কালার ইনসাইড

শিল্পী জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম কলিম শরাফী


প্রকাশ: 02/11/2023


Thumbnail

কলিম শরাফী। নামটি এ দেশের সংগীত প্রিয় মানুষের কাছে একটি প্রিয় নাম। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত জগতেতিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মুখ। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, সংগীত পরিচালনা, তথ্যচিত্র নির্মাণ,  উদীচীর কর্মকাণ্ডে যোগদান, সংগীত ভবননামে একটি সংগীত বিদ্যালয় গড়ে তোলা,  শিল্পকলা একাডেমী কাউন্সিল ও শিশু একাডেমী কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করাসহ শিল্পী জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম কলিম শরাফী।

আজ ২ নভেম্বর ২০১০ সালের এই দিনে তিনি চলে গেছেন সকলকে ছেড়ে। তিনি চলে গেছেন তবে  তার অনুপস্থিতিতেও সংগীত প্রেমীদের মাঝে আজও জ্বলজ্বল করছে তার কীর্তি।

১৯২৪ সালের মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার খৈরাডিঁহি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন কলিম শরাফী। তার সম্পূর্ণ নাম মাখদুমজাদা শাহ সৈয়দ কলিম আহমেদ শরাফী। কলিম শরাফীর পিতার নাম সামি আহমেদ শরাফী মাতার নাম আলিয়া বেগম। মাত্র চার বছর বয়সে মা আলিয়া বেগমকে হারান তিনি। তার পড়াশুনার হাতেখড়ি হয় আরবি ওস্তাদজী আর বাংলা পণ্ডিত মশাইয়ের হাতে। ১৯২৯ সালে পাঠশালায় ভর্তি হয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন তিনি। তাঁতিপাড়া প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে চলে আসেন কলকাতায় বাবা সামি আহমেদ শরাফীর কাছে।

১৯৩৫ সালে ভর্তি হন মাদ্রাসা--আলিয়াতে। অ্যাংলো পার্শিয়ান বিভাগে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। পরবর্তীকালে খ্যাতিমান সাংবাদিক শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার তার সহপাঠি হন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কলকাতার বিখ্যাত সংগীত বিদ্যালয়দক্ষিণীতে সংগীত শিক্ষা লাভ করেন। এরপর ১৯৫০ সালে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন কলিম শরাফী।

১৯৪৯ সালে কলিম শরাফী প্রথমবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ১৯৫৭ সালে বিচ্ছেদ ঘটে। তারপর ১৯৬৩ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। কলিম শরাফীর দ্বিতীয় স্ত্রী অধ্যাপক নওশেবা খাতুন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। আলেয়া শরাফী এবং আজিজ শরাফী নামের দুই সন্তান রয়েছে কলিম শরাফীর।

একটি রক্ষণশীল পরিবার থেকে উঠে আসেন কলিম শরীফ। তবুও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (আইপিটিএ)-তে যোগ দিয়ে কলকাতার হাজারা পার্কে প্রথম হাজার হাজার দর্শকের সামনে সর্বপ্রথম গণসংগীত পরিবেশন করেন। তারপর ১৯৪৬ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে বের হয় কলিম শরাফীর প্রথম গণসংগীতের রেকর্ড। এর সঙ্গে কলকাতা বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হয়ে যান কলিম শরাফী।

শুভ গুহঠাকুরতার রবীন্দ্র সংগীতের প্রতিষ্ঠানদক্ষিণীতে নিয়মিত রবীন্দ্র সংগীত চর্চা শুরু করেন। এক সময় কলিম শরাফী দক্ষিণীতেই যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। দক্ষিণীতে কলিম শরাফী সংগীতগুরু দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুচিত্রা মিত্রের সাহচর্য পেয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে নীতিগত বিরোধের কারণে মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, অশোক মজুমদার, মোহাম্মদ ইসরাইল, কলিম শরাফী প্রমুখ আইপিটিএ থেকে বেরিয়ে এসে গঠন করেন নাট্যসংস্থাবহুরূপী

১৯৫৬ সালে শেরে বাংলার মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে সেকশন নাইনটি টু জারি করার ফলে কলিম শরাফীকে আত্মগোপন করতে হয়। সে বছরের শেষ দিকে তিনি আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায়----নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সংগঠনের ব্যানারেই মঞ্চস্থ করেনতাসের দেশনাটকটি। সে সময় কলিম শরাফীর সহযোগী ছিলেন . আনিসুর রহমান . রফিকুল ইসলাম। ১৯৫৭ সালে কলিম শরাফী প্রথমবারের মতো সংগীত গান আকাশ আর মাটি  চলচ্চিত্রে। এরপর ১৯৫৮ সালে কলিম শরাফীর গান রেডিওতে সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতা পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল।


কলিম শরাফী ১৯৬০ সালে সোনার কাজল চলচ্চিত্রে প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন পরবর্তী প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। সময় কলিম শরাফীর সংগীত পরিচালনায় নির্মিত প্রামাণ্য চিত্রভেনিসআন্তর্জাতিক পুরস্কারও অর্জন করে। তারপরসূর্যস্নানছবিতে পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে গানটি গেয়ে তিনি শ্রোতামহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান।

এছাড়া কবিয়াল রমেশ শীলের জীবন নিয়ে একটি তথ্য চিত্রও নির্মাণ করেন কলিম শরাফী। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় প্রথম টিভি সেন্টার চালু হলে তিনি সেখানে প্রোগ্রাম ডিরেক্টর পদে যোগ দেন। কলিম শরাফী ১৯৬৯ সালে সত্যেন সেনের সঙ্গে উদীচীর কর্মকাণ্ডে যোগ দেন। ১৯৭৭ থেকে প্রায় অনেকগুলো বছর সভাপতি সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৯ সালে গঠিত হয়জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ কলিম শরাফী এই উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক। পরে এইজাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদজাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ’- পরিণত হয়।

কলিম শরাফী ১৯৮৩ সালের এপ্রিলেসংগীত ভবননামে একটি সংগীত বিদ্যালয় গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই শিল্পী কলিম শরাফী প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। কলিম শরাফী একাধিক চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন।স্মৃতি অমৃততার প্রকাশিত গ্রন্থ তার গানের পনেরটি ক্যাসেট তিনটি সিডি ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে।  তিনি শিল্পকলা একাডেমী কাউন্সিল শিশু একাডেমী কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ বেতার টিভি শিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সংস্থা নাগরিক নাট্য অঙ্গনে প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক জীবনে কলিম শরাফীর মাত্র ৫টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর নাম হলএই কথাটি মনে রেখো, আমি যখন তার দুয়ারে, কলিম শরাফীর যত গান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এবং জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কথা সুরে নবজীবনের গান।

সংগীত শিল্পে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কলিম শরাফী পয়েছেন একুশে পদক (১৯৮৫), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৯), ‘নাসিরউদ্দিন স্বর্ণ পদক’ (১৯৮৮), ‘বেগম জেবুন্নেছা কাজী মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণ পদক’ (১৯৮৭), সত্যজিত রায় পুরস্কার (১৯৯৫) এবং শিক্ষা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র হতেকৃতি বাঙালি সম্মাননা পদক’ (১৯৮৮)

বাংলা একাডেমী ফেলোশিপ, রবীন্দ্র সুবর্ণ জয়ন্তী পাটনা, কলিকাতার শিল্প মেলার বঙ্গ সংস্কৃতি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব অনার, রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অ্যাওয়ার্ড, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গুণীজন সংবর্ধনা, পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৫তম জন্ম বার্ষিকী, ডি- আর্ট অ্যান্ড কালচার ফেস্টিভেল, পাকিস্তান ইত্যাদি অনুষ্ঠানে সম্মানিত গুণী মানুষটি। সর্বশেষ ২০১০ সালে তিনি বাংলা একাডেমী প্রবর্তিত রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন।

 

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭