প্রকাশ: 08/11/2023
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার নেপথ্যে ছিলেন জিয়া। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় জিয়া ছিলেন একজন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার এবং ঠান্ডা মাথার খুনী। তার অপকর্মের কিছু চিহ্ন পাওয়া যায় ‘মহিউদ্দিন আহমদের’ লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শিরোনামে গ্রন্তটি থেকে। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে গবেষণাধর্মী গ্রন্থটির কিছু অংশ ধারাবাহিক প্রকাশ করা হলো:
জিয়ার সঙ্গে তাহেরের কী কথা হয়েছিল? কেন হঠাৎ তাঁদের সম্পর্কে
ফাটল ধরে, তা নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা প্রচলিত আছে। সত্যটা খুঁজে বের করা খুবই কঠিন,
হয়তো বা অসম্ভব। এ বিষয়ে তাহেরের অনুজ ও ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের
ভাষা এরকম:
দেশের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে জিয়ার সঙ্গে তাহেরের বোঝাপড়ার অনেকখানিই
আমাদের অজানা এবং তা আর কোনো দিন জানা সম্ভবও হবে না। তবে জিয়ার প্রতি তাহেরের অনুকূল
মনোভাবের কিছু কারণ শনাক্ত করা সম্ভব।
প্রথমত, জিয়াকে সেনাবাহিনীতে একজন জাতীয়তাবাদী হিসেবে মনে
করা হতো। দ্বিতীয়ত, বেতারে আপতিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপাঠের সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের
সবচেয়ে পরিচিত সেনানায়কে পরিণত হন তিনি। তৃতীয়ত, সে সময়কার অধিকাংশ সেনা অফিসারের
বিপরীতে জিয়া ছিলেন তুলনামূলকভাবে সৎ। এবং সর্বোপরি তাহের ও জাসদের উদ্যোগ-আয়োজন
সম্পর্কে জিয়ার মনোভাব ছিল ইতিবাচক।
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের কুশীলবদের অনেকেই যে যেখানে পারেন,
গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করেন। অনেকেই গ্রেপ্তার হন। শাফায়াত জামিল পালিয়ে যাওয়ার
সময় আহত হন এবং পরে নারায়ণগঞ্জ থানায় আত্মসমর্পণ করেন। তাঁকে ঢাকায় এনে সম্মিলিত
সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় ।
৭ নভেম্বর ভোরে খালেদ মোশাররফ তাঁর দুই সহযোগী কর্নেল হায়দার
ও কর্নেল হুদাকে নিয়ে শেরেবাংলা নগরে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটে যান। সেখানেই তাঁদের
হত্যা করা হয়। তাঁদের কার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল, তা আজও অজানা।
৭ নভেম্বরের 'সিপাহি বিপ্লব' ক্ষমতার লড়াই থেকে ছিটকে ফেলল
খালেদ মোশাররফকে । তাঁর শেষ পরিণতিটা ছিল অত্যন্ত করুণ। ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার
লে. কর্নেল এম এ হামিদের চোখের সামনেই অনেক কিছু ঘটেছিল। বিষয়টি তিনি এভাবে বর্ণনা
করেছেন :
সকাল ৭ ঘটিকা (৭ নভেম্বর)। টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের বারান্দায়
দাঁড়িয়ে সৈনিকদের ব্যস্ততা, দ্রুত আনাগোনা প্রত্যক্ষ করছিলাম। তারা হেলেদুলে ঘুরছে
ফিরছে আপন খেয়ালে। অন্য সময় হলে অফিসারদের পাশ দিয়ে যেতে তাদের স্মার্ট স্যালুট
দিয়ে চলতে হতো। আজ এসব বালাই নেই। আজ তাদের রাজ্যে সবাই রাজা।
এমন সময় সৈনিকদের ভিড় ঠেলে একটি আর্মি ট্রাক শোঁ শোঁ বেগে
এগিয়ে এল। ভেতর থেকে নেমে এল একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট। স্যালুট দিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা
করল, স্যার, জেনারেল জিয়া কোথায়? জরুরি। ব্যাপার আছে।... আমি তাকে নিয়ে জিয়ার কামরায়
ঢুকলাম। তাকে বললাম, এই ছেলেটি তোমাকে কিছু বলতে চায়। লেফটেন্যান্ট ততক্ষণাৎ জিয়াকে
একটি স্মার্ট স্যালুট দিয়ে বললো, স্যার, আই হ্যাভ কাম টু প্রেজেন্ট ইউ ডেড বডি অব
খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা অ্যান্ড কর্নেল হায়দার, স্যার। জিয়া অবাক! ব্রিগেডিয়ার
খালেদের ডেডবডি। আমার দিকে তাকিয়ে জিয়া বললেন; দেখতো হামিদ কি ব্যাপার! আমি অফিসারকে
সাথে নিয়ে বাইরে দাঁড়ানো খোলা ট্রাকের পেছনে গিয়ে উঠলাম। সেখানে দেখি ট্রাকের পাটাতনে
খড় চাপা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে তিনটি মৃতদেহ। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল
হুদা ও কর্নেল হায়দার। খালেদের পেটের ভুঁড়ি কিছুটা বেরিয়ে আসছিল। তাকে পেটের মধ্যে
গুলি করা হয়েছিল, হয়তোবা বোনেট চার্জ করা হয়েছিল। কি করুণ মৃত্যু! আমি জিয়াকে কামরায়
গিয়ে বললাম হ্যা, খালেদ, হুদা আর হায়দারের ডেডবডি। সে জিজ্ঞাসা করল, এগুলো এখন কি
করা যায়? আমি আপাতত এগুলো সিএমএইচের মর্গে পাঠিয়ে দেই। জিয়া বললো, প্লি হামিন, এক্ষুনি
ব্যবস্থা করো।... আমি লেফটেন্যান্টকে ডেডবডিগুলো সিএমএইচে নিয়ে যেতে বললাম।
বেলা ১১টায় আমার ড্রাইভার ল্যান্স নায়েক মনোয়ার আমার জিপ
নিয়ে ফিরে এল... অফিসে কোনো কাজ নেই দেখে আমি সিএমএইচে খালেদ মোশাররফকে দেখার জন্য
চললাম। পৌঁছে দেখি সেখানে মোশাররফের লাশ একেবারে মর্গের সামনে খোলা মাঠে নির্দয়ভাবে
ফেলে রাখা হয়েছে। চতুর্দিক থেকে সৈনিকেরা দলে দলে এসে চার দিনের বিপ্লবের নিহত নেতাকে
দেখছে, কেউ থুতু দিচ্ছে। আমি সিএমএইচের কোনো অফিসারকে পেলাম না। সুবেদার সাহেবকে ডেকে
বললাম, খালেদ একজন সিনিয়র অফিসার, তাই তার লাশটা এভাবে অসম্মান না করে মর্গে তুলে
রাখার জন্য। তিনি তখনই লাশটা সরাবার ব্যবস্থা করার জন্য ডোম ডাকতে ছুটে গেলেন । হুদা
ও হায়দারের লাশ মর্গেই ছিল। .....
৯ তারিখ দুপুরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের এক চাচা শহর
থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন খালেদের লাশটি নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভয়ে খালেদের পরিবার
পালিয়ে বেড়াচ্ছে। গত দুদিন ধরে অবহেলায় লাশটি পড়ে আছে। কেউ আসছে না। আমি তখনই তাকে
স্টেশন হেডকোয়ার্টারে চলে আসতে বললাম। তিনি ক্যান্টনমেন্টে আসতে রাজি হলেন না। অগত্যা
বনানী স্টেশনের কাছে গিয়ে খালেদের লাশ তার হাতে পৌঁছে দেওয়া হলো। তিনি সেনানিবাস
গোরস্থানে খালেদকে দাফন করার অনুমতি চাইলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিলাম। কিছুক্ষণ
পর ফোন করে বললেন, তার কাছে কোনো লোকজন নেই। যদি কবরটা খুঁড়ে দেওয়া যায়। আমি তৎক্ষণাৎ
ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড অফিসারকে ডেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদের কবর খুঁড়তে তিন/চারজন সিভিলিয়ান
মালি পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম।
বিকেলে আবার তিনি ফোন করলেন, খালেদের আত্মীয়স্বজন সবাই ভীতসন্ত্রস্ত।
তারা সন্ধ্যার দিকে খালেদকে দাফন করতে চান। তাই একটু সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ
করলেন। আমি বললাম, দেখুন, আপনি কি সেপাই গার্ড চাচ্ছেন? তিনি বললেন, তওবা, তওবা। তখন
আমি বললাম, আমি নিয়ে সন্ধ্যার সময় ওখানে হাজির থাকব। আপনারা নির্বিঘ্নে খালেদকে নিয়ে
আসুন ।....
সন্ধ্যাবেলা ঘোর অন্ধকার। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। রাস্তার লাইটের
স্তিমিত আলোতে ক্যান্টনমেন্টের গোরস্থানে তড়িঘড়ি করে খালেদের দাফনকার্য সমাধা করা
হলো। উপস্থিত ছিলেন মাত্র চার/ছয়জন অতি নিকটাত্মীয় চাচা। আর শুধু আমি ও আমার ড্রাইভার
ল্যান্স নায়েক মনোয়ার।
এভাবে শেষ হলো একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে 'কে ফোর্সের' দুর্ধর্ষ
কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের শেষকৃত্য। গোপনে, অন্ধকারে, সবার অগোচরে।
(সূত্র: জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি ।। পৃষ্টা:
১৯৮-২০১)
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭