ইনসাইড থট

আমার কলেজ-জীবন


প্রকাশ: 28/09/2023


Thumbnail

আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৭ তম জন্মদিন। কেমন ছিলো তার কৈশোর কাল? কিভাবে তিনি বেড়ে উঠেছেন। তার এক খন্ড চিত্র পাওয়া যায় শেখ হাসিনার লেখায়। ‘আমার কলেজ জীবন’ শিরোনামে লেখাটি শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাংলা ইনসাইডার প্রকাশ করলো-

স্কুলজীবন শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। সে কী উৎসাহ উদ্দীপনা। অধিকাংশ বন্ধু গভ. ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হচ্ছে। কাজেই আমিও সেখানে গেলাম, ফর্ম নিলাম, ভর্তি হলাম। বেশ কয়েকদিন অফিসে যেতে হলো। পুরনো কিছু স্কুলের বান্ধবী যারা আমাদের আগের বছর এসএসসি পাস করেছে, তাদের সাথে দেখা হলো। ওরা অনেক সাহায্য করল। বেশ কয়েকদিন অফিসে দৌড়াদৌড়ি করাতে মোটামুটি কলেজ ক্যাম্পাসটি চেনা হয়ে গেল, বিশেষ করে ক্যান্টিনের সাথে পরিচিত হলাম। সাধারণত স্কুলে ক্যান্টিন থাকে না, কিন্তু কলেজে ক্যান্টিন, এক কাপ চা নিয়ে বসে গল্প করা অর্থাৎ রীতিমতো চায়ের কাপে ঝড় তোলা বেশ মজার। রাজনীতির সাথে যারা জড়িত তারাও বেশ উৎসাহিত, আমি ভর্তি হচ্ছি দেখে।

এর কারণ হলো মেয়েদের মাঝে ছাত্র ইউনিয়ন করার প্রবণতা বেশি। তার ওপর মতিয়া চৌধুরী তখন তুখোড় নেত্রী, তাঁর সংগঠনই বেশি শক্তিশালী। স্কুলে থাকা সময় থেকেই তাঁর সংগ্রামী ভূমিকার কথা জানতাম। বিভিন্ন আন্দোলনে স্কুল থেকে মিছিল নিয়ে বটতলায়ও গিয়েছি। তবে মণি ভাই সব সময় সতর্ক করতেন আমরা আবার মতিয়া চৌধুরীর টানে যেন ভিন্ন রাজনীতিতে চলে না যাই। আমাকে ছাত্রলীগ করতে হবে। তবে আমার সঙ্গে মোটামুটি বন্ধুত্ব সকলের ছিল। নিলুফার পান্না, মঞ্জু, নসিবুন, নিলুফার, রানু, হাসু, টুনটুনি, মাহমুদাসহ অনেক সিনিয়র মেয়েরা যারা ছাত্রলীগ করত তারা খুবই খুশি। ভর্তির সময় অনেক সাহায্য তারা করল। যাহোক ভর্তি হলাম।

প্রথম ক্লাস শুরুর দিন। খুবই উৎসাহ, সারা রাত যেন আর ঘুমই হয় না। সকালে উঠেই তৈরি হলাম। প্রথম দিন কলেজে যাব। নতুন সালোয়ার কামিজ মা তৈরি করে দিয়েছেন। খুবই সুন্দর প্রিন্ট, একেবারে নতুন বাজারে এসেছে। খুব হালকা রঙের মধ্যে, আমার দারুণ পছন্দ। বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে সময় ঠিক করে নিলাম, যাতে এক সঙ্গে কলেজে ঢুকতে পারি। আগেই খবর পেয়েছিলাম র‌্যাগিং করবে। কিন্তু কী করবে জানি না। কলেজের গেটের ভিতরে পা রাখলাম। কত স্বপ্ন, মনে কী উৎসাহ, ক্লাসে যাব। ক্লাসরুমগুলো খুঁজে নিতে হবে। রুটিন জানতে হবে, শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। মনের মাঝে একটি উদ্বেগও কাজ করছে। কলেজ-জীবনের প্রথম দিন। দারুণ উত্তেজনা, উদ্দীপনা।

মোটামুটি সবাই ঠিক সময় এসেছে। কেউ ভেতরে প্রবেশ করে গেটের পাশেই অপেক্ষা করছে। কয়েকজন বাইরে। আমরা কয়েকজন এক সাথে গেটে ঢুকলাম। কিন্তু যেই গেটের ভেতরে পা দিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে ঝপাঝপ রং এসে চোখ- মুখ, কাপড়-চোপড় লাল রঙে ভিজিয়ে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আক্রমণ। আচমকা আক্রমণে প্রথমে হকচকিয়ে গেলাম । এত শখের সুন্দর কামিজটি, সাদা সালোয়ার, সাদা ওড়না সব লাল। পুরো ভিজে গেলাম। চোখের চশমাটি ভিজে গেল। ওড়না ও রুমাল দিয়ে চশমাটি মুছে নিলাম। এ ফাঁকে কী করণীয় তাও মনে মনে ঠিক করলাম। কাছেই এক বান্ধবী ছিল। হাতের বইগুলো ওকে ধরিয়ে দিলাম। দেখি বালতি ভরতি রং। সেখান থেকে মগে করে তুলে তুলে ছুড়ে মারছে। আমি কোনো কথা না বলে অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে বালতির দিকে এগুতে থাকলাম। ইতোমধ্যে আরও কয়েক মগ রং আমার দিকে ছুড়ে মারল। কোনো বাধা দিলাম না, প্রতিবাদ করলাম না। শুধু ওদের কাছে পৌঁছলাম বেশ হাসতে হাসতে। কারণ আমার মজাই লাগছিল। প্রথম ধাক্কাটি কাটিয়ে উঠতে যে সময়। কাছে এগিয়ে যেই বালতিটা হাতের নাগালে এসেছে, চকিতে বালতিটা তুলে সব রং ওদের ওপর ঢেলে দিলাম। ওরা বোধ হয় পাল্টা আক্রমণে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। খুবই ক্ষেপে গেল। ওদের যত রং ছিল সবই আমরা ওদের ওপর ছিটালাম। তাতে আমাদের সিনিয়ররা ভীষণ ক্ষেপে গেল। কিছু বিহারি মেয়ে ছিল, নন বেঙ্গলি যাদের বলা হতো, তারা দোয়াতের কালি নিয়ে এল। এক পর্যায়ে তাও কাড়াকাড়ি হলো এবং বেশিরভাগ তাদের গায়েই গেল। এতে ওরা গেল আরও ক্ষেপে। এদিকে আমাদের ওপর যে রং-কিছুক্ষণ পর দেখি রং আর নেই। বেশ বোকা বানালো আমাদের। নন বেঙ্গলিগুলো ভীষণ ক্ষেপেছে আমার ওপর। অনেকক্ষণ তারা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, যদিও আমি পুরোনো দালানে উঠে বসে মজা দেখছিলাম। আর একটি বান্ধবীর সাথে বারান্দায় বসে গল্প করছি। যাহোক ওরা অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে যখন হয়রান, আমরা আচমকা আবার এদের হাত থেকে কালির দোয়াত কেড়ে নিয়ে ওদের ওপরই ছিটিয়ে দিলাম। আরও ক্ষেপে গেল ওরা।

যাহোক এ পর্ব শেষ, ক্লাসে যাব। যার জন্য এত উদ্বেগ, উৎসাহ-উদ্দীপনা। রুটিন ও ক্লাসরুম নম্বর আগেই জোগাড় করেছিলাম। কয়েকজন বান্ধবী মিলে রুম নম্বর দেখে ক্লাসে ঢুকতে গেলাম, সেখানে দেখি উঁচু ক্লাসের ক্লাস হচ্ছে, আমাদের ক্লাস না। রুম নম্বর ঠিক অথচ আমাদের ক্লাস না, যখনই ঢুকতে গেলাম সবার সে কী হাসি! সত্যিই বোকা বনে গেলাম। কী ব্যাপার, দেখি সব ক্লাসরুমের নম্বরগুলো কাগজে উল্টোপাল্টা লিখে আমাদের বোকা বানাবার জন্য লাগিয়ে রেখেছে। কাজেই প্রথম দিন ক্লাসরুম নিয়ে ধোঁকা খেয়েই কাটাতে হলো। কলেজের প্রথম দিনটি নানা ঘটনায় বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণই হলো। যাহোক খুব বেশি ক্লাস আর সেদিন করা হলো না। শিক্ষকরা পর্যন্ত ক্লাসরুম নিয়ে ধোঁকা খেয়েছেন। আর ক্লাস খোঁজার জন্য কলেজটি মোটামুটি ঘুরে দেখা হলো। এটিও একটি লাভ হলো। জানি না এখনও নতুন ছাত্রীদের এভাবে পুরনো ছাত্রীরা আপ্যায়ন করে কিনা। আমাদের বড়রা মজা করেছিল।

ইন্টারমিডিয়েট কলেজের জীবন অনেক ঘটনাবহুল। আমাদের কলেজে কোনো শহীদ মিনার ছিল না। আমরা দাবি করলাম একটি শহীদ মিনার কলেজের ভেতরেই করতে। কিন্তু আমাদের প্রিন্সিপাল কিছুতেই করবেন না। করতে দিবেন না। আমরা আন্দোলন গড়ে তুললাম। আমাদের বাজেট, আমাদের টাকা, আমরা শহীদ মিনার করব। কিন্তু না, তিনি তা দেবেন না। একদিন আমরা কিছু ইট জোগাড় করলাম। অবশ্য কলেজেরই কাজ হচ্ছিল, সে ইট নিয়ে এসে ইটের উপর ইট সাজিয়ে একটি শহীদ মিনার বানিয়ে তাতে ফুল দিলাম। এটি ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি। পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি। কলেজ শেষে সন্ধ্যায় আমরা একুশের সভা করলাম। আমাদের প্রিন্সিপাল খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে রাতের মধ্যে নিজে এসে সে মিনার ভেঙে ফেললেন। পরদিন কলেজ বন্ধ। তারপরও খবর পেয়ে গেলাম কলেজে। খালি জায়গায় ফুল দিয়ে এলাম।

তার পরদিন কলেজ খুলেছে, আমরা ঠিক করলাম, ঐ জায়গাটাই আবার ফুল দেব। দেখি একজন একজন করে শিক্ষক বসিয়ে রেখে জায়গা পাহারা দেওয়া হচ্ছে যাতে আমরা ফুল দিতে না পারি। আমরাও কম যাই না, হাতে ফুল লুকিয়ে এক একজন পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আর ছুড়ে দিচ্ছি ফুল। সঙ্গে সঙ্গে পাহারারত শিক্ষক তা সরিয়ে ফেলছেন। এ ধরনের লুকোচুরি বেশ চলল ।

এক সময় প্রিন্সিপাল আমাকে ডেকে তাঁর রুমে বসিয়ে রাখলেন, অনেকটা বন্দি। বের হতে দেবেন না। তাঁর ভাষায় আমিই নাকি মূল হোতা। পরে অবশ্য মেয়েরা এক হয়ে তাঁর রুমের সামনে যখন স্লোগান দিতে শুরু করেছে, আমাকে ছেড়ে দেবার জন্য দাবি করছে, তখন আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

আমাদের আন্দোলন বেশ তুঙ্গে। শহীদ মিনার আমাদের চাই। ঢাকার ডিসিকে প্রিন্সিপাল খবর দিলেন। আমাকে হুমকি দিলেন অ্যারেস্ট করার। আব্বা তখন জেলে, নাজিমুদ্দিন রোড বকশীবাজার থেকে বেশি দূরে না। চার আনা রিকশা ভাড়া লাগে। প্রায় ১৫ দিন পরপর আব্বার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেতাম। কলেজ থেকে প্রায়ই যেতাম। আমাকে যখন হুমকি দেওয়া হলো গ্রেপ্তারের, বললাম, আপত্তি নেই। কারণ প্রায়ই তো যাচ্ছি। আর আব্বা যখন ভেতরে আছেনই আমি যাব জেলে। যাহোক ডিসি এলেন। সবাই আমরা ঠিক করলাম, ডিসি যেই বের হবেন, তাঁকে ঘেরাও করব। শহীদ মিনার আমাদের চাই- ই। যে কথা সেই কাজ। গ্রুপ গ্রুপ মেয়ে তৈরি। যেই বের হলেন ডিসি, আমরা ঘেরাও করলাম। আমাদের দাবি মানতেই হবে। আমাদের কলেজের বাজেট থেকেই আমরা করব । কিন্তু করতে দিতে হবে। মেয়েদের দ্বারা ঘেরাও হবে সেটি বোধ হয় বুঝতে পারেননি। কাজেই অনেকক্ষণ আটক থেকে কথা দিলেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করবেন এবং শহীদ মিনার যাতে হয় তা দেখবেন। আমি ভিপি এবং আমার জিএস-এর সঙ্গে আরও দু'একজন প্রতিনিধি যেন তাঁর সাথে এ ব্যাপারে পরে যোগাযোগ করি। তাঁর কথায় আশ্বস্ত হয়ে আমরা তাকে ছেড়ে দিলাম। এরপর সময় নির্ধারণের জন্য তাঁর কাছে ফোন করি, আর ফোনও ধরে না, সময়ও দেয় না। আমাদের সাথে ভালো ধোঁকাবাজি দিয়েছে। শেষে একদিন কলেজের মেয়ে নিয়ে জিএসসহ ডিসি অফিসে গেলাম। আমরা কলেজের কথা বলি। তিনি আমাকে আব্বার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কোনো পারমিশন লাগলে দেবেন ইত্যাদি কথা বলেন, চা-পানি খাওয়ান। আসল কথা আর বলেন না। যাহোক আমরা ছাড়ি না। অবশেষে বলে এলাম, শহীদ মিনার এ কলেজে হবেই। একদিন করবই। এছাড়া কলেজের অন্যান্য অসুবিধার কথাও এ সুযোগে বলে এলাম। (অবশ্য কলেজে শহীদ মিনার পরে হয়েছে)। তবে আমি ততদিন কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। আমার পর ছাত্র ইউনিয়ন থেকে কলেজে ভিপি হয়েছিল। মনে আছে বাজেটে সই করিনি, কারণ বাজেটে শহীদ মিনারের বরাদ্দ ছিল না। ৪/৫ ঘণ্টা আমাকে সেদিনও বন্দি করে রাখা হয়েছিল প্রিন্সিপালের রুমে। বার বার প্রিন্সিপাল ও অন্য শিক্ষকরা বলায় জিএস আগে সই করল, অবশেষে আমাকেও করতে হলো। যাহোক, পরে শহীদ মিনার হয়েছে। আমাদের আন্দোলন বৃথা যায়নি। সে প্রিন্সিপালকে ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে আইয়ুবের পতনের পর বদলি করে অন্য জায়গায় পাঠানো হয়। ছাত্র ইউনিয়ন কলেজ-সংসদে ছিল। অবশ্য আমাকে ওরা একবার খবরও দেয়নি, বলেওনি। খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। আমি এত আন্দোলন করলাম, অথচ সেই শহীদ মিনার তৈরি হলো, আমাকে একবার জানালো না। উদারতার এত অভাব, না হীনম্মন্যতা? এ কলেজ থেকে বিপুল ভোটে কলেজ ইউনিয়নে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হই। প্রকৃতপক্ষে সক্রিয় রাজনীতি এ কলেজ-জীবন থেকে শুরু। তারপর থেকে আজও চলছে। অনেক স্মৃতিভরা কলেজ-জীবন কত আর লেখা যায়। সময়েরও অভাব। আরও অনেক স্মৃতি ধীরে ধীরে সময় পেলে লিখব। খুব ভালো লাগছে। এ অনুষ্ঠানটি হচ্ছে বলে কিছু কথা বলার সুযোগ হলো। কত সুযোগ, বান্ধবীদের সঙ্গে দেখার সুযোগ হবে, শিক্ষকদের সঙ্গে দেখার সুযোগ হবে। আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ।

স্মৃতি বড় মধুর। কলেজে আট আনায় এক প্লেট বিরিয়ানি, চার আনায় কাবার, দুই আনার পরোটা, দুই আনায় এককাপ চা, আহ্ স্বাদটি যেন এখনও লেগেই আছে মুখে।

সুবর্ণজয়ন্তি উৎসব স্মরণিকা (১৯৪৮-১৯৯৮)

 

(শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র ১।। পৃষ্টা: ২৫১-২৫৪)

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭