ইনসাইড বাংলাদেশ

সহে না মানবতার অবমাননা


প্রকাশ: 08/10/2023


Thumbnail

 

১ অক্টোবর ২০০১। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে জুলাই মাসে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় শান্তিপূর্ণ ভাবে। কিন্তু ১ অক্টোবরের নির্বাচনে ফলাফল ঘোষনার সাথে সাথে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা তান্ডব শুরু করে, শুরু হয় সন্ত্রাস, নারকীয়তার বিভৎস উৎসব। ঐ সময়কার ঘটনা উঠে এসেছে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘সহে না মানবতার অবমাননা’ শীর্ষক লেখায়। পাঠকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে আজ ৮ অক্টোবর লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হলো-

 

মানবাধিকার সংস্থা অধিকার, মিডিয়া মনিটর ডেমোক্রেসি ওয়াচ, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, বিসিডিজেসি, এমএমসি প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে গত এক বছরে মোট হত্যা ও অস্বাভাবিক মৃত্যু ২৩,৭৪০ জন, ধর্ষণ ১৪৭৭, শিশু ধর্ষণ ৭০১, নারী নির্যাতন ৬৪৯১, এসিড নিক্ষেপ, ৪১০, সাংবাদিক নির্যাতন ৪২৫ (নিহত ৩), পুলিশী নির্যাতনে নিহত ১০১।

কেবল সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে সংস্থাগুলো তাদের রিপোর্ট প্রণয়ন করেছে। মোট সংঘটিত ঘটনার এক-তৃতীয়াংশ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। হত্যা, ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।

প্রতিদিনই জাতীয় দৈনিকের অসংখ্য সংবাদ ছাপা হয়। কোথাও খুন, কোথাও ধর্ষণ এবং কোথাও বা নির্মম নির্যাতন। অপরাধীদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা পর্যন্ত নেওয়া হয় না। সরকারের প্রচ্ছন্ন মদদে এসব সহিংস ঘটনা ও পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে। এর কয়েকটি চিত্র নিচে নেওয়া হলো :

১/ মহিমা

রাজশাহী জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম পুঠিয়া । দশম শ্রেণীর ছাত্রী মহিমা খাতুন অভাব-অনটনের সংসারেও অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করত। স্বপ্ন ছিল একদিন বড় হবে। বাবা ও ভাই আওয়ামী লীগের কর্মী ছিল। অক্টোবর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে তারা কাজ করে। আর তাই বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী ক্যাডারদের রোষ ছিল তাদের ওপর। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সন্ত্রাসী উজ্জ্বল ফরিদ, ফারুক ও সেলিম মহিমার ওপর আক্রমণ করে । তাকে অস্ত্রের মুখে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে এবং সেই ধর্ষণের ছবিও তুলে। তারপর তাদের শাসায় যে, এরপরও যদি আওয়ামী লীগের কাজ করে তাহলে গ্রামের ঘরে ঘরে এই ছবি বিলি করা হবে। কিশোরী মহিমা এই অপমান সহ্য করতে না পেরে ১৯ ফেব্রুয়ারি আত্মহত্যা করে। এ ঘটনার খবর পত্রিকায় ছাপা হলে সারা দেশের মানুষ বিশেষভাবে আলোড়িত হয়।

২/ যে পূর্ণিমায় এখন কৃষ্ণপক্ষ

‘ঘর হইতে বাহির হইয়া জ্যোৎস্না ধরতে যাই আমার হাত ভর্তি চাঁদের আলো হাত খুললেই নাই।' ঘর হতে বের হয়ে কবিরা আসে জ্যোৎস্না ধরতে কিন্তু যখন কিছু মানুষ নামের পশুরা আসে তখন জ্যোৎস্না যেন ঝলসানো একখণ্ড রুটি হয়ে যায়। পূর্ণিমা রাণী শীল ১৪-১৫ বছরের এক কিশোরী। চার বোন এবং পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শেষের দিকে তার অবস্থান। এদের পিতা এবং বড় ভাইরা নাপিত এটাই পেশা। পূর্ণিমা উল্লাপাড়া হামিদা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শাখার দশম শ্রেণীর ছাত্রী। উল্লাপাড়ায় দেলুয়া গ্রামে তার বাড়ি। সেই গ্রামেরই বাবলু ডাক্তারের দুই বাচ্চাকে পড়িয়ে সে কিছু টাকা পায় এবং সেই টাকার মধ্যে থেকেও সে নিজের জন্য একজন গৃহশিক্ষক রেখেছে। এভাবে পূর্ণিমা তার সমাজ ব্যবস্থার হাজারো অসুবিধার মধ্যেও নিজের জন্য একটা অবস্থান সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু অসংখ্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতো তার এবং তার পুরো পরিবারের ওপর চেপে বসেছে কতকগুলো মানুষরূপী পশুর অভ নখের হিংস্র থাবা। অক্টোবরের প্রথম দিন অষ্টম জাতীয় সংসদের ভোট গ্রহণ করার সময় পূর্ণিমা তার বাড়ির কাছে দেলুয়া হাইস্কুলের কেন্দ্রে যায়। সেখানে তার গৃহশিক্ষক সাধন পোলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করছিলেন, পূর্ণিমাকে দেখে সে বাসা থেকে খেয়ে আসার জন্য তাকে একটু বসতে বলে। সাধন দুপুরের খাবার খেয়ে ফিরে আসলে পূর্ণিমা বাড়ির দিকে রওনা দেয়। এ সময় কয়েকজন বিএনপি কর্মী ও সমর্থক পূর্ণিমাকে শাসায় ভোটকেন্দ্রে সাময়িক বসার জন্য। যা হোক, নির্বাচনে বিএনপি তথাকথিত চারদলীয় জোট নির্বাচিত হবার পর তাদের ওপর নেমে আসে বিএনপি সন্ত্রাসীদের খড়গহস্ত। তারা বৃদ্ধ অনিল চন্দ্র শীলের কাছে চাঁদা দাবি করে এবং না পেলে মারার হুমকি দেওয়া হয়। অনিল বাবু তাদের কাছে অনেক হাতজোড় করে মিনতি করে বলে, বাবা গরিব মানুষ চাঁদার টাকা কোথায় পাব। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তার কথায় কর্ণপাত করে নি।

৮ অক্টোবর পূর্ণিমা যায় গৃহশিক্ষকতা করতে। ফেরার পথে একই গ্রামের ছেলে এবং বিএনপি কর্মী আলতাফ অশ্লীল ইঙ্গিত করে, আজেবাজে কথা বলে। কিন্তু পূর্ণিমা ভয়ে তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে। পূর্ণিমা রাতে ভাত, তরকারি রান্না করে টিফিন বাটিতে ভরে তার বাবার কাছে দেয় ভাইয়ের খাবার জন্য। ছেলের ভাত নিয়ে তিনি বগুড়া-নগরবাড়ি সড়কের কাছে বিএনপির স্থানীয় অফিসের সামনে এলে ২০-২৫ জন তাকে ঘিরে ধরে। যুবকদের প্রত্যেকের হাতে তখন লাঠি এবং বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ছিল। তাকে ভীষণ প্রহার করার পর রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ছেলে গোপাল বাবাকে এই অবস্থায় দেখে কিছু টাকা বাড়ি থেকে এনে আহত বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পূর্ণিমার মা বাসনা রাণী শীল এমন অবস্থায় পূর্ণিমা এবং ছেলে অর্জুনকে নিয়ে স্বামীর অবস্থা দেখতে রাস্তায় বের হতেই সন্ত্রাসীরা হামলে পড়ে। তারা পূর্ণিমাকে জোর করে নিতে চাইলে তার মা তাতে বাধা দেয়। তখন সন্ত্রাসীরা বাসনা রাণী শীলকে মেরে হাত ভেঙে দেয়। এ অবস্থায় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পূর্ণিমা কিছু না বুঝেই দৌড়ে পালায়। সে পার্শ্ববর্তী ইসমাইল দারোগার কলাবাগানে লুকোয় । এই সময় সন্ত্রাসীরা ফাঁকা বাড়িতে লুটতরাজ চালায়। কিন্তু এত কিছু করার পরও শেষ রক্ষা হয় নি পূর্ণিমার। ছোট্ট একটি কিশোরী শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে রাখতে পারে নি নিজেকে। ইসমাইল পুলিশের স্ত্রীর কাছে পূর্ণিমা অনেক কাকুতি মিনতি করে একটু আশ্রয়ের জন্য। তিনিও তাকে একটু আশ্রয় দেন নি। আমি জানি না সেই মহিলার কোনো কন্যা সন্তান আছে কিনা, তবে না থাকাই ভালো।

এরপর সন্ত্রাসীরা তাকে পূর্ব দেলুয়ার একটি শ্মশানঘাটের পতিত জায়গায় নিয়ে যায়। পূর্ণিমা জানায়, অন্ধকারে সে গলার আওয়াজ ও ধর্ষণের সময় কিছু লোককে চিনতে পারে। সে আসামিরা কিভাবে তাকে বিবস্ত্র করেছে এবং ধর্ষণ করেছে। ওই সময় সে চিৎকার করে কিন্তু সন্ত্রাসীরা তার মুখ চেপে ধরে রাখে। ২ জন ধর্ষণ করার পর শেষের দিকে সাধন, অসীম, আকবর মেম্বার ঘটনার জায়গায় আসে এবং তাকে রক্ষা করে। পূর্ণিমাকে সিরাজগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস হাসপাতালে চেকআপ করানো হয়। তার শারীরিক পরীক্ষায় ধর্ষণের যাবতীয় আলামত পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, পূর্ণিমার মেডিক্যাল রিপোর্ট রেখে এবং রিপোর্টের বয়স দেখে সিরাজগঞ্জের একজন প্রৌঢ় উকিল কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, আমার এত বছরের আইন পেশায় ধর্ষণ মামলা করেছি অনেক ধর্ষিতার মেডিক্যাল রিপোর্টও করেছি। কিন্তু এই রিপোর্টে যে নির্মম পাশবিকতা দেখেছি তারপরও ওই কিশোরী মেয়েটি কোন মানসিক জোরে বেঁচে আছে এটাই আশ্চর্য। উকিল সাহেব আপনি আমার থেকে অনেক বড় তারপরও বলতে হয় এ যে বাংলার সর্বসহা প্রকৃতি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এত ঘটনা ঘটার পর সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপি এম আকবর আলী বক্তব্য দেয় সাংবাদিক সম্মেলন করে। তিনি বলেন, নির্যাতিত হয় নি ধর্ষিতও হয় নি। তিনি বলেন, মেডিক্যাল রিপোর্ট পূর্ণিমার জবানবন্দী কিছুই সত্য নয়। এই বক্তব্য রাখার পর সেখানকার সাধারণ জনগণ অসন্তোষ প্রকাশ করে। কিন্তু একজন জনপ্রতিনিধি, আইনপ্রণেতা কিভাবে বলেন ধর্ষণের ঘটনা ঠিক নয়। কারণ পূর্ণিমার মতো সাহসিকতার পরিচয় দেওয়ার মেয়ের বড়ই অভাব। ধর্ষিত হওয়ার পর সাধারণত লুকিয়ে রাখা হয় অথবা কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে আত্মহত্যা করে। সেই সময় একজন দৃঢ়চেতা কিশোরীর এই সাহসকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেই সাংসদের উচিত ছিল তার পাশে দাঁড়ানো এবং তার দলীয় সন্ত্রাসীদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। অথচ তিনি পূর্ণিমার অভিযোগ সর্বোপরি ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্টকে অস্বীকার করে বলেন, পূর্ণিমা ধর্ষিত হয় নি । কেন এই জনপ্রতিনিধি এই হামলা ও ধর্ষণের ঘটনা উড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে কি তিনিই এ ঘটনার নেপথ্য নায়ক? তা না হলে তিনি পূর্ণিমার মাকে ডেকে কেন মামলা তুলে ফেলার হুমকি দেন। আবার তিনি পূর্ণিমার বাবাকে ২০ হাজার টাকার লোভ দেখান মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য। পূর্ণিমার ব্যাপারটা একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বোঝা যায় এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। আমরা এই ঘটনার সাথে যারা জড়িত প্রতিটি ব্যক্তির আদালতে বিচার হচ্ছে এটা দেখতে চাই। আমরা একজন আইনজ্ঞ, সুকঠিন দৃঢ়চেতা পূর্ণিমা শীলকে দেখতে চাই। যে আর দশটা নির্যাতিত মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাদেরকে আইনি সহায়তা দেবে

৩/ পিতার কোল থেকে কেড়ে নেওয়া হলো শিশু নওশীনকে

আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময় শিশু কন্যার জন্ম হলে নিষ্ঠুরভাবে মেরে মাটির নিচে ফেলা হতো। কিন্তু নবী কারীম (সা)-এর সময় প্রথম শিশু কন্যার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা হলো যার এক পর্যায়ে আমরা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান শরীফে পাই— মায়ের মায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না নারীকে মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিছুদিন আগেও প্রথম সন্তান মেয়ে হলে দাদা-দাদি বা নানা-নানী মনে হয় একটু কষ্ট পেতেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, একটি কন্যা শিশুর আগমনের পর গোটা পরিবারের সবাই আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠছে, ঠিক সেভাবে ১০ মাস মায়ের গর্ভে থাকার পর, বাবা-মা, চাচা-চাচী, ফুফু সবাইকে আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছিল শিশুকন্যা মেরিয়ান ইসলাম নওশীন। তারপর আস্তে আস্তে তার সবার চোখের মণি হয়ে বেড়ে উঠা, কলা খেতে খুব পছন্দ করত নওশীন এবং তার সবচেয়ে বেশি আবদার ছিল ছোট চাচীর কাছে। এক বছরের জন্মদিন পালিত হলো খুব ধুমধামের সাথে। কত খেলনা, কত জামাকাপড়, পুতুল সব স্মৃতির ধুলো জমিয়ে সযত্নে সাজানো ঘরের একটি কোণায়। স্মৃতি বলছি কারণ ওই খেলনা দিয়ে নওশীন আর কোনোদিন খেলতে আসবে না। নির্মমভাবে সন্ত্রাসীদের হাতে পৃথিবীর অন্যতম নিরাপদ স্থান বাবার কোল থেকে চলে যেতে নওশীনকে এই পৃথিবীর যত সুগন্ধী গন্ধ সাথে করে নিয়ে গেছে নওশীন। কৃষ্ণচূড়ার সমস্ত রং নওশীনের রক্তের সাথে মিশে গেছে। তাই তো মনে হয় যখন এই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়েছেন। পরম পিতা তখন কানে আঙ্গুল দেন। কারণ তাহলে তো তাকেই সন্ত্রাসীদের গডফাদার বলা হয়।

দৈনিক সংবাদ, ১০ মে ২০০২

৪/ ফাহিমা ধর্ষণ ও আত্মহত্যা

ঢাকার মিরপুরের টোলারবাগে গত ৩ মার্চ রাতে আত্মহত্যা করে ১৪ বছরের ফাহিমা। আমাদের ভেবে দেখার বিষয় কেন আত্মহত্যা করবে ফাহিমা। সামান্য দোকানদারের মেয়ে ফাহিমাকে তার ভাইয়ের চটপটির দোকানের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার সুমন, নাছির, হালিম আরও অনেকে। তারপর যা হবার তাই হয়েছে প্রকৃতি ধর্ষিত হয়েছে গরুর হাল দিয়ে। যে জমি এখনও ফসলের জন্য উপযুক্ত নয়, যে জমিটি প্রস্তুত হচ্ছিল ফসল হবার জন্য তখনই কতিপয় হায়েনা কর্ষণ করে গেল জমিটিকে। যেন আমাদের চোখে আঙ্গুল তুলে তারা দেখিয়ে দিল তোমরা আমার জন্য উপযুক্ত নও, তোমরা জান না কিভাবে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হয়। ফাহিমা আমরা সবাই তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। কারণ মায়ের আঁচল, বাবার কোল কিছুই তোমাকে ধরে রাখতে পারল না। কিন্তু ফাহিমা তোমার কাছে আমার প্রশ্ন তুমি কেন আত্মহত্যা করলে, তুমি কেন মাথা উঁচু করে যুদ্ধ করলে না ওইসব নরপিশাচদের বিরুদ্ধে। কেন গেলে না তাদের কাছে যারা সেইসব সন্ত্রাসীদের লালন করছে। আমরা আমরণ অনশন করতে থাকতাম তোমার পাশে। এইটুকু মনে হয় আমাদের মেয়ের জন্য আমরা করতে পারতাম। কিন্তু তুমি অভিমানের বশে ছেড়ে গেলে আমাদের, লজ্জিত করে গেলে আমাদের। হয়তো তোমার সব দুঃখ-কষ্ট মাটির নিচে কবর হয়ে গেছে, হয়তো বৃষ্টির ধারা জলে তোমার শরীরের রক্ত ধুয়ে-মুছে গেছে। কিন্তু আমরা যারা প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছি বল তো তাদের রক্ত মুছে দেবে কে?

৫/ পঙ্গু শেফালী রানীকে ধর্ষণ

পুরুষরূপী জানোয়ার না হলে শেফালী রানীর মতো একজন পঙ্গু মহিলার ওপর এ আক্রমণ কেন—সেটা কি তার নৌকায় ভোট দেওয়ার অপরাধ। নাকফুল কেড়ে নেওয়ার নামে তার ওপর যে নির্যাতন চলেছে তার কথা বলতে গেলে কলম থেকে মনে হয় কালি নয় রক্ত আসছে। কিন্তু নাকফুল কেন সধবা বা সম্ভ্রমের প্রতীক হবে। শেফালি রানী খুলে ফেলুন আপনার নাকফুল। ভবদেশের ধনী মানুষদের কাছে আবেদন জানান, আপনার দুটো কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে আর কিছু না থাক পা দিয়ে তো দুটো লাথি মারতে পারবেন নরপশুদের যারা আপনাকে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছে আঘাতে আঘাতে।

৬। তৃষা হত্যাকাণ্ড

স্কুলছাত্রী কিশোরী তৃষার মাত্র ১১ বছর বয়স। নিঃসন্তান চাচার কাছে লালিত পাশেই নিজের বাবা-মা থাকে। সুতরাং আদর ভালোবাসার কোনো অভাব তার ছিল না। কিন্তু কিছু বখাটে তরুণের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে বেছে নিতে হয় মৃত্যুর পথ। কিন্তু সে বাঁচতে চেয়েছিল। নরপশুরা যখন তাকে ধরার জন্য ধাওয়া করে, উপায়ন্তর না দেখে সে লাফ দেয় পুকুরে সাঁতার জানত না সে, তাই সে ওদের কাছেই আকুতি করেছিল তাকে পানি থেকে উঠানোর জন্য। কিন্তু মানুষবেশী সেই শয়তানরা পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছে তার করুণ মৃত্যু এবং হায়েনার হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো গাইবান্ধায় ।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৯ জুলাই ২০০২

৭। বাপ্পী হত্যাকাণ্ড

নয় বছরের ছোট্ট বাপ্পী স্বাভাবিকভাবেই মাকে আশ্রয় করে তার জীবন। এ পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার কিছুদিন আগেও সে মাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিল। 'মা কথাটি ছোট, আরও কিন্তু যেন ভাই, মায়ের চেয়ে বড় এ ভুবনে নাই। কিন্তু সে কি জানত তার ভুবন কত ছোট হয়ে আসছে। ৮ বছরের বাপ্পীকে তারই খালাতো ভাই এবং কিছু বন্ধু-বান্ধব মিলে অপহরণ করে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে। কিন্তু মুক্তিপণের টাকা পাবার আগেই তারা নির্মমভাবে খুন করে বাপ্পীকে এবং ফেলে দেয় শীতলক্ষ্যায়। শীতলক্ষ্যার জল কি পেরেছিল বাপ্পীর ছোট্ট হৃদয়ের সব কষ্টকে ধারণ করতে। সমাজের এই ভয়াবহ চিত্রতো আগে লক্ষ করা যায় নি। হঠাৎ করেই কেন এ অবক্ষয়। সমাজবিদরা হয়তো নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবেন কেন এ সামাজিক অবক্ষয়। কিন্তু তাতে করে কি বাপ্পীকে ফিরিয়ে দিতে পারবে তার মায়ের কোলে। এভাবে যেন কোনো বাপ্পীকে হারিয়ে যেতে না হয় "তার জন্য দরকার সচেতন প্রতিরোধ।

দৈনিক আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০২

 

 (সূত্র: শেখ হাসিনা রচনা সমগ্র-২।। পৃষ্টা:৩৯-৪৪)



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭