ইনসাইড বাংলাদেশ

মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক: খামারিদের দেবদূত


প্রকাশ: 03/11/2023


Thumbnail

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার জ্যোতিষ চন্দ্র দাস। পেশায় একজন মাছ বিক্রেতা। অভাবী সংসারে কিছু বাড়তি রোজগারের আশায় বেশকিছু গরুও পালতেন তিনি। একদিন হঠাৎ তার গরুটি অসুস্থ হয়ে পরে। পশু ডাক্তার আসতে আসতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে গরুর শরীর। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই মারা যায় তার গরুটি।

জ্যোতিষ চন্দ্র বলেন, ‘আমি নিজের সন্তানের মতো গরুটারে পালছি। কম কইরা হলেও এক লাখ টাকা দাম হইত। এখন ঋণের চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না। গরুর ডাক্তারকে ফোন দিসিলাম। উনি সদরে গেছেন। আসতে আসতে বিকাল হইব কইসিল। কিন্তু তার আগেই আমার গরুটা মইরা গেল।

দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র বিমোচন এবং বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে বহুকাল থেকেই ব্যাপক ভূমিকা পালন করে আসছে পশুপাখি পালন। কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এবং সময়মত যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ার ফলে প্রায়ই মারা যায় অনেক গবাদিপশু–পাখি। যার ফলে আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হন জ্যোতিষ চন্দ্র দাসের মত ক্ষুদ্র খামারিরা।

তবে কোন গবাদিপশু–পাখি যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায় সেই লক্ষ্যে খামারিদের দোরগোড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে দেশের ৬১ জেলার ৩৬০টি উপজেলায় মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক (এমভিসি) চালু করেছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আওতায় বাস্তবায়নাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি)। যেখান থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পেয়ে লাভবান হচ্ছেন খামারিরা।

বিভিন্ন রকম অত্যাধুনিক যন্ত্রে সজ্জিত প্রতিটি মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিকে রয়েছে, আলট্রাসাউন্ড মেশিন, ক্যালিফোর্নিয়া ম্যাসটাইটিস টেস্ট কিট, ইসট্রাস হিট ডিটেকটর, মিল্ক চেকার, পোস্টমর্টেম সেট, স্টোমাক টিউব এবং একটি সার্জিক্যাল কিট বক্স।

ঢাকার অদূরেই মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার প্রানিসম্পদ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় আশেপাশের খামারিরা অনেকেই তাদের অসুস্থ ছাগল, বাছুর নিয়ে এসেছেন চিকিৎসার জন্য যেখান থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এবং ভেটেরিনারি সার্জন। আবার কখনও ফোন পেয়ে মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক নিয়ে ছুটে চলেছে খমারির উঠানে।

এলাকার একজন নারী তার ছাগল নিয়ে এসেছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে। তার ছাগলটি গর্ভবতী কিনা সেটি নিশ্চিত হবার জন্য তিনি এসেছেন। এলিডিডিপি প্রকল্প থেকে দেয়া আলট্রাসাউন্ড মেশিনের (গরুর গর্ভধারণ পরীক্ষার যন্ত্র) মাধ্যমে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছাগলটি যে গর্ভবতী সেটি নিশ্চিত করলেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের ভেটেরিনারি সার্জন ডা: মো: রকিবুল হাসান।

সুবিধাভোগী নারী বলেন, আগে ছাগল বাছুর গর্ভবতী কিনা সেটি অনুমান করা গেলেও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যেত না। কিন্তু এখন প্রাণিসম্পদ অফিসে আসলে স্যাররা সেটি পরীক্ষা করে দেন এবং গর্ভবতী ছাগল বাছুরের কিভাবে যত্ন নিতে হবে সেই পরামর্শও দেন।

ভেটেরিনারি সার্জন ডা: মো: রকিবুল হাসান বলেন, উনি আসলে এসেছেন উনার ছাগলটি গর্ভবতী কিনা সেটি নিশ্চিত হবার জন্য। আর যদি বাচ্চা থেকে থাকে সেটি জীবিত কিনা। এটি পরীক্ষা করার জন্য আমাদের এখানে আলট্রাসাউন্ড মেশিন রয়েছে। এই মেশিনার মাধ্যমে আমরা গরু-ছাগল গর্ভবতী কিনা এবং সেটি জীবিত কিনা তা নির্ভুলভাবে পরীক্ষা করতে পারছি। এতে খামারিরা উপকৃত হচ্ছে এবং তাদের ভোগান্তি অনেকটাই কমেছে।

তিনি জানান, যখন এই আলট্রাসাউন্ড মেশিনটি ছিল না তখন আমাদের হাত দিয়ে ধরে এটি সনাক্ত করতে হত। যেখানে ভুল হবার একটি সম্ভাবনা থেকে যেত। বাচ্চা আছে কিনা সেটি নিশ্চিত হওয়া গেলেও জীবিত কিনা তা শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যেত না। এখন সেটি সহজে অল্প সময়েই সম্ভব হচ্ছে। এটি বহন করাও খুব সহজ হওয়ায়, যাদের বড় গরু, যাদের পক্ষে গরু এখানে নিয়া আসা অনেকটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তাদের কাছেও আমরা মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিকের মাধ্যমে সেই সেবাগুলো পৌঁছে দিতে পারছি।

রকিবুল হাসান জানান, শুধু গর্ভবতী কিনা সেটি ছাড়াও, পশুর জরায়ুতে সিস্ট আছে কিনা, কোথাও টিউমার আছে কিনা তা এই যন্ত্রের মাধ্যমে সহজেই শনাক্ত করা যায়। এই মেশিনগুলোর মাধ্যমে আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে সকল খামারিদের সেবা দিতে পারছি।

একই গ্রামের আরেক খামারি তার গরুর ওলান ফোলা রোগ হয়েছে কিনা সেটি নিশ্চিত হতে উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিসে ফোন করলে তার বাড়ির উঠানে ভেটেরিনারি ডাক্তারসহ চলে আসে এমভিসি। ম্যাসটাইটিস ডিটেক্টরের মাধ্যমে তারা গাভীটিকে পরীক্ষা করে এবং রোগ শনাক্ত করে। 

ভেটেরিনারি ডাক্তার রকিবুল হাসান খামারিকে জানান, তার গাভীটির ম্যাসটাইটিস হয়েছে যেটিকে আমরা ওলান ফোলা রোগ হিসেবে জানি। 

তিনি জানান, এই খামারের পরিবেশটি বেশ অপরিচ্ছন্ন। আর এই রোগটি মূলত হয় সেডের মেঝে দীর্ঘ সময় সেঁতসেতে ও ভিজা থাকলে, ওলানের বাঁট দূষিত মেঝের সংষ্পর্শে আসার মাধ্যমে অথবা দুধ দোহনকারীর হাত, দুধ দোহনের যন্ত্রের মাধ্যমে জীবাণু সরাসরি ওলানে প্রবেশ করলে। 

তিনি আরও জানান, যেহেতু এটি একটি ব্যাকটেরিয়াল ডিজিস (রোগ) সেহেতু আমরা তাকে কিছু অ্যান্টিবায়োটিক সাজেস্ট করেছি এবং এই ঔষধ চলাকালীন ৭ দিন এই গাভীর দুধ বিক্রি করা যাবে বলে নির্দেশনা দিয়েছি। এছাড়া খামারটি পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখার জন্যও তাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

এলিডিডিপি প্রকল্পের মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক এভাবেই সেবা দিয়ে যাচ্ছে দেশের ৩৬০টি উপজেলায়। যার ফলে উপকৃত হচ্ছেন হাজারো খামারি।

এলিডিডিপি সূত্রে জানা যায়, এমভিসি চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৩৫৮টি উপজেলার প্রায় ৪৪ হাজার খামারি এর থেকে সেবা গ্রহণ করেছেন। যেখানে ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ৮০৫ টি পশুকে বিভিন্ন চিকিৎসা এবং ৬০ হাজারেরও বেশি পশুকে টিকা দেয়া হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের শত শত ভেটেরিনারি চিকিৎসক ও বৃহৎ কর্মী বাহিনী জেলা, উপজেলা ও মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সরকার থেকে বিনামূল্যে পশুপাখির বিভিন্ন রোগের টিকা, চিকিৎসা এবং ওষুধও দেওয়া হচ্ছে। আগে গাভীর প্রসবকালীন জটিলতাসহ বিভিন্ন রোগের তাৎক্ষণিক সেবা দেওয়ায় তেমন কোনো সুব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু এখন এমভিসি’র মাধ্যমে সেটি সম্ভব হচ্ছে। উপজেলাভিত্তিক এ ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিকগুলো গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জরুরি চিকিৎসা ও পরামর্শসেবা দিয়ে যাচ্ছে। 

প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রাব্বানী বলেন, চিকিৎসাসেবার জন্য চিকিৎসক যেমন প্রয়োজন, পাশাপাশি কিছু লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন। কারণ প্রাণীর এক্স-রে, আলটাসনোগ্রাম লাগতে পারে। লজিস্টিক সাপোর্ট ছাড়া একজন চিকিৎসক ফুল এফিসিয়েন্সি দেখাতে পারবে না। এজন্য একটা হাসপাতাল লাগে, এটি হলো উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতাল। কিন্তু একটা প্রান্তিক খামারির অসুবিধা হলে তার অসুস্থ প্রাণীটি হাসপাতালে নিয়ে আসাটা দুরূহ ব্যাপার। আবার যখন চিকিৎসক মোটরসাইকেল নিয়ে যান তখন এত লজিস্টিক সাপোর্ট সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন না সেখানে। সে কারণে আমরা মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক সার্ভিসটা ডেভেলপ করেছি। এর মাধ্যমে চিকিৎসক সব লজিস্টিক সাপোর্টসহ অসুস্থ প্রাণীর সেবা দিতে তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে, ইমার্জেন্সি যে সার্ভিসটি দরকার সেটি তারা খামারিকে দিতে পারছে। ফলে খামারিরা যেমন উপকৃত হচ্ছে তেমনি দেশের প্রানিসম্পদ উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭