প্রকাশ: 01/10/2023
-
১ অক্টোবর ২০০১। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে জুলাই মাসে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় শান্তিপূর্ণ ভাবে। কিন্তু ১ অক্টোবরের নির্বাচনে ফলাফল ঘোষনার সাথে সাথে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা তান্ডব শুরু করে, শুরু হয় সন্ত্রাস, নারকীয়তার বিভৎস উৎসব। ঐ সময়কার ঘটনা উঠে এসেছে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘সহে না মানবতার অবমাননা’ শীর্ষক লেখায়। পাঠকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে আজ ১ অক্টোবর থেকে লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হলো-
একজন মানুষের মৌলিক অধিকার হচ্ছে তার জীবন-জীবিকা, মানসিক শাস্তি,
জীবনের নিরাপত্তা ও সামাজিক নিরাপত্তা। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান,
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের অধিকারে নিশ্চয়তা মানুষের প্রধান কাম্য। একটি
রাষ্ট্রে মানুষ জন্ম নেয় এবং বসবাস করে। নাগরিক কর দেওয়ার বিনিময়ে সামাজিক
নিরাপত্তা চায়। সামাজিক নিরাপত্তা অর্জিত হতে পারে তখনই যখন দেশ অর্থনৈতিকভাবে
স্বাবলম্বিতা অর্জন করে। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া সামাজিক উন্নতি সম্ভব হয় না।।
অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পূর্বশর্ত হলো দেশে স্থিতিশীলতা বজায়
থাকা। স্থিতিশীলতা তখনই আসবে যখন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত থাকবে। মতামত
প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। সরকার গঠন ও পরিবর্তনের অধিকার যখন জনগণের হাতে থাকে
তখনই মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। ভোট দানের মধ্যদিয়ে ব্যক্তি তার মত প্রকাশ
করতে পারে। প্রতিনিধি দ্বারা সরকার গঠিত হয়। ভোটের মাধ্যমে গঠিত সরকার ভোটারকে
গুরুত্ব দেবে। ভোটারের ভালো-মন্দ দেখবে। ভোটারের জীবনের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত
করবে। মৌলিক অধিকার অর্থাৎ বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত হলেই একটা দেশে দারিদ্র্য বিমোচন
সম্ভব। ভোটের অধিকারই ভাতের অধিকার নিশ্চিত করতে পারে— যার ফলে দারিদ্রা বিমোচন
সম্ভব হবে। দারিদ্র্য দূর হলেই মানুষের নাগরিক সচেতনতা গড়ে ওঠে।
যদি কোনো দল বা গোষ্ঠী পেশী, অস্ত্র ও কালো টাকার জোরে ক্ষমতা দখল
করতে পারে, তবে কোনোদিনই ভোটারের তোয়াক্কা করবে না। মানুষের দিকে ফিরে তাকাবে না।
চরম স্বেচ্ছাচারী হবে। কষ্ট পাবে সে দেশের মানুষ। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে আমরা এ
ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আমার নিজের দেশেরও অবস্থা এই পর্যায়ে রয়েছে। কালো টাকা,
দুর্নীতি, পেশীশক্তি নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে। উপরে সবই চমৎকার কিন্তু ভিতরের ক্ষত
কত গভীর তা চোখে দেখা যায় না শুধুমাত্র যারা ভুক্তভোগী তারাই জানে, তারাই
যন্ত্রণা ভোগ করে । কথা বলার ও মত প্রকাশের সুযোগ থাকে না। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে
অপপ্রচার করে তাঁর ইমেজ নষ্ট করা হয়। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা,
রাজনৈতিকভাবে হত্যা করার চেষ্টা সফল না হলে শারীরিকভাবে হত্যা করে পৃথিবী থেকে
চিরবিদায় করে দেওয়া হবে।
জনগণের কথা বলতে গেলে বার বার এ অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। আমার প্রশ্ন
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? তথ্য প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কার বিশ্বকে
উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বিশ্বায়নের স্লোগান বিশ্বকে ছোট করে দিয়েছে। এক দেশ থেকে
আর এক দেশ, এক দেশের মানুষ আর এক দেশের মানুষ অনেক কাছে চলে এসেছে। ইলেক্ট্রনিক
মিডিয়া, ইন্টারনেট এবং আধুনিক টেলিকমিউনিকেশন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক
প্রান্তে মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে। মতামত প্রকাশের, জানার,
বোঝার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে একথা সত্য, কিন্তু এখনও এ পৃথিবীতে এমন অঞ্চল আছে
যেখানে এ সভ্যতার বাতাস পুরোপুরি পৌঁছায় নি। এখনও এ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার
অনেক মানুষ পায় নি।
আমার কাছে একটি প্রশ্ন বার বার ফিরে আসে তা হলো ক্ষমতার আড়ালে
একটা অদৃশ্য গোষ্ঠীর ক্ষমতা থাকে। এই অদৃশ্য ক্ষমতা কোথায়? কাদের হাতে? এই ক্ষমতা
কি বিশ্বের অস্ত্র ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করে, না তেল ব্যবসায়ীরা, নাকি মাফিয়ারা?
এই অন্ধকারের শক্তি কারা? কারা এদের লালন করে, ব্যবহার করে? কারাই বা এদের গডফাদার?
মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সংজ্ঞা হয়তো রয়েছে। তবে আমার
কাছে এর অর্থ অনেক বেশি ব্যাপৃত। অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্তৃত। যা আমি আগেই
বলেছি। আমার দেশের মানুষ কেমন আছো? কেমন
থাকতে চায়? প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আমি নিজেও পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিলাম, আমি কি জনগণের
সেবা করতে পেরেছি? কেনইবা নির্বাচনে হারিয়ে দেওয়া হলো? ১ অক্টোবর ২০০১ সালের
নির্বাচনের পর আমার দেশের মানুষ কেমন আছে?
আমার বাংলাদেশ। ৫৫ হাজার বর্গমাইল (কিলোমিটার ১,৪৭,৫৭০ স্কোয়ার)
আর জনসংখ্যা ১২ কোটি। যা আঁতকে ওঠার মতো বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাছে। তবুও আমরা
তো মানুষ। বাস করি একটি ভূ-খণ্ডে। বার বার বঞ্চনার শিকার হতে হয় কেন আমার দেশের মানুষদের?
সামরিক শাসন, নৃশংস হত্যাকাও, স্থিতিহীনতা যেন খুব স্বাভাবিক ঘটনা। চরম
দারিদ্র্যা, শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, স্বাস্থ্যহীনতা, বেকারত্ব
ইত্যাদি মানবেতর জীবন- যাপন অভিশাপের মতো আঁকড়ে ধরে আছে সমাজকে। দুঃশাসন,
দুর্নীতি, সন্ত্রাস ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, বৃহত্তর
জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন-নিপীড়ন-শোষণ করার জন্য। বার বার এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য
আমাদের মানুষ লড়াই করে রাজপথে। পুলিশ, মিলিটারি, ক্ষমতাসীনদের লেলিয়ে দেওয়া
গুপ্তাবাহিনীর হাতে রক্ত দেয় এই বিশেষ গোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য।
মুক্তি অর্জন করে ক্ষমতা ফিরে পায়। জনগণ একটু আশার আলো দেখে স্বস্তি ফিরে পায়।
দু বেলা খেতে পায়, কিন্তু বেশি দিন এ সুখ থাকে না। আবার তাদের জীবনে নেমে আসে
অন্ধকার। কেন বার বার এমন হয়?
আমার নিজের কথা বলতে পারি। আমার পিতা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৪ বছর সংগ্রাম করে জেল-জুলুম-অত্যাচার সয়ে
বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকা
অবস্থায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সপরিবারে, ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে।
বিদেশে অবস্থানের কারণে আমি ও আমার ছোট বোন, প্রাণে বেঁচে যাই । এই ঘটনার পরই
মার্শাল ল' জারি এবং স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়। গণতন্ত্র হয়
নির্বাসিত। খুনিরা পুরষ্কৃত হয়। বিচারের পরিবর্তে তাদের দেওয়া হয় বিদেশি
দূতাবাসে লোভনীয় চাকরি। আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঐ খুনিদের ও তাদের দোসরদের
মোকাবিলা করে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করি। কয়েকবার বন্দী করা হয় আমাকে। বিভিন্ন
সময়ে গুলি ও বোমা মেরে হত্যারও চক্রান্ত হয়। কিন্তু আমি আমার দেশের মানুষের
মৌলিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত
রাখি, সফল হই। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার দেশের মানুষের বেশি দিন তাদের সে সুখ থাকে
না। অদৃশ্য শক্তির ষড়যন্ত্র তাদের অধিকার কেড়ে নেয়। কেন বার বার এমন হয়? মানুষ
কেন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। মানুষই মানুষের শুরু হয় কেন?
সমগ্র বিশ্বে যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে অম্লের পিছনে, সে অর্থ যদি কেবল
শিশু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় হতো তাহলে পৃথিবীর সকল শিশু তাদের অধিকার
ফিরে পেত। এক একটা যুদ্ধে যে অর্থ ব্যয় হয় যদি সে অর্থ নারী অধিকার এবং বিশ্বের
দরিদ্র মানুষের আহার ও বাসস্থানের জন্য ব্যয় হতো, কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া
হতো তাহলে বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য দূর করা যেত। মানুষকে আমরা অভিশপ্ত জীবন থেকে
আলোকিত পথে নিয়ে যেতে পারতাম ।
কোনো কোনো দেশ তাদের সম্পদ মজুদ রাখতে চায় ভবিষ্যতের জন্য। পাশাপাশি
অন্যের সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে নিয়ে করে দেয়। মানুষ কষ্ট পায়। জোর যার মুল্লুক
তার—এটাই কি তাহলে চলবে?
(সূত্র: শেখ হাসিনা রচনা সমগ্র-২।। পৃষ্টা:২৫-২৭)
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭