ইনসাইড থট

কুমির চাষ: আলোচনা ও সমালোচনা


প্রকাশ: 17/10/2023


Thumbnail

এ জনপদে কুমিরের অবস্থান আছে সেই প্রাগঐতিহাসিক যুগ থেকে। কুমির নিয়ে গল্প আছে, প্রবাদ আছে, ছেলে ভুলানো ছড়া আছে। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে কুমিরের উপস্থিতি আছে। প্রবাদ আছে। একটা উল্লেখযোগ্য প্রবাদ হচ্ছে- খাল কেটে কুমির আনা। অর্থ্যাৎ শত্রুকে আমন্ত্রণ করে কাছে আনয়ন করা। আসলেই কুমির কি শত্রু বা কোন ক্ষতিকর প্রাণি? সেই কুমিরের চাষ করার উদ্যোগ কেন? সরকার কতৃর্ক জারীকৃত কুমিরের চাষের বিধিমালা আছে। প্রকৃতিতে বিশেষ করে সুন্দরবনের নদ-নদীতে নোনা পানির কুমির আছে। পদ্মা নদীতে কুমিরের একটি প্রজাতি ঘড়িয়াল বিপন্ন অবস্থায় আছে। মিঠা পানির কুমিরের অবস্থায়ও প্রায় একই। এ দেশে ২০০৪ সালে সর্বপ্রথম ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় কুমির চাষের একটি খামার বাস্তবায়ন শুরু হয়। আকিজ গ্রুপ নামের শিল্প গোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনায় দ্বিতীয় কুমির চাষের খামার তৈরী হয়েছে বান্দরবন জেলার নাইখংছড়িতে। তাছাড়া বন অধিদপ্তরের আওতায় সুন্দরবনের করমজলে একটি কুমির প্রজনন কেন্দ্র আছে।

ভালুকায় প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম কুমিরের খামার ঋণ খেলাপী হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ঋণ দাতা প্রতিষ্ঠান খামারটি নীলামে বিক্রয়ের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সে প্রেক্ষিতে এটি ক্রয় করার জন্য উদ্দীপন নামের এনজিও দরপত্র দাখিল করে এবং সর্বোচ্চ দরদাতা হয়। এর পরপরই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উদ্দীপন কতৃর্ক কুমির খামার ক্রয়ের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। উদ্দীপনের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকায় আমিও অনেক ফোন কল পেয়েছি। সকলের বক্তব্য একই। উদ্দীপন কেন কুমিরের খামার কিনবে? একটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের কুমির খামার পরিচালনার যৌক্তিকতা কি? প্রয়োজনই বা কি? ইত্যাদি।

আমাদের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে- সকল এনজিও ক্ষুদ্র ঋণ ও উদ্যোক্তা প্রদান করবে। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ হবে। শুধু দারিদ্র দূরীকরণই হবেনা, দারিদ্র জাদুঘরে চলে যাবে ইত্যাদি অনেক কথা শুনছি বহু বছর ধরে। মনে হয় ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র সংশ্লিষ্ট সর্বরোগের মহৌষধ। দারিদ্র একটি অবস্থা যার সাথে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রকৃতি, ইকোসিস্টেম, পরিবেশ, উৎপাদনশীলতা, প্রযুক্তি, উৎপাদিত পণ্যের বিপনন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা- অনেক নিয়ামক জড়িত। শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র বিমোচন ঘটায়না। দরিদ্র বলে পরিচিত প্রান্তিক পর্যায়ের বেশির মানুষের জীবন ও জীবিকা কৃষির বিভিন্ন সেক্টরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। আর এখানেই কুমিরসহ জীববৈচিত্রের একটা দৃশ্যমান অবদান আছে।

যে কোন দেশের জীববৈচিত্র সে দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন ইকোসিস্টেম সংরক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। জীববৈচিত্রের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে ইকোসিস্টেম ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং সেখানকার উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। পৃথিবী থেকে শুধুমাত্র মৌমাছি বিলুপ্ত হলে যথাযথ পরাগায়নের অভাবে ফসল, ফল, শস্য ইত্যাদি উৎপাদন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। এ কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ এবং রোগে কোটি কোটি মানুষ ও প্রাণীর মৃত্যু হবে। ফসল খেয়ে ফেলে বলে চীন ১৯৫৮ সালে দেড় কোটির বেশি চড়-ই মেরে চড়-ই মারা বিপ্লব সংগঠিত করে। সর্বোচ্চ ২০ হাজার চড়–ই নিধনকারীকে জাতীয় পুরষ্কার দেওয়া হয়। ফলশ্রম্নতিতে শস্য ক্ষেতে পোকার আক্রমণে ফসল উৎপাদন হ্রাস পায় এবং এ কারণে চীনে ১৯৬২ পর্যন্ত সময়কালে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে প্রায় ৫ কোটি লোক মারা যায়।

যে অঞ্চলে যে শ্রেণীর উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীব আছে, তা সংরক্ষণ না করলে বা নষ্ট হলে যেমন ইকোসিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তেমনি অন্য অঞ্চলের কোন উদ্ভিদ, প্রাণী বা অনুজীব নতুন কোন অঞ্চলে আনা হলে তা পরবর্তীতে ইকোসিস্টেমকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। যেমন সৌন্দয্যের কারণে ব্রাজিল থেকে এ অঞ্চলে আমদানী করা কচুরীপানা একটি ক্ষতিকর আগাছা। আফ্রিকার রাক্ষসী মাগুর মাছও অনরুপভাবে ক্ষতিকর মাছ হিসাবে তা চাষ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিকার করার শখ মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে নেয়া শুকর এবং খরগোস এখন অস্ট্রেলিয়ার গলার কাঁটা। ফিজি দ্বীপে ও অস্ট্রেলিয়ায় শালিক নিয়ে যাওয়ার পরিণতিও একই।

কুমির এ অঞ্চলের একটি অতি পরিচিত প্রাণী। এর ৩টি প্রজাতির বসবাস এ অঞ্চলে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। এগুলো হচ্ছে মিঠা পানির কুমির, নোনা পানির কুমির ও ঘড়িয়াল। প্রকৃতিতে ঘড়িয়াল এখন প্রায় নেই। কুমিরের অবস্থাও ভালো নয়। অথচ প্রকৃতিতে কুমিরের টিকে থাকার ক্ষমতা প্রায় অলৌকিক। বিজ্ঞানীদের মতামত হচ্ছে কোটি কোটি বছর আগে ডাঙ্গায় যেমন ডাইনেসরের রাজত্ব ছিল। পানিতে কুমিরের রাজত্বও ছিল তখন থেকেই। প্রাকৃতিক কারণে ডাইনোসর হারিয়ে গেলেও কুমির টিকে আছে তখন থেকেই। নিজের অবয়ব ও বৈশিষ্ট অক্ষুন্ন রেখে পরিবর্তনশীল ইকোসিস্টেমে টিকে থাকার ক্ষমতা কুমিরের বিষ্ময়কর। বিজ্ঞানীদের ধারণা গত ৩ কোটি বছরে কুমিরের অবয়ব ও বৈশিষ্টের খুব সামন্যই পরিবর্তন ঘটেছে।

এ দেশের প্রকৃতিতে সুন্দরবন নোনা পানির কুমিরের আবাস ও আবাসস্থল। যদিও তা পর্যাপ্ত নয়। আবাসস্থল নষ্ট হওয়া এবং অন্যান্য মানুষ সৃষ্ট কারণে ঘড়িয়াল প্রায় নেই, মিঠা পানির কুমিরের অবস্থাও প্রায় তাই। বন অধিদপ্তর সুন্দরবনের করমজল কেন্দ্রে নোনা পানির কিছু কুমির প্রজনন করাচ্ছে এবং সুন্দরবনে ছাড়ছে। প্রকৃতিতে যে পরিমাণ কুমির থাকা উচিৎ, সে পরিমাণ কুমির দেশের প্রকৃতিতে নেই। কাজেই, সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে কুমিরের চাষ করে প্রকৃতিতে কুমিরের ভারসাম্য আনয়নের সুযোগ আছে। নোনা-পানির কুমির চাষের সুবিধা হচ্ছে, এর চামড়া, মাংস ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি। তাছাড়া প্রকৃতিতে সুন্দরবন অঞ্চলে আরও নোনা পানির কুমির ছাড়ার সুযোগ আছে।

কুমির হচ্ছে শকুনের ন্যায় প্রকৃতির ঝাড়–দার। প্রকৃতিতে বিশেষ করে পানিতে থাকা কোন মৃত প্রাণির সম্পূর্ণ অংশ কুমির খেয়ে ফেলে জলজ ইকোসিস্টেম পরিচ্ছন্ন রাখে। কুমির জলজ প্রাণিদের মধ্যে সবচেয়ে উপরের স্তরের শিকারী বা খাদক। কাজেই, কুমিরের কারণে কোন রাক্ষসী মাছ অন্য মাছ খেয়ে নিজেদের বংশবৃদ্ধি করতে পারেনা। জীব বৈচিত্রের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। রাক্ষসী প্রজাতির মাছ বা জলজ প্রাণী তাদের একক প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনা। ফলে জলজ ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র সংরক্ষিত হয় এবং সেখানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি হয়। কুমিরের পাচক প্রক্রিয়া অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ায় কোন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা কোন অনুজীব কুমিরকে আক্রান্ত করতে পারেনা। বরং কুমির ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস আক্রান্ত মাছ বা অন্যান্য প্রাণী ভক্ষণ করে জলজ ইকোসিস্টেম জীবানুমক্ত রাখে। মানুষ বা স্থলের কোন রাক্ষসী প্রাণি দ্বারা যাতে জলজ প্রাণী বা মাছ শিকারের ব্যাপকতা না ঘটে, কুমির সেখানে মাছ ও জলজ প্রাণের রক্ষক বা গার্ড হিসাবে কাজ করে।

কুমির পাখির ন্যায় প্রকৃতির ব্যারোমিটার। এলাকার বায়ু ও প্রকৃতি দূষণ ঘটলে পাখি যেমন থাকেনা। তেমনি সার, কীট নাশক ও অন্যান্য রাসায়নকিযুক্ত দুষণ থাকলে কুমির আবাস্থল পাল্টায়। নোনা পানির কুমির চাষ করে যেমন এ দেশে সুন্দরবন অঞ্চলের প্রকৃতিতে কুমিরের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়। তেমনি কুমিরের চামড়া, মাংস ও অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রপ্তাণী করে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করা যায়। ঘড়িয়াল চাষ এবং প্রকৃতিতে ছেড়ে দিয়ে জলজ ইকোসিস্টেম ও জীব বৈচিত্র সংরক্ষণে অবদান রাখার সুযোগ আছে। কুমিরের মল পানিতে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণের খাবার ও পুষ্টির উৎস তৈরীতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়াও কুমির এবং অন্যান্য রেপটাইলস সম্পর্কে মানুষের বিশেষ করে ছাত্র/ছাত্রীদের জ্ঞাণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কুমির চাষের খামার ভালো কাজ করে। প্রকৃতির ঝাড়-দার ও জলজ প্রাণের রক্ষক হিসাবে কুমিরের বংশবৃদ্ধি, আবাসস্থল ও অন্যান্য জীবন প্রণালী সম্পর্কে পরবর্তী প্রজন্মের ধারণা থাকা প্রয়োজন। কুমিরের খামার প্রচুর পর্যটক আকর্ষণ করে। মানুষের কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধির জন্য পর্যটন আবশ্যক। সে ক্ষেত্রে কুমির চাষ একটি ভালো পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র। কুমির চাষের খামার কুমির সম্পর্কে গবেষণা করতে আগ্রহী গবেষকদের তথ্য প্রদানের সূত্র হতে পারে।

উদ্দীপন শুধু একটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান নয়। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণ ও উদ্যোক্তা ঋণ প্রদান ছাড়াও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, জীববৈচিত্র ও ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ, জৈব সারের প্রচলন, সমন্বিত বালাই নাশক ও প্রযুক্তির ব্যবহার প্রভৃত্তি বিষয়ে কাজ করার জন্য উদ্দীপনের একটি দায়বদ্ধতা আছে। শুধুমাত্র ক্ষুদ্র ঋণ ও উদ্যোক্তা ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচেন ঘটবেনা এবং দারিদ্র জাদুঘরে যাবেনা। এ বিষয়টি আমরা যত বেশি বুঝতে পারবো, তত দ্রুতই এদেশ থেকে দারিদ্র নিমূর্ল হবে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭