ইনসাইড বাংলাদেশ

আজ সেই ভয়াল ১ অক্টোবর


প্রকাশ: 01/10/2023


Thumbnail

আজ ১ অক্টোবর। ২০০১ সালের এই দিনটি ছিল বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে একটি ভয়াল রাত। অক্টোবরে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোটের যে তাণ্ডব, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকেই কেবল কলঙ্কিত করেনি, নির্বাচন ব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল।

২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে একটি সরকার স্বেচ্ছায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে পহেলা অক্টোবর। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই বিএনপি জামায়াতের ষড়যন্ত্রের নীলনকশা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিমাতা সুলভ আচরণ শুরু করে সদ্য ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়া আওয়ামী লীগের সাথে। সারাদেশে শুরু হয় আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ধরপাকড়। এক যোগে ১৩ জন সচিবকে বদলি করে দেয়া হয়। বিএনপি-জামায়াতের আদেশ বাস্তবায়ন করতে থাকে বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এরকম অবস্থাতেই অনুষ্ঠিত হয় পহেলা অক্টোবর ২০০১ সালের নির্বাচন এবং এই নির্বাচনের ফলাফল ছিল পূর্ব নির্ধারিত।

নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ৪২ শতাংশ ভোট পেলেও আসন পায় অনেক কম। এরকম একটি অবস্থার পর সকলে মনে করেছিল যে, জনগণের ভোটে যেহেতু বিএনপি-জামায়াত নির্বাচিত হয়েছে কাজেই বিএনপি-জামায়াত গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবে, ভিন্ন মতের মানুষকে সম্মান দিবে এবং একটি সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিবে। কিন্তু পহেলা অক্টোবর রাতেই যখন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা শুরু হলো তারপর থেকেই একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি শুরু হয়।

২০০১ সালের ১ অক্টোবর সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের ‘সন্ত্রাস-রাজনীতি’ মূলত চুড়ান্ত রুপ ধারণ করে। নির্বাচনে জয়লাভের পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে চলতে থাকে সেই ধারাবাহিকতা। সারাদেশে বিএনপি জয়ী হচ্ছে এটি জানার পরেই বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা সারাদেশে তাণ্ডব শুরু করলো। বিশেষ করে যেসব এলাকা আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত, সে সমস্ত এলাকায় নির্বিচারে হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট শুরু করলো বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন নির্বিকার ভাবে বসে ছিল। কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। মুহূর্তের মধ্যে কয়েক লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে পড়ে এবং হত্যা করা হয় শত শত মানুষকে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা শেষ করার পর ২ থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত চলে এই নারকীয় তাণ্ডব। একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর এ রকম সহিংস ঘটনা ঘটতে পারে এটি অবিশ্বাস্য এবং অকল্পনীয়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট এটিই করেছিল। 

১০ অক্টোবর শপথ নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন মন্ত্রিসভা। ১ থেকে ১০ অক্টোবর বিএনপি সারাদেশে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বিএনপি-জামায়াতের মূল লক্ষ্য ছিল ভিন্ন মতের কোন মানুষ যেন না থাকে। আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করে দেয়ার প্রথম পদক্ষেপ ছিল ১ অক্টোবর।

অক্টোবরের ২০০১ সালের নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি এবং জামায়াত জোট হিন্দুদের উপর যে আক্রমণ করে তার বিভিন্ন খবরে ও প্রতিবেদনে অনেকবার উঠে এসেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট মতে, “২০০১ সালের ১ অক্টোবর বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভোট না দেয়ার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামাত জোট একের পর এক হামলা করতে শুরু করে, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিলো যে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভোটারেরা আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে। নির্বাচনের পরের অবস্থা ছিলো আরো পরিকল্পিত, ছকবদ্ধ এবং গুরুতর। প্রতিবেদনগুলো ইঙ্গিত দেয় সেসময় বিএনপি জোটের হামলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিলো বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, যশোর, কুমিল্লা ও নরসিংদী। ওই সময় আক্রমণকারীরা হিন্দুদের বাড়িতে ঢুকে তাদের পরিবারের সদস্যদের মারধর, তাদের সম্পত্তি লুটপাট এবং অনেক হিন্দু নারীদের ধর্ষণও করে।”

কানাডার ইমিগ্রেশন এবং শরণাথী বোর্ডের গবেষণা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বাংলাদেশে নির্বাচনের সময়কালে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতার ঘটনাগুলো বিবিসি (১০ অক্টোবর ২০০১), গাল্ফ নিউজ (১২ ফেব্রুয়ারী ২০০২), প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (২০ অক্টোবর ২০০১), এবং প্যাক্স ক্রিস্টি (২৬ নভেম্বর, ২০০১) ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায় । এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, “ঘটনাগুলোতে ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা ও লুটপাটের পাশাপাশি হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সহিংসতার শিকার হয়ে শত শত হিন্দু পরিবার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। দ্য ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়য়েন্স জানায় যে বেশিরভাগ সহিংসতা বিএনপির কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত হয়... হিন্দুদের উপর আক্রমণগুলো সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় ঘটেছে।”

২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের উপর বিএনপি জামায়াতের হামলার খবর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টর আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদন ২০০৫-এ প্রকাশ পায়। সেখানে বলা হয় হিন্দুদের উপর সহিংস আচরণ করেছে যারা ঐতিহ্যগত ভাবেই আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, লুট এবং নির্যাতনের কথা উল্লেখ ছিল।

১ অক্টোবরের রাতের বিভীষিকার কথা এখনও ভুলেনি ভোলা-আগৈলঝড়া, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ সহ বিভিন্ন এলাকার মানুষরা। ২০ বছর পরও সেই স্মৃতি এখনো তাদেরকে আতঙ্কিত করে, উদ্বিগ্ন করে। একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হলো ভোটাধিকার। তিনি যাকে খুশি ভোট দিবেন, এটিই গণতান্ত্রিক রীতিনীতি। কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি-জামায়াত তাদেরকেই টার্গেট করেছিল যারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে বা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরাও বাদ যায়নি। মসজিদ, মন্দিরে আক্রমণ করে, মন্দির ভাংচুর করে বিপক্ষ ভোটদানকারীদের নিঃশেষ করতে চেয়েছিল বিএনপি। 

কিন্তু ২২ বছর পর ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, আজ বিএনপি-জামায়াত নিজেরাই নির্বাসিত, তাদের অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছে। এই দুইটি দলই নিঃশেষিত প্রায়। জনগণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের সেই তাণ্ডব মূল্যায়ন করলে এটুকুই নিশ্চিত বলা যায় যে, এদেশের মানুষের উপর যারা অত্যাচার করে, ইতিহাস খুব নির্মমভাবেই তাদের প্রতিশোধ নেয়।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭