ইনসাইড বাংলাদেশ

নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্পের বাইরে বাসাবাড়িতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা, স্থানীয়রাও নেই শান্তিতে


প্রকাশ: 07/10/2023


Thumbnail

রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক, সেটা চায় না সন্ত্রাসী গোষ্টী আরসাসহ একাধিক রোহিঙ্গা সংগঠন। তাই প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা শুরু হলেই  উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে বেড়ে যায় হত্যাকাণ্ড বা সন্ত্রাসী তৎপরতা।বিশেষ করে প্রত্যাবাসনের পক্ষে থাকা রোহিঙ্গারা টার্গেটে পরিনত হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত বৃহস্পতিবার  পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৯ টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাম্পের মাঝি বা নেতাদের টার্গেট করছে আক্রমণকারীরা। সেজন্য রোহিঙ্গা নেতাদের অনেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শিবিরের বাইরে নিরাপদ জায়গায় বাসা ভাড়া করে থাকছেন। এ সংখ্যা লক্ষাধিক হবে বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা মাঝি আবদুল হক।সারাদিন তারা স্বপরিবারে ক্যাম্পের ঝপড়ি বাসায় থাকে অন্ধকার নামার আগেই চলে যায় ভাড়া বাসায়।  সন্ধ্যার পরই তান্ডব শুরু হশ সন্ত্রাসীদের।প্রতিটি ক্যাম্পে আরসা আরএসওসহ সন্ত্রাসী সংগঠন সমূহের বেতন ভূক্ত এজেন্ট বা সদস্য রয়েছে। এমন ভয়ংকর তথ্য দিয়েছেন রোহিঙ্গা মাঝি আয়াছ রনি। 

 

স্থানীয়রা জানান, উখিয়ার ক্যাম্পগুলোয় বছর দেড়েক ধরে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে রোহিঙ্গাদের দুই সন্ত্রাসী গ্রুপ আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলো পরিচালনায় প্রশাসনকে সহায়তার জন্য প্রতিটি শিবিরে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা নির্বাচন করা হয়, যাদের বলা হয় মাঝি। তাদের টার্গেট করেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হত্যা মিশনে নেমেছে। তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় অনেক সাধারণ রোহিঙ্গাও প্রাণ হারিয়েছে। দুর্বৃত্তদের গুলিতে গত ৮ মার্চ নিহত হন সৈয়দ হোসেন নামে একজন, যিনি কুতুপালং ক্যাম্প-২ ডব্লিউর মাঝি ছিলেন। তারও কয়েকদিন আগে হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা মাঝি সৈয়দ হোসেন ও মোহাম্মদ সেলিমকে।

 

কক্সবাজারের আশ্রিত শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় থাকা রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাচাইয়ের জন্য গত ১৫ মার্চ মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এসেছিল। তার আগ মুহূর্তে এসব হত্যাকাণ্ড সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করে সাধারণ রোহিঙ্গারা। কেননা তাদের লক্ষ্য ক্যাম্পগুলোয় প্রভাব বিস্তার করে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও অপহরণের মতো কর্মকাণ্ড চালানো। 

 

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ৪ অক্টোবর উখিয়া বালুখালী ৮ ডাব্লিউ ক্যাম্প ও ১৫ নাম্বার জামতলীতে এই জোড়া হত্যার ঘটনা ঘটে। এরা হচ্ছে আরসার কিলিং স্কোয়াডের সদস্য মোঃ ইউচুপ, ও এর কয়েক ঘন্টা আগে আরসার সন্ত্রাসীরা আরফাত নামের এক কিশোরকে চুরিকাঘাত করে হত্যা নিশ্চিত করে চলে যায়।১৫ নাম্বার ক্যাম্পে এর আগে উখিয়ায় আরসা সদস্যদের সঙ্গে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে আব্দুল মজিদ ওরফে লালাইয়া নামে এক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। এপিবিএনের দাবি, নিহত লালাইয়া আরসা কমান্ডার। এ সময় তিনজকে আটক করা হয়েছে।

 

কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোট রোববার ১৩৯ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে গতকাল পর্যন্ত চলতি বছরে সংঘটিত হয়েছে আরো ৪৯ টি হত্যাকাণ্ড। এতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে উদ্বেগ বাড়ছে। রোহিঙ্গা নেতারা এসব ঘটনার জন্য আরসা ও আরএসওকে  দায়ী করছেন। ক্যাম্পগুলোয় দিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকলেও রাতে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তাই নিরাপত্তাহীনতার কারণে মাঝিদের অনেকে এখন শিবিরের বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন। তবে কেউই পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।   

 

মোহাম্মদ রফিক আমিন (ছদ্ম নাম), যিনি একটি শিবিরের হেড মাঝি বা প্রধান নেতার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি জানান, মাস কয়েক আগে তার ওপরও আক্রমণ করেছিল আরসা। সে দফায় প্রাণে বেঁচে যান। পরে শিবিরের বাইরে একটি ভাড়া বাসায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উঠেছেন। রফিক আমিন দাবি করেন, ‘শিবিরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতেই মূলত আরসা একের পর এক হত্যাকাণ্ডসহ নানা রকম সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। ক্যাম্পে যতক্ষণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা থাকে, ততক্ষণ এরা লুকিয়ে থাকে। সরকারি লোকজন ক্যাম্প থেকে চলে যাওয়ার পর আসরার সদস্যরা এসে রোহিঙ্গা নেতাদের খোঁজ করে, সামনে পেলে মারধর করে। এরই মধ্যে তারা আমাদের বেশ কয়েজন মাঝিকে হত্যা করেছে।’

 

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফারুক আহমেদ মনে করেন, রোহিঙ্গা শিবিরে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যেই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে দুষ্কৃতকারীরা। নিজেদের প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের জন্যই তারা এগুলো করছে; যাতে ক্যাম্পে অবাধে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণের মতো কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করতে পারে। এটাই তাদের মূল লক্ষ্য।’

 

রোহিঙ্গাদের নিয়ে অনেকদিন ধরেই কাজ করছেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা মামুন। শিবিরগুলোয় কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, দিন দিনই সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে অস্থিরতা বাড়ছে এবং নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। মামুন বলেন, ‘‌আইন-শৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী এবং এনজিওগুলোর তৎপরতা থাকে। ফলে দিনে পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও সন্ধ্যার পর অন্য রকম একটা পরিবেশ তৈরি হয়।’

 

আয়াস নামে এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, ‘আমাদের শিবিরগুলোয় উগ্রবাদী কিছু লোক সক্রিয়। অন্ধকার নামলেই শুরু হয় তাদের তৎপরতা। যখনই সাধারণ রোহিঙ্গারা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতা করতে চায় বা নিজেরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে, তখনই আরসা আক্রমণ করে। এছাড়া অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী ও অন্য সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোও সাধারণ রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে। ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চরম ব্যর্থতা দিন দিন যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজি নিয়ে যেভাবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো উগ্রবাদী হয়ে উঠছে, তা দমন করতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী গঠনের বিকল্প নেই। আবার রোহিঙ্গারা উগ্রবাদী হয়ে ওঠার পেছনে কোনো ইন্ধন রয়েছে কিনা সেটিও দেখা জরুরি বলে মনে করেন সবচেয়ে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ইউনিয়ন উখিয়ার পালংখালীর চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দীন চৌধুরী। তার দাবী তার ইউনিয়নের লোকসংখ্যা ৫০ হাজার কিন্তু রোহিঙ্গা হচ্ছে ৭ লাখ। তাদের সহিংসতা যেন স্থানীয় কমিউনিটির জন্য বিপদের কারণ হয়ে না ওঠে, তার জন্য এখনই সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন এই ইউপি চেয়ারম্যান। এমনকি তিনি রোহিঙ্গাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকায় তিনি নিজেও চরমভাবে নিরাপত্তাহীন।কারণ তাকে কয়েক দফা মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয়েছে। 

 

পুলিশ কর্মকার্তারা অবশ্য বলছেন, সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর সার্বক্ষণিক টহল এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখাসহ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

 

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ প্রশাসন সবসময় জীবন বাজি রেখে কাজ করছে। সন্ত্রাসীদের অনেককে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ক্যাম্পজুড়ে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতা।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭