প্রকাশ: 23/10/2023
চলছে শারদীয় দুর্গোৎসব।উৎসব কে ঘিরে খুশীর আমেজ বয়ে যায় চারিদিকে। আমাদের দেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। আর তারই প্রতিফলন হয় বিভিন্ন নাটক-সিনেমায়। বাংলায় একটি কথা আছে যে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ, অর্থাৎ সবসময় এদেশের সংস্কৃতিতে কোন না কোন উৎসব বা দিবস প্রতিপালিত হতেই থাকে।
তবে এসবের মধ্যে
সকলের প্রিয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা বহু বছর যাবৎ বাঙালিদের জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
ভূমিকা পালন করে আসছে। দুর্গাপূজা আসা মানেই হচ্ছে সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অধীর আগ্রহে
বসে থাকা উৎসব। সারাবছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করার পর তাদের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব হয়ে
আসে দুর্গাপূজা। হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও বাঙালির জীবনে শরৎকালের গুরুত্বপূর্ণ
আবেদনও এটি। বাঙালিদের মনে দুর্গাপূজা আসে সব দুঃখ হরণ করে আনন্দের, উৎসবের বার্তা
নিয়ে। এসময় কাশ ফুলে ভরে যায় নদীর দুই পাড়। কৃষ্ণচূড়া ফুল চারদিকে সুবাস ছড়ায়।
ঢোল আতশবাজির নানা রঙে চারদিক উজ্জ্বল আলোয় ভরে যায়, যা সকলের মনকে প্রফুল্ল করে।
শুধু যে দেবী দর্শনের মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ তেমনটি নয়, বরং আধুনিক এই বাঙালির সংস্কৃতিতে
এর প্রভাব সুদূরপ্রসারি। আর তাই বাংলাদেশ ও কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্রেও বিভিন্নভাবে
ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দুর্গাপূজার বিভিন্ন দিক।
বাংলাদেশের
চলচ্চিত্রে দুর্গাপূজা কিংবা পূজার উৎসব নিয়ে সিনেমা তৈরীর সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু
এই অল্প সংখ্যক সিনেমার মধ্যেই কিছু সিনেমা তৈরি হয়েছে যা উচ্চ থেকে নিম্ন সকল বর্ণের
দর্শকদের হৃদয়ে দাগ কেটে দেয়ার মত। আজকের এই পর্বে জানবো তেমনি কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্রের
নাম:
১. তিতাস একটি
নদীর নাম: ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত সিনেমাটি ১৯৭৩ সালের ২৭ জুলাই মাসে বাংলাদেশে এবং ১৯৯১
সালে ভারতে মুক্তি পায়। সিনেমাটির কাহিনী গড়ে উঠেছে নদীর তীরবাসী কিছু মানুষের সুখ-দুঃখ,
উথথান-পতনের এর উপর ভিত্তি করে। যে সিনেমাতে সদ্য মা হারানো ছেলে অনন্তের কাছে দেবী
দুর্গা হয়ে ফিরে আসেন তার মা।
২. বিরাজ বউ:
১৯৮৮ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে মহিউদ্দিন ফারুক এই সিনেমাটি
নির্মাণ করেন। সিনেমাটির বিভিন্ন দৃশ্যের প্রয়োজনে দুর্গাপূজার বিভিন্ন বিষয় আকর্ষণীয়
রুপে ফুটে উঠে। এতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন ফারুক, ববিতা, সুবর্না শিরিন, রেহানা
জলি ও রাজিবসহ অনেকেই। সিনেমাটিতে অভিনয় করে সহ-অভিনেত্রী ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার
পান সুবর্না শিরিন।
৩. পদ্মা নদীর
মাঝি: ‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ কুবের কে বলা কপিলার এই উক্তি এযাবতকালের জনপ্রিয় উক্তিগুলোর
একটি, যা কিনা নেয়া হয়েছে গৌতম ঘোষ পরিচালিত 'পদ্মা নদীর মাঝি' সিনেমা থেকে। সিনেমাটির
গল্প নেয়া হয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একই নামের উপন্যাস থেকে। সিনেমাটির একটি অংশে ঝড়ের বিধ্বংসী রূপ দেখা যায়।
ঝড়ে মাঝি পাড়ার ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে। জেলে পাড়ার বাসিন্দারা সম্মিলিত উদ্যোগে যখন সেইসব
ভাঙ্গা ঘরবাড়ি ঠিক করতে ব্যস্ত ঠিক তখনই মহোৎসবের স্নানে এক ছায়া হয়ে আসে দুর্গাপূজা।
সিনেমাটিতে কুবের ও কপিলা চরিত্রে ছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ ও রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। এছাড়াও
চম্পা, উৎপল দত্ত ও হুমায়ুন ফরিদীও বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
৪. চিত্রা নদীর
পাড়ে: তানভীর মোকাম্মেলের পরিচালনায় ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাগের পরপরের ঘটনাকে কেন্দ্র
করে, দেশ বিভাগের সাথে সাথে তৎকালীন পাকিস্তান থেকে হিন্দুদের(নিজ দেশ হওয়া সত্ত্বেও)
দেশ ত্যাগকে পটভুমি করেই নির্মিত হয়েছে এই চলচ্চিত্র। এছাড়াও সেসময়কার অস্থিতিশীলতা
ও অরাজকতা সহ সকল অসঙ্গতি তুলেধরা হয়েছে এই সিনেমাটিতে। সিনেমাটিতে দুর্গাপূজার পরিস্থিতি
ধরা দিয়েছে একটি প্রতীকী দৃশ্যের মধ্য দিয়ে। যেখানে নদীতে ভেসে থাকা ধর্ষিতা বাসন্তী
যেন অসুর শক্তির জয় আর সত্য সুন্দরের পরাজয়ের প্রতীক হয়ে ধরা দেয় সমাজে। এটি ১৯৯৯ সালে
মুক্তি পায় যেখানে মমতাজউদ্দিন আহমেদ, আফসানা মিমি, তৌকির আহমেদ, রওশন জামিল সহ আরও
অনেকেই অভিনয় করেছেন।
এগুলো ছাড়াও গোলাম সোহরাব দোদুলের ‘সাপলুডু’, বাদল খন্দকারের ‘বিদ্রোহী পদ্মা’, গাজী জাহাঙ্গীরের ‘জীবন সীমান্তে’, বাবুল চৌধুরীর ‘মা’ ছবিতে গল্পের প্রয়োজনে এসেছে দুর্গাপূজার দৃশ্য।
এতো গেলো বাংলাদেশের
প্রেক্ষাপটে নির্মিত চলচ্চিত্রের কথা। আমরা যদি কলকাতার বাংলা সিনেমার দিকে তাকাই তাহলে
দুর্গাপূজার কাহিনী সংবলিত অসংখ্য সিনেমা দেখতে
পাই। যদিও সবগুলো সিনেমাই দর্শকহৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারেনি তথাপি এমন কিছু সিনেমা
নির্মিত হয়েছে যেগুলো দেখে দর্শকরা রীতিমতো চোখের জলও ফেলেছে। চলুন এক নজরে জেনে নেয়া
যাক এমন কয়েকটি সিনেমার কথা:
১. পথের পাঁচালী:
সিনেমাটির নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। যিনি কিনা এই সিনেমা উপহার দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিতে
বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন সহজেই। এই সিনেমা কে উপমহাদেশের সেরা সিনেমাগুলোর একটি
ধরা হয়ে থাকে। এটিতেও পরিচালক সত্যজিৎ রায় বাঙালি দুর্গাপূজা উৎসবের বিভিন্ন দিক ফুটিয়ে
তুলেছেন। তার মাধ্যমেই কলকাতার বাংলা ছবিতে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজার চিত্রায়ণ করা হয়।
যেখানে দেখা যায় ঢাকের তালে অপু, দুর্গাসহ
শিশুদের একটি দল মন্দিরের দিকে যাচ্ছে প্রসাদের আশায়, আর তা চেয়ে দেখছেন মা সর্বজয়া।
এতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন:
সত্যজিৎ রায় এরকম আরও অসংখ্য সিনেমায় দুর্গা কিংবা দুর্গাপূজার বিভিন্ন দৃশ্য পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তার তৈরি ফেলুদা সিরিজের ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ এর শুরুর দৃশ্যায়ন হয় দুর্গাপূজা নিয়েই, এছাড়াও তার নির্মিত দেবী চলচ্চিত্রে গল্পের প্রয়োজনে পূজার বিভিন্ন দৃশ্য দেখা যায়।
২. হীরের আংটি:
ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রথম সিনেমা এটি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে ১৯৯২ সালে
এই সিনেমা তৈরি করেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ।
বন্ধুরা তো
জানোই পুজো এসে গেছে। আকাশে মন ঝিলমিল করা শরতের সোনা রোদ্দুর। তোমাদের মধ্যে কারা
কারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজ পাঠ’ বইটা পড়েছ বলো দেখি? সেই যে সহজ পাঠে
বলা আছে না!
“ছুটির দিনে কেমন সুরে
পূজার সানাই
বাজায় দূরে
তিনটে শালিক
ঝগড়া করে
রান্নাঘরের
চালে!!”
এমনি এক পূজার
ছুটির দিনে পূজার সানাইয়ের গল্প দিয়ে শুরু হয় গেনুদা’র
সঙ্গে হাবুল আর তিন্নির গ্রামের বাড়িতে মজাদার দুপুর। গেনুদা কিন্তু শুধুই গেনুদা নন,
তিনি হলেন গিয়ে খাস “রামদুলালের নাতি” এবং রাজপুত্র গন্ধর্বনারায়ণ; তাঁর ঘোড়া
আছে, সৈন্য সামন্ত আছে, রাজ্যপাট আছে, রাজ্যের শত্রু আছে আর আছে এক কমল হীরের বিশাল
দামী আংটি। এমন কথোপকথন দিয়েই শুরু হয় সিনেমাটি। সেই সিনেমায় গন্ধর্বকুমারের চরিত্রে
অভিনয় করেছিলেন দাদার কীর্তি খ্যাত অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। এতে তার অভিনয় নজর কেড়েছিল
সকলের। এছাড়াও মুনমুন সেন, বসন্ত চৌধুরী, বরুন চন্দ্র কিংবা দুলাল লাহিড়ীর অভিনয়ও ছিল
প্রশংসিত। এটার বাইরে ঋতুপর্ণ ঘোষের অন্দরমহল সিনেমাতেও দুর্গাপূজার দৃশ্য চক্ষুগোচর
হয়।
৩. পরমা: পরিচালক
অপর্ণা সেনের পরিচালনায় ‘পরমা’ সিনেমাতে রাখী গুলজারের দেবী দুর্গাকে
সিঁদুর পড়ানোর দৃশ্য বাঙালি সমাজে এখনও আইকনিক হয়ে আছে। এতে অভিনয় করেছেন রাখী, অপর্ণা
সেন, অনীল চ্যাটার্জি, দীপঙ্কর দে। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৮৫ সালে।
৪. দেবীপক্ষ:
‘দেবীপক্ষ’ সিনেমায় পরিচালক রাজা সেন দুর্গাপূজাকে উপস্থাপন করেন প্রতিবাদের
ভাষা রূপে।
৫. উমা: এছাড়াও,
দুর্গাপূজা এসেছিল সৃজিত মুখ্যার্জীর বিকল্প ধারা সিনেমা উমাতে। যেখানে দেখা যায় বিদেশে
থাকা অসুস্থ মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে কলকাতায় নকল দুর্গাপূজার আয়োজন করেন বাবা।
৬. বেলাশেষে:
বিজয়া দশমীর সাদা থান লাল শাড়ি পরে বাঙালি নারীদের সিঁদুরখেলার চিরাচরিত ঐতিহ্য তুলে
ধরার মাধ্যমে শিবু-নন্দিতার ‘বেলাশেষে’ সিনেমায় পূজা কে তুলে ধরা হয়েছে পারিবারিক
সম্প্রীতির বন্ধন রুপে।
৭. পরাণ যায়
জ্বলিয়া রে: আধুনিক সিনেমার বর্তমানের সময়ের জনপ্রিয় গান ‘ঢাকের তালে কোমর দোলে, খুশিতে
নাচে মন'। রবি কিনাগী পরিচালিত দেব অভিনীত
‘পরান যায় জ্বলিয়া রে’ সিনেমায় দুর্গাপূজা উপলক্ষে এই গান ব্যাপক
জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, এমন গান ছাড়া যেন দুর্গাপূজা আজকাল জমে উঠে না। তারপর থেকে পূজায়
দেবের সিনেমা মুক্তি পাওয়া মানেই পূজার গান থাকবে।
৮. দুর্গেশগড়ের
গুপ্তধন: সাম্প্রতিক সময়ে সাড়াজাগানো ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’
এ এসেছে এক বনেদী বাড়ির দুর্গাপূজা সঙ্গে গুপ্তধনের খোঁজ, দুই মিলিয়ে সিনেমাটি হয়ে
উঠেছিল জমজমাট।
৯. বিসর্জন: এছাড়াও কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘বিসর্জন’
সিনেমাতেও আছে দুর্গাপূজার গল্প, আছে বিসর্জনের আবহ। আর এই সিনেমাতে পদ্মা চরিত্রে
অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন বাংলাদেশি অভিনেত্রী জয়া আহসান।
১০. অসুর:
‘শরতে নয়, শীতে’ এই শিরোনাম নিয়ে পর্দায় আসে জিত অভিনীত
‘অসুর’ সিনেমাটি। যেই সিনেমাতেও দেখা মিলেছে সেই দুর্গাপূজার। শুধু
এই চলচ্চিত্রগুলোতেই যে দুর্গাপূজা এসেছে তা নয়। গল্পের প্রয়োজনে অনেক সিনেমাতেও দুর্গাপূজা
চিত্রায়ণ দেখা যায়।
প্রচুর গরমে
যখন সবাই উত্তপ্ত, সেই মুহূর্তে এক পশলা বৃষ্টি যেমন সবার মনে শীতলতা এনে দেয়; ঠিক
সেইরকমই শীতলতা এনে দেয় এরকম উৎসব গুলো। উৎসবের
দুটি দিক থাকে: একটি ব্যক্তির, আর অন্যটি সমষ্টির। দুর্গাপূজায় মূলত আমাদের সার্বিকভাবে
চোখে পড়ে সমষ্টির সমাবেশ। কিন্তু ব্যক্তি মানুষ সাড়া না দিলে সমষ্টির উৎসব ম্লান
হয়ে যায়। তাই ব্যক্তির গুরুত্ব এখানে সর্বাধিক। ব্যক্তিগত জীবনে কেউ হিন্দু, কেউ
মুসলিম, কেউ শিখ, কেউ বা ধর্মে বিশ্বাসী নয়; আবার কেউ ধনী, কেউ বা দরিদ্র- এই সকল
প্রকার ভেদাভেদ দূরে সরিয়ে সবাই মিলেমিশে পরম আনন্দে আমরা এই উৎসবে মেতে উঠি। আর এই
বিষয়গুলোই চিত্রায়ন করা হয় এসব সিনেমা কিংবা নাটকে অথবা পর্দায় ফুটিয়ে তোলা কোন চরিত্রে।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭