ইনসাইড বাংলাদেশ

সহে না মানবতার অবমাননা


প্রকাশ: 04/10/2023


Thumbnail

১ অক্টোবর ২০০১। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে জুলাই মাসে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় শান্তিপূর্ণ ভাবে। কিন্তু ১ অক্টোবরের নির্বাচনে ফলাফল ঘোষনার সাথে সাথে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা তান্ডব শুরু করে, শুরু হয় সন্ত্রাস, নারকীয়তার বিভৎস উৎসব। ঐ সময়কার ঘটনা উঠে এসেছে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘সহে না মানবতার অবমাননা’ শীর্ষক লেখায়। পাঠকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে আজ ৪ অক্টোবর লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হলো-

 

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কি পর্যায়ে রয়েছে? ১ অক্টোবর নির্বাচনের পর থেকে সমগ্র দেশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যা অত্যন্ত ভয়াবহ। একদিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত সরকার। অপরদিকে এই সুযোগে লুট, চাঁদাবাজি, দখল, ছিনতাই, হত্যা, ধর্ষণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। মনে হচ্ছে বিএনপির প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে যাচ্ছে সমস্ত সমাজ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা গ্রহণের এ ধরনের নজির আমরা দেখেছিলাম ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সরকার ইয়াহিয়া খাঁর আমলে। আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে একথা উল্লেখ রয়েছে। ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সেদিন মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার যে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার গঠন করেছিলেন সেখানেই উল্লেখ রয়েছে কিভাবে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বর অত্যাচার চালিয়েছিল পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়া তার সেনাবাহিনী দিয়ে। তাদের সহযোগিতা করেছিল ইয়াহিয়ার পদলেহনকারী এদেশীয় কিছু দালাল। যারা আজও সক্রিয়। সেদিন নির্বাচন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে রেজাল্ট পাল্টানোর চেষ্টা করে নি কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের দেওয়া রায় মেনে নিতে পারে নি। বাঙালি পাকিস্তানের শাসনভার পাবে। ইস্ট পাকিস্তান শাসন করবে গোটা পাকিস্তানে এটা তারা বরদাস্ত করে নি। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এই বাংলাদেশেই বাস করত। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার মতো ক্ষমতা আমাদের এই ভূ-খণ্ডেরই ছিল। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছিল আমাদের দেশ, যা দিনের পর দিন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শোষণ করেছে। সমস্ত অর্থ সম্পদ পাচার করেছে পশ্চিম পাকিস্তানে। আমাদের পাট, চাসহ অর্থকরী ফসলের সিংহভাগ নিয়ে গড়ে তুলেছিল করাচি, পিত্তি, ইসলামাবাদ আর অপরদিকে অবহেলিত ছিল বাংলাদেশের জনগণ। সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসনিক, পররাষ্ট্র কোনো ক্ষেত্রেই বাঙালির চাকরি পাবার অধিকার ছিল না। আমদানি- রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, ব্যাংক বীমা প্রতিষ্ঠা করা বাঙালিদের কোনো সুযোগই ছিল না। অনুমোদন পেত না। চরম বৈষম্যের শিকার ছিল বাংলাদেশের জনগণ।

এ বৈষম্য আরও প্রকট হলো ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময়। তখন দেখা গেল বাংলাদেশের জনগণের, কৃষক শ্রমিকের মেহনতের টাকা দিয়ে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য যে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে, যে গোলাবারুদ, সামরিক অস্ত্র ক্রয় করা হয়েছে তা শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানেই ব্যবহার করা হতো। পাকিস্তান নামে দুটো দেশ থাকলেও এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের টাকায় অস্ত্রশস্ত্র কেনা হলেও পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষার কোনো সামরিক ব্যবস্থা ছিল না। ১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে দেখা গেল যে পাকিস্তানি শাসকরা কেবল গুরুত্ব দিচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য। ভারত তখন একদিনেই পূর্ব পাকিস্তান দখলে নিতে পারত। কোনো যুদ্ধ সরঞ্জাম, ফাইটার বিমান, ট্যাঙ্ক, তেমন কিছুই ছিল না, অরক্ষিত বাঙালিকে একদিকে অবহেলা করেছে অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সকলের আগে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে যুদ্ধ করার জন্য এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টই সেদিন বীরত্ব দেখিয়েছে। এই অবস্থা দেখেই সেদিন বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের জন্য। বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি তোলার অপরাধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসি দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে সেদিনের পাকিস্তানি শাসকচক্র আইয়ুব খাঁ। পারে নি, কারণ বাংলার মানুষ দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে। পতন হয় আইয়ুব খানের। ক্ষমতায় আসে ইয়াহিয়া নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ড. কিসিঞ্জার একটা কথা বলেছিলেন যে, পাকিস্তানি সরকার জানত না যে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাবে, তাদের ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ গোয়েন্দা সংস্থা সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই তারা নির্বাচনের পর জনতার রায় মানতে চায় নি, অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ হবে পাকিস্তানের শাসনকর্তা— এটা তাদের সহ্য হয় নি। বাঙালির অধিকার সংরক্ষণ করে শাসনতন্ত্র তৈরি হবে তা কিছুতেই মানতে পারে নি বলেই হামলা করেছিল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক, ভোটার কে কোথায় আছে তাদের খতম করতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তাই গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতির নির্দেশ তিনি আগেই দিয়েছিলেন। যুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করি। আজ আমরা কি দেখি?  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। কিন্তু অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালিত হয়, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। কিন্তু পরাজিত শত্রুরা নিষ্ক্রিয় ছিল না।

ষড়যন্ত্রের জাল তারা ছড়াতে থাকে তাদের এদেশীয় দালালদের মাধ্যমে। মিথ্যা অপপ্রচার, কি কি মিথ্যা অপপ্রচার সেদিন তারা ছড়িয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নামে, শেখ কামালের নামে, বেগম মুজিবের নামে-তার একটাও কি প্রমাণ করতে পেরেছে? পারে নি। আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী, এমপিদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। একদিকে যুদ্ধবিধস্ত দেশ গড়তে ব্যস্ত জাতির পিতা অপরদিকে ধ্বংসাত্মক কাজ করে অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেবার চেষ্টা করেছে ষড়যন্ত্রকারীরা, মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শত্রুরা।

 

 (সূত্র: শেখ হাসিনা রচনা সমগ্র-২।। পৃষ্টা:৩০-৩১)



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭