ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে ধ্বংস হয়ে গেল দেশগুলো


প্রকাশ: 04/10/2023


Thumbnail

নিজ দেশের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করাই একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত। কিন্তু আন্তজার্তিক মোড়ল রাষ্ট্রগুলো নিজ স্বার্থ প্রয়োগে এই পররাষ্ট্রনীতিকে তাদের ইচ্ছামতো করে সাজিয়ে ব্যাখা করতে অভ্যস্ত। আর যুক্তরাষ্ট্র তো এ বিষয়ে একদম সিদ্ধহস্ত। এ পর্যন্ত যতগুলো রাষ্ট্রের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ পড়েছে সে দেশগুলোই ধ্বংস হয়ে গেছে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া এ দেশগুলো আজ কেমন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে তা কারো অজানা নয়।

যেভাবে আফগানিস্তানের নাম নিশানা বিনাশ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র:

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে যে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালানো হয়, তাতে প্রায় তিন হাজার মানুষ নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্র এই সন্ত্রাসবাদী হামলার জন্য দায়ী করেছিল জঙ্গি ইসলামী গোষ্ঠী আল কায়েদা এবং এর নেতা ওসামা বিন লাদেনকে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই পরবর্তীতে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে। পৃথিবী হতে জঙ্গীবাদ আর সন্ত্রাস নির্মূলে তারা আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠায়। শুরু হয় আফগানিস্তানের অনন্তকাল ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ। প্রায় দুই দশক ধরে চলা এই যুদ্ধ আফগানিস্তানকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। আফগানিস্তানের এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের জীবন গেছে, লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। বেশিরভাগ আফগানই মনে করতে পারে না তাদের দেশে শেষ কবে শান্তি ছিল। সর্বশেষ তালেবানেরা দেশটির ক্ষমতা দখল করে কফিনের শেষ পেরেকটিও পুতে দিয়েছে।

যদি প্রশ্ন করা হয় যে লক্ষ্য পূরণে আফগানিস্তানের মাটিতে মার্কিনিদের এ যুদ্ধের অবতারণা, তা কি তারা পূরণ করতে পেরেছে? উত্তর হবে, না। এর কিছুই তারা করতে পারেনি। বরং যে তালেবানকে ২০০১ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ বছর ধরে যুদ্ধ চলেছে, সেই তালেবানের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্র আবার সন্ধি করেছে। ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটি। আফগানিস্তান থেকে বিদেশী সৈন্যও প্রত্যাহার করা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে তালেবান সরকার ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে আফগানিস্তানে। তাদের ক্ষমতায় আফগান জনগণ কেমন মানবেতর জীবনযাপন করছে তা আর কারোর অজানা নয়। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে সন্ত্রাস দমন তো দূরে থাক দেশটির নাম অস্তিত্ব বিনাশ করে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ বিদেশী হস্তক্ষেপ।

যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক যুদ্ধ:

সাদ্দাম হোসেনের কাছে ব্যাপক অস্ত্র রয়েছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ ইরাকে বিমান হামলা এবং ২০ মার্চ থেকে স্থল হামলা শুরু করেছিল। ‘‌ওয়ার অন টেরর’‌–এর অধীনে যুক্তরাষ্ট্র তার ম্যান্ডেট থেকে বিচ্যুত হয় এবং তা প্রসারিত করে ইরাকে গণমারণাস্ত্র (ডব্লিউএমডি) তৈরির অজুহাতে তৎকালীন ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ শুরু করে। আমেরিকা বলেছিল ইরাকের হাতে গণহত্যাকারী অস্ত্র রয়েছে। আসলে অস্ত্র ইরাকের হাতে নয়, ছিল আমেরিকার হাতে। আর সেটা ছিল গণ প্রতারণাকারী অস্ত্র। এখন পর্যন্ত সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে করা সেই অভিযোগের কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি মার্কিনিরা। বিধ্বংসী অস্ত্রের যে অভিযোগ তার সন্ধান দিতে পারেনি তারা। ওয়েপন অব মাস মার্ডার বা গণহত্যাকারী অস্ত্র ধ্বংস করার ছলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রশক্তিরা ইরাকে অবৈধ সামরিক অভিযান শুরু করে। কোনোরকম রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুমোদন ছাড়াই এই সামরিক অভিযান শুরু হয়েছিল তারা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই যুদ্ধ শুরু করার ২০ বছর পূর্তি হয়েছে। ৯/১১ সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার কারণে আমেরিকা ইরাকের বিরুদ্ধে যে হামলা চালালো তার পরিণামও অর্থহীনই ছিল বপ্টে শুধু দেশটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাড়া। ইরাক যুদ্ধে সাড়ে চার হাজারের বেশি মার্কিন সেনা আর আনুমানিক এক লাখ বিশ হাজার ইরাকি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। বিশ বছর পার হলেও এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীলতা আসেনি ইরাকে। দেশটি এখনো সংঘাত ও সন্ত্রাসের ক্ষেত্র হিসেবেই চিহ্নিত।

সিরিয়া, এক ধ্বংসস্তুপের নগরী:

২০১১ তে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয় সিরিয়ার দক্ষিণের শহর 'ডেরা'য়। বিক্ষোভ শুরুর অনেক আগে থেকেই কর্মসংস্থানের অভাব, দুর্নীতির মত নানা কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছিল সিরিয়ায়। এই বিক্ষোভকে 'বিদেশী মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ' আখ্যা দেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ। বিক্ষোভ দমন করতে আসাদ সরকারের বাহিনী অভিযান চালায় বিক্ষোভকারীদের ওপর। পরবর্তীতে এই আন্দোলন বিরোধী অভিযান ছড়িয়ে পরলে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের জন্য আন্দোলন শুরু হয় পুরো দেশে।

যেখানে শুরুটা হয়েছিল নিজ দেশের শাসনকাঠামোর বিরুদ্ধে জনগণের, বিশেষত বেকার তরুণদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ থেকে। তারুণ্যের প্রতিবাদ দমাতে খড়গ হাতে তুলে নিয়েছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। সেখানে পরবর্তীতে এতে একে একে আঞ্চলিক শক্তি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক পরাশক্তিরা জড়িয়ে পরায় ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায় দেশটি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় দেখতে চায়নি। আসাদবিরোধী সশস্ত্র মিলিশিয়াদের অস্ত্র ও অর্থ জোগান দিয়েছে পশ্চিমারাই। কুর্দি ও বাশার আল-আসাদবিরোধী সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের (এসডিএফ) সহায়তার জন্য ২০১৪ সাল থেকেই দেশটিতে বিমান হামলা অব্যাহত রাখে যুক্তরাষ্ট্র। প্রাণ যায় লাখ লাখ মানুষের। দেখা দেয় ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকটের। একসময়ের সমৃদ্ধ দেশটি তাই এখন রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ, যুদ্ধের ভারে শ্রান্ত। ২০১১ সালের মধ্য মার্চে দেশটিতে যে সংকটের সূচনা, তার আজও সমাধান হয়নি। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ১২ বছর। দেশটির কি হাল তা কারো অজানা নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একেক সময় একেক ছলে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়েছে। "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" ঘোষণার ছুতোয় যে রাষ্ট্রের উপরই তার ছায়া পড়েছে শেষ হয়ে গেছে দেশটি। কিন্তু সমস্যা উত্তরণ সম্ভব হয়নি। তবুও কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার তাদের এ অভ্যাসগত সমস্যা এখনও চলমান। যুক্তরাষ্টের এ কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের পর রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ফলপ্রসূ আলামত বিশ্ব যেমন আগেও দেখেনি, ভবিষ্যতেও দেখবে কি-না তা নিয়ে আছে নানা দ্বিমত।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭