এডিটর’স মাইন্ড

কেমন হবে নির্বাচন


প্রকাশ: 06/11/2023


Thumbnail

শঙ্কার মেঘ কেটে গেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মহাসড়কে উঠেছে বাংলাদেশ। শুরু হয়েছে ক্ষণগণনা। সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। নির্বাচন কমিশন সে লক্ষ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেছে। নির্বাচন শেষ পর্যন্ত আদৌ হবে কি না, এ নিয়ে কদিন আগেও যারা সন্দিহান ছিলেন, তারাও এখন মত পাল্টাচ্ছেন। সবাই একমত নির্বাচন হবেই। কিন্তু কেমন হবে সেই নির্বাচন? বিএনপি কি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে? এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।

কদিন আগেও ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি ছিল আশাবাদী। বেশ আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু এখন সেই দলটি যেন পথহারা। গন্তব্যহীন আন্দোলনে বিএনপি এখন অস্তিত্বের সংকটে। ২৮ অক্টোবর বিএনপির ভুল রাজনীতি তাদের আবার নিয়ে গেছে সর্বনাশের কিনারে। একটি ভুল আরেক ভুলের জন্ম দেয়। ২৮ অক্টোবর সহিংসতা এবং নাশকতা করে বিএনপি যে ভুল করেছে, তা তাদের নিয়ে গেছে ভুলপথে। একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দলটি। ৩১ অক্টোবর থেকে তিন দিনের অবরোধ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। সেখান থেকে কৌশল পাল্টায়নি তারা। অকেজো, অর্থহীন অবরোধ আবার ডেকেছে। দেশের মানুষ এখন হরতাল, অবরোধ, ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পছন্দ করে না। এসব কর্মসূচি একটি রাজনৈতিক দলকে গণবিচ্ছিন্ন করে। বিএনপি ক্রমেই একলা হয়ে যাচ্ছে। তাদের যারা শুভাকাঙ্ক্ষী তারাও এই হঠকারিতায় হতবাক। লা-জবাব। বিএনপির জন্য যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে সহানুভূতি দেখাত, তারা নির্বাক। সহিংসতার দায় আওয়ামী লীগ এবং পুলিশের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছিল বটে। কিন্তু পুলিশ কনস্টেবল আমিরুলকে সাপের মতো পেটানো কিংবা রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের হামলার দৃশ্য এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা এসব মধ্যযুগীয় বর্বরতা করেছে, তাদের চেহারা জাতি দেখেছে, জেনেছে পরিচয়। এ অবস্থায় আগামী দুই মাস জঙ্গি আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া যে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে অসম্ভব। জনগণের কাছে দায়বদ্ধহীন একটি রাজনৈতিক দলই শুধু এ ধরনের গোঁয়ার্তুমি করতে পারে। বিএনপি যদি এখনো মনে করে, এরকম অকার্যকর কর্মসূচি দিয়ে তারা নির্বাচন ঠেকাবে, তাহলে সেটা হবে মহাভুল। বিএনপির পক্ষে নির্বাচন বানচাল করা অসম্ভব। বিএনপির সামনে দুটি বিকল্প রয়েছে। প্রথমত শর্তহীনভাবে নির্বাচনে যাওয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে সংগঠনকে গোছানো। দ্বিতীয়ত তাদের নিজেদের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া। নির্বাচন বর্জন করে অস্তিত্ব বিলীন করে দেওয়া। বিএনপি যে পথেই যাক, নির্বাচন হবেই। বিএনপি আন্দোলন করেছিল বিদেশি কয়েকটি দেশের সমর্থনের ভরসায়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের জন্য। দুই বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মহাব্যস্ত। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কমতি নেই। এ নিয়ে সরকারকেও বেশ চাপে ফেলছিল ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটি। ভিসা নীতিসহ নানা হুমকি দিচ্ছিল সরকারকে। হিরো আলম মার খেলেও যুক্তরাষ্ট্র নিন্দা জানায়। প্রচ্ছন্নভাবে বর্তমান সরকারকে তারা রীতিমতো প্রতিপক্ষ বানিয়ে ছিল। একের পর এক মার্কিন কর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। এসব দেখেশুনেই বিএনপি অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। বিএনপির অনেক নেতা ভাবছিলেন, আওয়ামী লীগের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিএনপি ছাড়া নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না, এমন সহজ সমীকরণে আত্মহারা হয়েছিল তারা। এজন্যই ২৮ অক্টোবর দলের নেতাকর্মীরা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। পুরোনো চেহারায় ফিরে যায়। কিন্তু এ ঘটনায় তারা (বিএনপি) মার্কিন সহানুভূতি হারায়। যুক্তরাষ্ট্র আর যাই হোক, পুলিশ হত্যা, হাসপাতাল হামলা, জ্বালাও-পোড়াও সমর্থন করতে পারে না। ২৮ অক্টোবরের পর ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস কৌশল পরিবর্তন করেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস এখন শর্তহীন সংলাপের কথা বলছেন। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন, পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গেও কথা বলেছেন। অথচ এর মাত্র কয়েক দিন আগে, মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পাঁচ দফা সুপারিশ দিয়েছিল। সেই সুপারিশের প্রথমটি ছিল বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ। মার্কিন পর্যবেক্ষকদের সুপারিশের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘শর্তহীন সংলাপে আমাদের আপত্তি নেই।’ বিএনপি নেতারা তখন হাওয়ায় উড়ছিলেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সে সময় দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যদি সরকার নীতিগতভাবে মেনে নেয়, তাহলেই সংলাপ হতে পারে। তা ছাড়া কোনো সংলাপ নয়।’ তখন পিটার হাস কোথায় ছিলেন? তখন কেন বিএনপিকে ‘বিশ্বস্ত অভিভাবক’ হিসেবে বকে দেননি। এখন যে শর্তহীন সংলাপের কথা তিনি বলছেন, তখন কেন তা উচ্চারণ করলেন না? এখন ভুল কৌশলে বিএনপি বিপর্যস্ত, এজন্যই কি পিটার হাসের মুখে সংলাপের আকুতি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত যদি ২৮ অক্টোবরের আগে বলতেন, আন্দোলনের দরকার নেই, সংলাপ চাই—তাহলেই বুঝতাম তিনি নিরপেক্ষ। আন্তরিকভাবেই তিনি বাংলাদেশে একটি উৎসবমুখর নির্বাচন চান। কিন্তু এখন তার ভূমিকায় কী বলব? গত বছর ৭ ডিসেম্বর যখন নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষ হলো, তখন পিটার হাস এর নিন্দা জানাতে ২৪ ঘণ্টাও সময় নেননি। ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের আগেও তিনি ছুটে গেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। কিন্তু পুলিশ কনস্টেবল হত্যার প্রতিবাদ করেননি রাষ্ট্রদূত। কদিন আগেই মান্যবর রাষ্ট্রদূত গণমাধ্যমকে ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিলেন। ২৮ অক্টোবর যখন ৩২ সাংবাদিক আহত হলেন, বেদম মার খেলেন তখন মিস্টার হাস নীরব কেন? যারা সাংবাদিকদের বীভৎসভাবে পিটিয়েছে, তারা কি ভিসা নীতির আওতায় আসবে মান্যবর রাষ্ট্রদূত? সে প্রসঙ্গ থাক। ২৮ অক্টোবরের পর মার্কিন দূতাবাস চাইছে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে। সেজন্য সংলাপের আহ্বান জানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো চায় সংলাপের মাধ্যমে একটি সম্মানজনক সমঝোতার পথ উন্মুক্ত হোক। সে পথ দিয়ে বিএনপি নির্বাচনী বাসে উঠতে পারে। অবশ্য এই সংলাপের আগ্রহের জন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ দেশের রাজনীতিতে সংলাপ এবং ষড়যন্ত্র যমজ ভাইয়ের মতো। ২০০৬ সালেও যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিদেশি দেশের চাপে আবদুল জলিল এবং আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার সংলাপ হয়েছিল। সেটা সংলাপ ছিল না, ছিল অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার সুড়ঙ্গ। ২০১৩ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধী দলকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। এর উত্তরে বেগম জিয়া যেসব শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন, তা শালীনতা-বিবর্জিত। তাই এবার হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপ আগ্রহের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, খতিয়ে দেখা দরকার। গত শনিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানান। বিএনপি এ সংলাপে যায়নি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিংবা বিএনপিপন্থি সুশীলদের উচিত ছিল বিএনপিকে ওই সংলাপে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া। ওই সংলাপে গেলে কিছুটা হলেও বিএনপির পাপ স্খলন হতো। এর ফলে সরকারের সঙ্গে সংলাপেরও একটা পটভূমি তৈরি হতো। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নিয়েছে। এ সংলাপের মধ্য দিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো—বিএনপি অংশগ্রহণ করুক না করুক, দেশে নির্বাচন হবে। বহু দল এ নির্বাচনে অংশ নেবে। আর এ নির্বাচন ২০১৪-এর মতো হবে না। নির্বাচন হবে কি না, এ নিয়ে কদিন আগেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংশয় ছিল। ছিল আতঙ্ক। বিএনপির হুংকার, মার্কিন চাপ এবং সুশীলদের সমালোচনায় রীতিমতো চাপে ছিল টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটি। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই শঙ্কায় ছিলেন। বিএনপি ছাড়া নির্বাচন করলে সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে ছিল নানা আলোচনা। মার্কিন চাপ কতটা গভীর হবে সে নিয়েও কথা কম হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র যদি বড় নিষেধাজ্ঞা দেয় তখন কী হবে—এ প্রশ্ন আওয়ামী চায়ের আড্ডাকে বিষণ্ন করে তুলত। কিন্তু ২৮ অক্টোবর বিএনপির ‘আত্মঘাতী আন্দোলন’ সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। বদলে গেছে দৃশ্যপট। ব্যাকফুটে থাকা আওয়ামী লীগই এখন চালকের আসনে। তবে এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের মধ্যে এক ধরনের আত্মতৃপ্তির ঢেকুর লক্ষ করা যাচ্ছে। বেশিরভাগ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী মনে করছেন, খেলা শেষ। বিএনপি হেরে গেছে। টানা চতুর্থবার আওয়ামী লীগের সরকার গঠন এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা। আওয়ামী লীগের এই অতি আত্মবিশ্বাস তাদের সর্বনাশের কারণ হতে পারে। আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে, লড়াই এখনো শেষ হয়নি। ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। নির্বাচনের রাস্তায় এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। ২৮ অক্টোবর একটা বিষয় প্রমাণ করেছে, একটি ভুল কিংবা একটি ঘটনা রাজনীতির সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে। নির্বাচন পর্যন্ত একটি ভুলও করা যাবে না। সহিংস রাজনীতি আর নাশকতার আন্দোলন বিএনপিকে রাজনীতির ভিলেন বানিয়েছে। নির্বাচনে তারা এখন পার্শ্বচরিত্র। বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না, তাদের সিদ্ধান্ত। বিএনপি আসুক আর না আসুক, আওয়ামী লীগকে একটি নির্ভুল নির্বাচন করতে হবে। বিএনপি না এলে যেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪-এর মতো না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আবার বিএনপি অংশ নিলে নির্বাচন যেন ২০১৮-এর মতো প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হবে—এটা প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। বারবার দেশে-বিদেশে তিনি এ কথা বলেছেন। দেশের জনগণ শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করে। জনগণ জানে, তিনি যা বলেন, তা করেন। তাই একটি অসাধারণ নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের জন্য আগামী নির্বাচন দুই অগ্নিপরীক্ষার। প্রথমত তাদের জয়ী হতে হবে। উন্নয়ন এবং অগ্রগতির ধারাবাহিকতার স্বার্থে। না হলে এ দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। দ্বিতীয়ত একটি প্রশ্নহীন, বিতর্কমুক্ত নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন করেই ষড়যন্ত্রকারী এবং সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে হবে। আগামী নির্বাচন কেমন হবে, তার ওপর নির্ভর করছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশের অস্তিত্ব।


লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল : poriprekkhit@yahoo.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭