মনে হয়, কারণ দলটিকে দীর্ঘদিন কোনো মুক্ত রাজনৈতিক কার্যকলাপ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশের হাইকোর্ট। সেখানে বলা হয়েছে, দলটির মূলনীতি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।

প্রভাব পড়ছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়:

বাংলাদেশে যে কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা থেকে কার্যকরভাবে বিরত রাখা হয়েছে জামায়াতকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার দায়ে দলটির প্রায় সকল প্রধান নেতার হয় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে অথবা তারা কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছেন।

আন্ডারগ্রাউন্ডে নিক্ষিপ্ত এবং গণমাধ্যমের ওপর সরকারের বিভিন্ন ধরনের চাপে, জামায়াতের কর্মসূচির খবর জাতীয় পত্রিকায় আসে না। দলটির আর্থিক অবস্থাও বিপর্যস্ত। সবমিলে দলটি এখন কঙ্কাল।

বাংলাদেশে ১২ কোটির কাছাকাছি ভোটার রয়েছে। নির্বাচনী জোট ছাড়া জামায়াত এখানে কার্যকর কোনো ফলাফল পাবে না।

জামায়াত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী জোটে ছিল। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান এখন জোটটির নেতৃত্বে রয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনী জোটের সরকারে দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পেয়েছিল জামায়াত।

যদিও জামায়াত এখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে নেই। তবে আগামী নির্বাচনে বিএনপি আবারও জামায়াতের ভোট তাদের পক্ষে পেতে চাইতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা আবারও জামায়াতকে নির্বাচনী জোটে আমন্ত্রণ জানাতে পারে।

বৈদেশিক সম্পর্ক:

বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামি দল জামায়াতকে নিয়ে ভারতের উদ্বেগ দূর করতে চায় বিএনপিও। বিএনপি সে জন্য জামায়াত থেকে আপাতত নিজেকে দূরে রাখতে চাইছে। কারণ, বাংলাদেশের বৃহত্তর প্রতিবেশীর কাছে জামায়াত একটি রেড ফ্লাগ।

বিষয়টির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য। রাজ্যগুলো কার্যত বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের দ্বারা স্থলবেষ্টিত এবং শুধু ১০-১২ মাইল-চওড়া ছোট শিলিগুড়ি করিডোর (চিকেন নেক) দিয়ে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত। এক সময়ের বিদ্রোহপ্রবণ এই রাজ্যগুলো ভারতবিরোধী বিদ্রোহী গ্রুপের নেতারা যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশে যে কোনো নির্বাচনী পরিবর্তন, যা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে তা ভারতের চিন্তার কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে পঞ্চম দীর্ঘতম স্থল সীমান্ত।

বিএনপি চায় না আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন করতে পারুক যেখানে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সে সময় বৈদেশিক চাপ থেকে টিকে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বিএনপি চায় না আওয়ামী লীগ এমন কোনো অজুহাত খুঁজে পাক যেটা দিয়ে ২০১৪ সালের মতো আবারও তারা বিশ্বের সমর্থন অর্জন করবে। আর এটা নিশ্চিত করতেই জামায়াত থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছে বিএনপি।

অনেকে ধারণা করছেন, আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘একধরনের সমঝোতায়’ যেতে পারে জামায়াত। যদিও সাম্প্রতিক ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতের পক্ষে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ওপর আস্থা রাখা কঠিন– তবে এটা একেবারেই যে অসম্ভব, তা নয়।

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে জামায়াত। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি একটি নতুন রাজনৈতিক দল যা অনেকের ধারণা ছদ্মবেশে জামায়াত।

কিন্তু অন্তর্ভুক্তিমূলক নয় বা অধিকাংশ প্রধান রাজনৈতিক দল বর্জন করছে এমন যে কোনো ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ জামায়াতে বিভক্তিও নিয়ে আসতে পারে।

এই মুহূর্তে জামায়াতের এমন কোনো বড় গণসংগঠন নেই যেখান থেকে দলটি নতুন সদস্য সংগ্রহ করতে পারে। ফলে জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। ভারতের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তি ঢাকার চলমান শাসনকে কিছুটা শ্বাস ফেলার জায়গা দিতে পারে এবং জামায়াতকে কিছুটা খড়কুটো জোগাতে পারে। আর সেই চুক্তিটি হবে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে জামায়াত নেতাদের অংশগ্রহণ।

এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একটি ন্যায্য, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। আগামী বছরের জানুয়ারিতে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে তারা ভারতের নিরাপত্তার উদ্বেগগুলোকে সম্মান করবে তা নিশ্চিত করার জন্য ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বাংলাদেশের সব প্রধান রাজনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।

ভারত ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকভাবে জড়িত এবং অবশ্যই এই ভবিষ্যৎ হতে হবে গণতান্ত্রিক।

কার্টেসি: কালবেলা


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭