প্রকাশ: 28/09/2023
আজ
প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষ্যে শেখ হাসিনার আত্ম স্মৃতিচারণ মূলক এই লেখাটি
বাংলা ইনসাইডার প্রকাশ করলো-
গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া
গ্রামখানি একসময় মধুমতি নদীর তীরে ছিল। বর্তমানে মধুমতি বেশ দূরে সরে গেছে। তারই শাখা
হিসেবে পরিচিত বাইগার নদী এখন টুঙ্গীপাড়া গ্রামের পাশ দিয়ে কুল কুল ছন্দে ঢেউ তুলে
বয়ে চলেছে। রোদ ছড়ালে বা জ্যোৎস্না ঝরলে সে নদীর পানি রুপোর মতো ঝিকমিক করে।
নদীর পাড় ঘেঁষে কাশবন, ধান-পাট-আখ
ক্ষেত, সারিসারি খেজুর, তাল- নারকেল আমলকি গাছ, বাঁশ-কলাগাছের ঝাড়, বুনো লতা-পাতার
জংলা, সবুজ ঘন ঘাসের চিকন লম্বা লম্বা সতেজ ডগা। শালিক-চড়ুই পাখিদের কল-কাকলি, ক্লান্ত
দুপুরে ঘুঘুর ডাক। সব মিলিয়ে ভীষণরকম ভালোলাগার একটুকরো ছবি যেন। আশ্বিনের এক সোনালি
রোদ্দুর ছড়ানো দুপুরে এ টুঙ্গীপাড়া গ্রামে আমার জন্ম। গ্রামের ছায়ায় ঘেরা, মায়ায়
ভরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ এবং সরল-সাধারণ জীবনের মাধুর্যের মধ্য
দিয়ে আমি বড় হয়ে উঠি।
আমাদের বসতি প্রায় দু'শ বছরের
বেশি হবে। সিপাহী বিপ্লবের আগে তৈরি করা দালান-কোঠা এখনও রয়েছে। আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা
সেখানে বসবাস করেন। তবে বেশিরভাগ ভেঙে পড়েছে, সেখানে এখন সাপের আখড়া। নীলকর সাহেবদের
সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষদের অনেক গোলমাল হতো। মামলা-মোকদ্দমা হয়েছে। ইংরেজ সাহেবদের
সঙ্গেও গণ্ডগোল লেগেই থাকত। একবার এক মামলায় এক ইংরেজ সাহেবকে হারিয়ে জরিমানা পর্যন্ত
করা হয়েছিল। ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে সে ভাঙা দালান এখনও বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাবাহিনী ঐ দালানের ওপর হামলা চালিয়েছিল।
আমার দাদা-দাদিকে সামনের রাস্তায় বসিয়ে রেখে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল।
আমাদের গ্রামে ঢাকা থেকে স্টিমারে
যেতে সময় লাগত সতেরো ঘন্টা। রাস্তা- ঘাট ছিলই না। নৌকা ও পায়ে হাঁটা পথ একমাত্র ভরসা
ছিল। তারপরও সে গ্রাম আমার কাছে বিরাট আকর্ষণীয় ছিল। এখন অবশ্য গাড়িতে যাওয়া যায়।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্পীডবোটেও যাওয়া যায়। গোপালগঞ্জ থেকে টুঙ্গীপাড়া নৌকায়
যেতে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগে।
আমার শৈশবের স্বপ্ন-রঙিন দিনগুলো
কেটেছে গ্রাম-বাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষার কাদা-পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল
আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে, জোনাক-জ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝির ডাক শুনে, তাল-
তমালের ঝোপে বৈচি, দীঘির শাপলা আর শিউলি-বকুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে, ধুলোমাটি মেখে,
বর্ষায় ভিজে খেলা করে।
আমার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতি করতেন। বেশির ভাগ সময় তাঁকে তখন জেলে আটকে রাখা হতো। আমি ও আমার ছোট ভাই কামাল মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে দাদা-দাদির কাছে থাকতাম। আমার জন্মের সময় বাবা কলকাতায় পড়তেন, রাজনীতি করতেন। খবর পেয়েও দেখতে আসেন বেশ পরে।
আমার বাবা যখনই সময় ও সুযোগ
পেতেন একবার বাড়ি এলে আমরা কিছুতেই তাঁকে ছেড়ে নড়তাম না। বাবার কোলে বসে গল্প শোনা,
তার সঙ্গে খাওয়া, আমার শৈশবে যতটুকু পেয়েছি তা মনে হতো অনেকখানি।
বাবাকে একবার গোপালগঞ্জ থানায়
আনা হলে দাদার সঙ্গে আমি ও কামাল দেখতে যাই। কামালের তো জন্মই হয়েছে বাবা যখন ঢাকায়
জেলে। ও বাবাকে খুব কাছ থেকে তখনও দেখেনি। আমার কাছেই বাবার গল্প শুনত মুগ্ধ হয়ে।
গোপালগঞ্জ জেলখানার কাছে পুকুর পাড়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, বাবাকে নিয়ে যাবে কোর্টে
তখনই আমরা দেখব। কামাল কাছ ঘেঁষে বলল : হাচুপা, তোমার আব্বাকে আব্বা বলতে দেবে। আমার
শৈশবের হৃদয়ের গভীরে কামালের এ অনুভূতিটুকু আজও অম্লান হয়ে আছে। বাবাকে আমাদের শৈশবে-কৈশোরে
খুব কমই কাছে পেয়েছি। শৈশবে পিতৃস্নেহ বঞ্চিত ছিলাম বলে দাদা-দাদি, আত্মীয়- স্বজন,
গ্রামের মানুষের অশেষ স্নেহ-মমতা পেয়েছি।
আমাদের পরিবারের জন্য মৌলভী,
পণ্ডিত ও মাস্টার বাড়িতেই থাকতেন। আমরা বাড়ির সব ছেলেমেয়ে সকাল-সন্ধ্যা তাঁদের কাছে
লেখাপড়া শিখতাম। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেও কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলাম। আমার কৈশোরকাল
থেকে শহরে বাস করলেও গ্রামের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল। ১৯৫২ সালে আমার দাদার সঙ্গে
আমাদের বাড়ির নিজস্ব নৌকায় চড়ে প্রথম ঢাকা শহরে আসি। আমার স্নেহময়ী দাদা-দাদি আত্মীয়-স্বজন
বেশিরভাগ গ্রামে বাস করতেন। স্কুলে ছুটি হলে বা অন্যান্য উৎসবে বছরে প্রায় তিন-চারবার
গ্রামে চড়ে যেতাম। আজও আমার গ্রামের প্রকৃতি, শৈশব আমাকে ভীষণভাবে পিছু টানে।
আমার শৈশবের দিনগুলো ভীষণরকম
স্মৃতিময়। আজ সেসব দিনের কথা যেন স্মৃতির দুখিন দুয়ার খোলা পেয়ে বারবার ভেসে আসছে। একটি
ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। আমার বাবার এক চাচাতো বোন, আমার চেয়ে বয়সে তিন-চার
বছর বড় হবে। সে ফুফুর সঙ্গে বাড়ির সব ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছি। খালের ওপর ছিল বাঁশের
সাঁকো। সে সাঁকোর ওপর দিয়ে যেতে হবে। প্রথমদিন কি দারুণ ভয় পেয়েছিলাম। আমার হাত-পা
কাঁপছিল। ফুফুই আমাকে সাহস দিয়ে হাত ধরে সাঁকো পার করিয়ে দিয়েছিল। এরপর আর কখনো
ভয় করেনি। বরং সবার আগে আমিই থাকতাম।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সমবয়সী
ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নদীর ধারে বেড়ানো, শীতের দিনে নদীর উষ্ণ পানিতে পা ভেজানো আমার
কাছে ভীষণরকম লোভনীয় ছিল। নদীর পানিতে জোড়া নারকেল ভাসিয়ে অথবা কলাগাছ ফেলে সাঁতার
কাটা, গামছা বিছিয়ে টেংরা পুঁটি খল্লা মাছ ধরা। বর্ষাকালে খালে অনেক কচুরিপানা ভেসে
আসত। সে কচুরিপানা টেনে তুললে তার শেকড় থেকে বেরিয়ে আসত কই ও বাইন মাছ। একবার একটি
সাপ দেখে খুব ভয় পেয়েছিলাম।
বৈশাখে কাঁচা আম পেড়ে কুচি
কুচি করে কেটে সর্ষেবাটা ও কাঁচা মরিচ মাখিয়ে, তারপর কলাপাতা কোনাকুনি করে সে আম মাথা
পুরে, তার রস টেনে খাওয়ার মজা ও স্বাদ আমাকে এখনও আপ্লুত করে রাখে। কলাপাতায় এ আম
মাথা পুরে যে না খেয়েছে, কিছুতেই এর স্বাদ বুঝবে না। আর কলাপাতায় এ আম মাথা পুরলে
তার ঘ্রাণই হতো অন্যরকম। এভাবে আম খাওয়া নিয়ে কত মারামারি করেছি। ডাল ঝাঁকিয়ে বরই
পেড়ে কাড়াকাড়ি করে খেতাম। গ্রামের বড় তালাবের (পুকুর) পাড়ে ছিল বিরাট এক বরই গাছ।
ঝাঁকুনির ফলে লালের আভা লাগা সব থেকে টলটলে বরইটি পুকুরের গভীর পানিতে গিয়ে পড়ত এবং
কারও পক্ষে কিছুতেই সেটি যখন তুলে আনা সম্ভব হতো না তখন সে বরইটির জন্য মন জুড়ে থাকা
দুঃখটুকু এখনও ভুলতে পারলাম কই?
পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে আমরা
ছোট ডিঙ্গি নৌকা চড়ে ঘুরে বেড়াতাম। আমার দাদার একটি বড় নৌকা ছিল, যার ভেতরে দুটো
ঘর ছিল, জানালাও ছিল বড় বড়। নৌকার পেছনে হাল, সামনে দুই দাঁড় ছিল। নৌকার জানালায়
বসে নীল আকাশ আর দূরের ঘন সবুজ গাছপালা ঘেরা গ্রাম দেখতে আমার বড় ভালো লাগতো। ১৯৭১-এর
মুক্তিযুদ্ধের সময় সে নৌকা ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়। শৈশবের ফেলে আসা সে গ্রাম আমার কাছে
এখনও যেন সুভাষিত ছবির মতো।
আমার বাবার জন্মস্থানও টুঙ্গীপাড়ায়।
তিনি এখন ঐ গ্রামের মাটিতেই ছায়াশীতল পরিবেশে ঘুমিয়ে আছেন। তার পাশেই আমার দাদা-দাদির
কবর। যারা আমার জীবনকে অফুরন্ত স্নেহমমতা দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিলেন, আজ আমার গ্রামের মাটিতেই
তারা মিশে আছেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে আমার মা, বাবা, ভাই ও আত্মীয়-পরিজন
অনেককে হারাই। দেশ ও জাতি হারায় তাদের বেঁচে থাকার সকল সম্ভবনা, আশা-আকাঙ্খার স্বাধীন
সত্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঘাতকের দল বাংলার প্রাণকেন্দ্র ঢাকা থেকে সরিয়ে
সে মহাপুরুষকে নিভৃতে পল্লীর মাটিতেই কবর দিয়েছে। ইতিহাসের পাতা থেকে তাঁকে মুছে ফেলার
ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছে – কিন্তু পেরেছে কী?
বাবার কাছাকাছি বেশি সময় কাটাতাম।
তাঁর জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক আলোচনা করার সুযোগও পেতাম। তাঁর একটি কথা আজ খুব বেশি
করে মনে পড়ে। তিনি প্রায়ই বলতেন, 'শেষ জীবনে আমি গ্রামে থাকবো। তুই আমাকে দেখবি।
আমি তোর কাছেই থাকব।' কথাগুলো আমার কানে এখনও বাজে। গ্রামের নিঝুম পরিবেশে বাবার মাজারের
এ পিছুটান আমি পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, আমাকে বারবার আমার গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে
যায়।
আমি এখন নিজেকে রাজনীতির সঙ্গে
জড়িয়ে নিয়েছি। দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরে আমি গর্বিত। আমার জীবনের
শেষ দিনগুলো আমি টুঙ্গীপাড়ায় স্থায়ীভাবে কাটাতে চাই। খুব ইচ্ছে আছে নদীর ধারে একটি
ঘর তৈরি করার। আমার বাবা-মার কথা স্মৃতিকথামূলকভাবে লেখার ইচ্ছে আছে। আমার বাবা রাজনীতিবিদ
মুজিবকে সবাই জানতেন। কিন্তু ব্যক্তি মুজিব যে কতো বিরাট হৃদয়ের ছিলেন, সেসব কথা আমি
লিখতে চাই।
গ্রামকে তো আমি আমার শৈশবের গ্রামের মতো করেই ফিরে পেতে চাই। কিন্তু চাইলেই তো আর হবে না। এখন সময় দ্রুত বদলাচ্ছে। যান্ত্রিকতার স্পর্শে গ্রামের সরল সাধারণ জীবনেও ব্যস্ততা বেড়েছে, চমক জেগেছে। মানুষও ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। এ শতাব্দীতে বাস করে বিজ্ঞানের আশীর্বাদকে অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর গ্রামীণ জীবনের মানোন্নয়ন ও শ্রমের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে।
আমার শত ব্যস্ততা থাকলেও এবং
একটু সময় পেলেই আমি গ্রামে চলে যাই । কেন যে মনে হয় আমার শৈশবের গ্রামকে যদি ফিরে
পেতাম! গ্রামের মেঠোপথটি যখন দূরে কোথাও হারিয়ে যায় আমার গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করে,
‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গা মাটির পথ, আমার মন ভোলায় রে......।’
(শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র
১।। পৃষ্টা: ২৫-২৮)
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭