ইনসাইড বাংলাদেশ

সরকার পণ্যের দাম বেধে দিলেও ব্যবসায়ীরা তোয়াক্কা করছে না


প্রকাশ: 13/10/2023


Thumbnail


সরকার ব্যবসায়ীদের জন্য কয়েকটি পণ্যের দাম বেধে দিলেও রাজধানীর কাঁচা বাজার গুলোতে সেগুলো বাস্তবায়নের কোন লক্ষণ নেই। সরকারের এই সিদ্ধান্ত তারা মানতে নারাজ।  মাসখানেক আগে সরকারের বেধে দেয়া মূল্য অনুযায়ী প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬৫, আলু ৩৬ এবং প্রতি পিস ডিম ১২ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। তবে ওই ঘোষণার পর এক দিনের জন্য নির্ধারিত দামে এসব পণ্য কিনতে পারেননি ক্রেতারা। উল্টো গত কয়েকদিনে দাম বেড়েছে আরেক দফা।

আজ শুক্রবার বাজারে প্রতি হালি ডিমের দাম ৫ টাকা বেড়ে ৫৫, দেশি পেঁয়াজ কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়ে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর আলু ৫০টাকা বিক্রির কারণে ভোক্তা অধিদপ্তর মেুন্সিগঞ্জ, বগুড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় গুদামে অভিযান চালিয়ে আলুর দাম নির্ধারণ করলেন ৩৬টাকা। কিন্তু কে শোনে কার কথা ব্যবসায়ীরা তাদের অবস্থানে অনঢ়। অভিযান এবং জরিমানা আদায়ের পর সরকারের পক্ষ থেকে আর কোন খবর না নেয়ায় ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমত দাম বাড়িয়ে জরিমানান টাকা অসুল করছে।  

দাম বেঁধে দেওয়া পণ্যের যখন এই অবস্থা, তখন অন্যান্য ক্ষেত্রে তো ভিন্নচিত্র আশাই করা যায় না। কাঁচাবাজারে বেগুন, করলা, ঝিঙা, ধুন্দল, পটোল, কচুর লতি, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চিচিংগার সরবরাহ পর্যাপ্ত। তবে দামের বেলায় বেশি টাকা দিয়েই কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। চলমান পরিস্থিতিতে সব মহলের সমন্বয় ও সহনশীলতা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার এক মতবিনিময় সভা থেকে সিন্ডিকেট বা কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। সভায় ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সব কিছুর আগে দালাল ও চাঁদাবাজি বন্ধের পাশাপাশি পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখার তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা।

ঢাকায় ডিমের পাইকারি ও খুচরা বাজার সূত্রে জানা গেছে, গতকাল প্রতি ১০০ পিস বাদামি ডিম বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২১০ এবং প্রতি ১০০ পিস সাদা ডিম বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১৪০ টাকা, যা পরিবহন খরচ যোগ হয়ে খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে দাম পড়েছে ১ হাজার ২৩০ এবং ১ হাজার ১৬০ টাকা। খুচরা পর্যায়ে প্রতি হালি বিক্রি হয়েছে ৫৫ এবং প্রতি ডজন ১৬০ টাকায়। সাদা ডিমের হালি ৫০ টাকা। ডিমের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে সরকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিলেও এখন পর্যন্ত সেসব ডিম আসেনি।

ডিমের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তেজগাঁওয়ের ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উল্লাহ বলেন, ‘গত সপ্তাহে টানা বৃষ্টিতে ক্ষতির কারণে বাজারে শাকসবজির দাম বেড়েছে। এতে ডিমের চাহিদা বাড়ায় দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে।’

এদিকে দেশি পেঁয়াজের ঘাটতি মেটাতে পর্যাপ্ত আমদানি থাকলেও বাজারে পণ্যটির দাম বাড়ছে। যোগাযোগ করা হলে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি এম হারুন উর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভারত শুল্ক আরোপের পর প্রতি কেজিতে ভারতের দিক থেকে ৭ রুপি এবং বাংলা টাকায় ১০ টাকা খরচ যোগ হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি কেজি আমদানি পেঁয়াজ মানভেদে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পরে দাম কিছুটা বেড়ে ৫৮ থেকে ৬২ টাকা ওঠে। তবে বন্দর এলাকায় আমদানি করা পেঁয়াজের কেজি মানভেদে ৫১ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি পর্যায়ে কোনো জটিলতা নেই।’

জানা গেছে, বন্দর থেকে ঢাকা বা অন্য মোকামে পৌঁছাতে প্রতি কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা পরিবহন খরচ পড়ে। এ হিসাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতি কেজি আমদানি পেঁয়াজের দাম ৫৪ থেকে ৫৯ টাকা হওয়ার কথা।

শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতির সভাপতি হাজি মো. সাঈদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পাইকারি আমদানি খরচ কিছুটা বেড়েছে। সে হিসেবে বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়েনি। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ এবং আমদানি পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬২ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরা কেন বেশি দামে বিক্রি করছেন, সেটি তারাই বলতে পারবেন।’

কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ালেও প্রশাসন তাদের কাছে যাচ্ছে না। সে কারণে বাড়তি দামে পণ্য কিনে খুচরা ব্যবসায়ীদের জরিমানায় পড়তে হচ্ছে। তাদের দাবি, বড় ব্যবসায়ীরা রসিদ ছাড়াই চুক্তিতে পণ্য বিক্রি করছেন।

সরকারি ও খাত-সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, এ বছর চাহিদার তুলনায় বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে সাড়ে ১০ থেকে ১১ টাকা। ব্যাপারীদের কাছে কৃষক প্রতি কেজি আলু বিক্রি করেছেন ১৪ থেকে ১৫ টাকা দরে। ব্যাপারী বা বড় ব্যবসায়ীরা হিমাগার ভাড়া বা রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ প্রতি কেজিতে ৬ টাকা পর্যন্ত খরচ করছেন। সেই হিসাবে প্রতি কেজি আলুর মূল্য ২০ টাকা। যা হিমাগার থেকে ২৬ থেকে ২৭ টাকা খালাস করা সম্ভব এবং খুচরা পর্যায়ে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। আর এ বিবেচনায় সরকার প্রতি কেজি আলুর পাইকারি মূল্য ২৭ এবং খুচরা মূল্য ৩৬ টাকা বেঁধে দেয়। কিন্তু হিমাগারেই প্রতি কেজি আলু ৩৬ থেকে ৩৮ এবং পাইকারিতে ৪০ বা তারও বেশি এবং খুচরা পর্যায়ে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেছেন, ‘টিসিবির মাধ্যমে উৎপাদনের উদ্বৃত্ত আলুর ন্যূনতম ১০ লাখ টন বাজারমূল্যে ক্রয় করে জেলা, উপজেলার হিমাগারে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। যা দাম বৃদ্ধির সময় সরবরাহ করলে আলুর দর স্বাভাবিক বা স্থিতিশীল থাকবে।’

সরকারের নির্ধারিত দামের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘সরকার আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম নির্ধারণের পর থেকে তা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ১৫ কোটি ডিম আমদানির কার্যক্রম চলমান। আমদানি ডিম বাজারে এলে হয়তো একটা চাপ তৈরি হতো। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে বছরের এ সময়ে ঘাটতি দেখা দেয়। যেজন্য আমদানির অনুমতি রয়েছে। সেক্ষেত্রে বাজার তদারকি চলমান। আলুর ক্ষেত্রে দাম নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে স্থানীয় সরবরাহ ব্যবস্থায় তদারকি করা হচ্ছে। সেখান থেকে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে যেভাবে আশা করা হচ্ছে, তেমনটা হচ্ছে না।’

অনেক ব্যবসায়ী নেতা ও বাজার বিশ্লেষক বলছেন, টিসিবি বা সরকারের সামাজিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নির্ধারিত দামে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ানো গেলে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব বলেন, প্রতি মাসে টিসিবির মাধ্যমে সরবরাহ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনের তুলনায় সেটিও কম। তবে সরকার চেষ্টা করছে আওতা বাড়ানোর জন্য। ইতোমধ্যে টিসিবির কার্যক্রমে সরবরাহ বাড়ানোর জন্য অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

নিত্যপণ্যের বাজার বিশ্লেষক কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে দাম বেঁধে দিলে সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার তেমন কোনো উন্নতি করতে পারেনি।’

তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন, ‘ধরুন, কোনো একজনকে বিমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হলো। কিন্তু তার কোনো টিকিট নেই। কিন্তু অফিসের নির্দেশে স্পষ্ট বলা আছে, তাকে বিমানে চট্টগ্রামে যেতে হবে। এখন কী হবে? আমাদের নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, যার টাকা আছে সে খাবে! যার টাকা নেই খাবে না! এ অবস্থায় ভোক্তাদের ভরসা সরকার। সরকার যদি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে, তাহলে ভোক্তারা ভালো থাকবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের অতিমাত্রায় বল প্রয়োগ করলে তারা সংশ্লিষ্ট পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দিতে পারে। এজন্য সব মহলের সমন্বয় ও সহনশীলতা থাকতে হবে।’

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭