ইনসাইড আর্টিকেল

জিয়ার ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতা (পর্ব-৩)


প্রকাশ: 09/11/2023


Thumbnail

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার নেপথ্যে ছিলেন জিয়া। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় জিয়া ছিলেন একজন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার এবং ঠান্ডা মাথার খুনী। তার অপকর্মের কিছু চিহ্ন পাওয়া যায় ‘মহিউদ্দিন আহমদের’ লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শিরোনামে গ্রন্তটি থেকে। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে গবেষণাধর্মী গ্রন্থটির কিছু অংশ ধারাবাহিক প্রকাশ করা হলো:

৭ নভেম্বর সারা দিন ঢাকা সেনানিবাসের পরিস্থিতি ছিল থমথমে। বিকেলের দিকে পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে যায়। অফিসাররা আতঙ্কিত হয়ে পরিবার-পরিজনসহ সেনানিবাস ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল হামিদ ওই রাতের ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে :

৭-৮ নভেম্বরের ওই বিভীষিকাময় রাত্রে গভীর অন্ধকারে উন্মাদ সৈনিকেরা অফিসারদের রক্তের নেশায় পাগল হয়ে উঠল। ঘটে গেল বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড। বহু বাসায় হামলা হলো। অনেকে বাসায় ছিলেন না। অনেকে পালিয়ে বাঁচল। সৈনিকেরা মেজর করিম, মিসেস মুজিব, মিসেস ওসমানকে গুলি করে হত্যা করল। মেজর আজিম ও মুজিব চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। বিপ্লবী সৈনিকেরা তাদের এয়ারপোর্টে পাকড়াও করে। আজিমকে গুলি করে হত্যা করে। মেজর মুজির প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হন। অর্ডিন্যান্স অফিসার মেসে সৈনিকেরা হামলা করে তিনজন তরুণ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে ছিলেন মেজর মহিউদ্দিন, যিনি শেখ সাহেবের লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে দাফন করেন। সৈনিকেরা বনানীতে কর্নেল ওসমানের বাসায় আক্রমণ করে। ওসমান পালিয়ে যান, তারা মিসেন ওসমানকে গুলি করে হত্যা করে। হকি খেলতে এসেছিল দুজন তরুণ লেফটেন্যান্ট। তাদের স্টেডিয়ামের পাশে গুলি করে হত্যা করা হয়। অর্ডিন্যান্স স্টেটে দশ জন অফিসারকে এক লাইনে দাঁড় করানো হয় মারার জন্য। প্রথমজন এক তরুণ ইএমই ক্যান্টেন। তার পেটে গুলি করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। বাকিরা অনুনয়-বিনয় করলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। বেঁচে গেল তারা অপ্রত্যাশিতভাবে। টেলিভিশনের একজন অফিসার মুনিরুজ্জামান। বঙ্গভবনে খালেদের সময় খুবই অ্যাকটিভ ছিলেন। তাকে ধরে গুলি করা হয় । তিন দিন পর তার লাশ পাওয়া যায় মতিঝিল কলোনির ডোবায়। সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের ডাইরেক্টর কর্নেল (পরে ব্রিগেডিয়ার) খুরশিদ। বিপ্লবীরা তার বাসা আক্রমণ করে কয়েক ঝাঁক গুলিবর্ষণ করে। তিনি পালিয়ে যান।... সৈনিকেরা দল বেঁধে প্রায় প্রতিটি অফিসার্স কোয়ার্টারে হামলা চালায়। ভীতসন্ত্রস্ত অফিসাররা বাসা ছেড়ে অন্ধকারে পেছনের পানির ডোবায়, ঝোপে-জঙ্গলে আত্মগোপন করে সারা রাত কাটায়

এর অনেক দিন পর ঢাকার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে মেজর হাফিজের সঙ্গে আকা ফজলুল হকের দেখা হয়। হাফিজ তখন সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত। মোহামেডান ক্লাবের ফুটবল টিমের তিনি অধিনায়ক ছিলেন।। তিনি জিয়ার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, জিয়াকে গৃহবন্দী রাখার পরিকল্পনাটি ছিল হাফিজের। আবার হাফিজের কারণেই জিয়া কিলড হননি। এতে মনে হতে পারে, জিয়াকে আটক রাখার ব্যাপারটা ছিল অভ্যুত্থানকারীরা জিয়াকে তাঁর বাসভবনে অন্তরীণ করার সময় ড্রয়িংরুমে টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শয়নকক্ষের টেলিফোন লাইনটি সচল ছিল। এই টেলিফোনের মাধ্যমেই জিয়া তাহেরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন।

এ প্রসঙ্গে ফারুক-রশিদের বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তাঁদের কথা অনুযায়ী, জিয়া ছিলেন একজন পাকা খেলোয়াড়। স্যাটারডে পোস্ট-এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন:

প্রথম কথা হচ্ছে, জিয়া তাঁর সৃষ্ট স্টাইলে নিজের বাসভবনে আটক ছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ও পদাতিক বাহিনীর একটি কোম্পানির প্রহরাধীন ছিলেন। সেখানে তাঁর ব্যক্তিগত স্টাফ অফিসাররাও ছিলেন। বিদ্রোহ দমনের জন্য তিনি নিজে কোনো উদ্যোগ নেননি। উপপন্তু প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক প্রেসিডেন্ট কর্তৃক এ ব্যাপারে তাঁকে বিদ্রোহ দমন করতে সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করা সত্ত্বেও তিনি বিদ্রোহ দমন করতে অস্বীকার করেন, তাঁর বাসভবনের টেলিফোন বরাবরই সম্পূর্ণরূপে কাজ করছিল। তাঁর স্ত্রী আমাদের এই মর্মে নিশ্চিত করেছিলেন যে, তিনি গ্রেপ্তার কিংবা আটকাবস্থায় নেই। টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে স্ত্রী জানান যে, তিনি কতিপয় সামরিক অফিসারের সঙ্গে আলাপ করছেন। এরপর বঙ্গভবন থেকে তাঁকে যতবারই ফোন করা হয়েছে, ততবারই তিনি ফোনে কথা বলতে অস্বীকার করেন। চিফ অব আর্মির পদবির অপব্যবহার করে জিয়া সর্বদাই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জনগণ ও সৈনিকদের ধোকা দিয়েছেন।

৮ নভেম্বর জাসদের বায়তুল মোকাররম চত্বরে একটা সমাবেশ করার চেষ্টা করা হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে আক্রমণ চালিয়ে সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেন। তাঁদের গুলিতে আ ফ ম মাহবুবুল হক আহত হন।

৮ নভেম্বর দিনটা ছিল আবু তাহেরের জন্য হতাশাব্যঞ্জক। সকাল ১০টায় ঢাকা সেনানিবাসের মাঠে জিয়া সব সৈনিক ও অফিসারকে জমায়েত হতে বললেন। সেখানে সৈনিকেরা সবাই সশস্ত্র ছিলেন। জিয়া সবার উদ্দেশে বললেন, "আপনারা যার যার ইউনিটে গিয়ে যার যার আর্মস ইউনিট কমান্ডারের কাছে জমা দিয়ে যার যার কাজে যোগ দিন।’ জিয়া অফিসারদের বললেন, আপনারা যার যার ব্যাংক লাগিয়ে যার যার কমান্ডে চলে যান।" বেলা একটায় নায়েব সুবেদার মাহবুব আবু তাহেরের সঙ্গে দেখা করার জন্য এলিফ্যান্ট রোডে তাহেরের বড় ভাই সার্জেন্ট আবু ইউসুফের বাসায় যান। মাহবুরের বর্ণনামতে:

আমি বাসায় ঢুকে দেখি কর্নেল তাহের টেলিফোনে আলাপ করছেন। টেলিফোনের রিসিভারটা জোর করে রেখে বললেন, 'বিট্রেয়ার।" আমি বললাম, 'স্যার, কে?' তাহের বললেন, 'জেনারেল জিয়া। সুবেদার সাহেব, একটা কাজ করেন, আপনি আপনার সুইসাইড কমান্ডো ফোর্স তৈরি করেন। গাদ্দার জিয়াকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য। আমি তাহেরকে বললাম, স্যার, আপনিই তো ৬ নভেম্বর মিটিং করে জিয়ার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। দুই দিন না যেতেই তাঁকে সরাতে হবে? এর অর্থ কিছুই বুঝতে পারলাম না, স্যার।' আমি তাহেরকে বললাম, 'এখন মোটেই সম্ভব নয়। কী বলে আজ সিপাহিদের একত্র করব? আমরা কী জন্য কী উদ্দেশ্যে সিপাহি-জনতার বিপ্লব করেছি এবং কারা কারা করেছি, তার কোনো কিছুই প্রকাশ হয় নাই। এই বলে ক্ষুণ্ণ মন নিয়ে নিরাশায় ও নিঃসহায় হয়ে বিকেল পাঁচটায় বাসায় ফিরলাম আর চিন্তা করতে লাগলাম, ফাঁসি অনিবার্য। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এতিম হয়ে দ্বারে দ্বারে মানুষের লাথি খাবে আর মানুষে গাদ্দারের ছেলেমেয়ে বলে ধিক্কার দেবে।

৮ নভেম্বর রাতে রাজশাহী কারাগার থেকে আ স ম আবদুর রব এবং ময়মনসিংহ কারাগার থেকে মেজর জলিল ছাড়া পান। পরদিন তাঁরা ঢাকায় আসেন। এর আগে ৭ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার একটি দল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক খুলে দিলে জাসদের নেতা এম এ আউয়াল, মো. শাজাহান, ও মির্জা সুলতান রাজা বেরিয়ে আসেন। তাঁরা সবাই তখন হতবিহ্বল।

৮ নভেম্বর দৃশ্যপট একটু বদলে যায়। রাষ্ট্রপতি সায়েম নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং তিন বাহিনীর প্রধানদের উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। এর সঙ্গে আরও অনেকগুলো আদেশ জারি করা হয় এবং এই ফরমান ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট তারিখের ফরমানের অংশবিশেষ বলে গণ্য হবে' বলে উল্লেখ করা হয়।

আবু তাহেরের প্রতি অনুরাগী একজন কর্মকর্তা ছিলেন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মেজর জিয়াউদ্দিন। ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের সময় তিনি দাপ্তরিক কাজে খুলনায় ছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি সব জানতে পারেন এবং 'বিপ্লবের' আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ৮ নভেম্বর রাতে সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে পিরোজপুরের দিকে রওনা হন। লঞ্চে অনেক আনসার ছিলেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ নম্বর সেক্টরে তাঁর সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করেছেন। পিরোজপুরে তিনি আরও কিছু লোককে সংগঠিত করার নির্দেশ দিয়ে লঞ্চটা নিয়ে সুন্দরবনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। প্রথমেই তিনি শরণখোলা থানা দখলে নিয়ে নেন এবং ওই এলাকাকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করে 'বিপ্লবের ঘাঁটি বানান।

 

(সূত্র: জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি ।। পৃষ্টা: ২০২-২০৪)



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭