প্রকাশ: 10/11/2023
ভেবেছিলাম বাণিজ্যমন্ত্রীকে নিয়ে আর লিখব না। তার প্রলাপ নিয়ে মন্তব্য করাটা সময়ের অপচয়। কিন্তু গত বুধবার আমাদের ‘সর্বকালের সেরা’ বাণিজ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, তাতে চুপ থাকা যায় না। ৮ নভেম্বর দুপুরে সচিবালয়ে জাতীয় ট্যারিফ পলিসির এক পর্যালোচনা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী। টিপু মুন্সী নিজেই যেন জ্যালজ্যান্ত একটি ‘শব্দ বোমা’। তিনি যেখানেই যান, কথা বললেই বিস্ফোরনের শংকা থাকে। বেফাঁস কথা আর টিপু মুন্সী এখন সমার্থক। তিনি কথা বলবেন অথচ তা নিয়ে বিতর্ক হবে না, এ যেন অসম্ভব। বুধবারও তাই হলো। তিনি বললেন ‘আমার এলাকার নারীরা দিনে তিনবার লিপস্টিক লাগাচ্ছেন, চারবার স্যান্ডেল বদলাচ্ছেন।‘ বাণিজ্য মন্ত্রীর বক্তব্য অশ্লীল, কুরুচীপূর্ণ এবং অসংলগ্ন। আমাদের মন্ত্রী মহোদয় কি সুস্থ আছেন? নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এ ধরনের বেসামাল কথাবার্তা বলছেন? এমন সময় তিনি এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলছেন যখন জাতীয় নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। একদফা দাবীতে বিএনপি টানা কর্মসূচী পালন করছে। যে সময় গার্মেন্টস শ্রমিকদের রাজপথে নামার জন্য বিশেষ মহল ইন্ধন দিচ্ছে। নারী শ্রমিক অধ্যুষিত দেশের রপ্তানী আয়ের প্রধান এই উৎসকে ঘিরে চলছে নানা মুখী ষড়যন্ত্র। দেশে মুদ্রাস্ফীতি ১২ শতাংশ অতিক্রম করেছে। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে মানুষের হাহাকার এখন ক্রমশ: ক্ষোভে রূপ নিতে শুরু করেছে। এরকম একটি সংকটময় এবং স্পর্শকাতর সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রীর এই বালখিল্যতা কেন? তিনি কি জনগণের কষ্ট নিয়ে মশকরা করলেন? নাকি তার এই কথা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। জেনে বুঝে সরকারকে বিব্রত করতে তিনি এধরনের মন্তব্য করলেন। অথবা তার কথায় বিশেষ ইঙ্গিত আছে?
আওয়ামী
লীগের ‘বাণিজ্যমন্ত্রী’ ভাগ্য কখনোই ভালো না। বাণিজ্য
মন্ত্রীদের নিয়ে আওয়ামী লীগের অতীত অভিজ্ঞতা তিক্ত।
খুনী মোশতাকও বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী থেকে বঙ্গবন্ধু সরকারকে
ডোবাতে এই বিশ্বাসঘাতক কি
কি করেছেন, তার তালিকা দীর্ঘ।
এনিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে। তোফায়েল
আহমেদও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯৬—২০০১ সালে
দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭
সালে ‘সংস্কার প্রস্তাব’ দিয়ে তোফায়েল আহমেদ শেখ হাসিনাকে মাইনাস
করতে চেয়েছিলেন। তোফায়েল আহমেদ আওয়ামী লীগে সংস্কারপন্থী হিসেবেই
এখন পরিচিত। কর্ণেল (অব:) ফারুক খান
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে টিকতে পারেননি বেশী দিন। তার
বদলে জাতীয় পার্টির জি.এম কাদেরকে
এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ইদানিং জি.এম কাদের
যে ভাষায় আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন, তাতে ভাবতে কষ্ট
লাগে যে, তিনি এই
সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। তিনিও একজন বিভ্রান্ত রাজনীতবীদ।
এবার টিপু মুন্সী এই
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে যেন টানা ১৫
বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ
সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণের মিশনে নেমেছেন। তার একমাত্র কাজ
এই সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত এবং বিব্রত করা।
তার নেতৃত্বে বাজার নিয়ে গত পাঁচবছরে যা
হয়েছে, তা রীতিমতো তামাশা।
তিনি নব্য মোশতাকের মতো
ইচ্ছে করে এসব করেছেন
কী না তা সময়ই
বলে দেবে। সিন্ডিকেট আছে, সিন্ডিকেট নেই—এরকম লুকোচুরি গল্প
ফাঁদিয়ে টিপু মুন্সী প্রধানমন্ত্রীকেও
বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার চেষ্টা করেছেন। তবে সব কিছু
ছাপিয়ে গেছে, টিপু মুন্সীর লিপস্টিক
তত্ত্ব। তিনি কীভাবে গুনে
দেখলেন, তার নির্বাচনী এলাকার
নারীরা তিনবার লিপস্টিক দেয়। কতজন নারীর লিপস্টিক
পর্যবেক্ষণ করে, তিনি এই
তথ্য আবিস্কার করলেন? তবে তিনবার বা
চারবার ঠোটে লিপস্টিক লাগানো
যে ভালো থাকার লক্ষণ
নয়, তা অর্থনীতিতে একটি
প্রমাণিত বিষয়। কিছুদিন আগে শ্রীলংকার তীব্র
অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল।
দেশটি হয়েছিল প্রায় দেউলিয়া। রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, অভাবের
কারণে বহু নারী সে
সময় দেহ ব্যবসায় নাম
লিখিয়েছিল। এটি হয়ে উঠেছিল
তাদের আয়ের প্রধান উৎস। বেঁচে থাকার
জন্য নিরুপায় হয়েই এই পথ বেছে
নিয়েছিলেন লংকান নারীরা। এসময় শ্রীলংকায় নারীদের মধ্যে লিপস্টিক ব্যবহারের হার বেড়েছিল বহুগুন।
লিপস্টিক দিয়ে অনেকে খদ্দেরদের কাছে নিজেকে আকর্ষনীয়
করে তুলতে চাইতো। থাইল্যান্ডে দারিদ্রের সাথে লড়তে থাকা
নারীদের মধ্যে লিপস্টিক ব্যবহারের হার বেশী। মার্কিন
সমাজ বিজ্ঞানী জুলিয়েট শোর ১৯৯৮ সালে
‘দ্য ওভার স্পেন্ট’ গ্রন্থে
‘লিপিস্টিক তত্ত্ব’ সামনে এনেছিলেন। জুলিয়েট শোরের মতে ‘মানুষের আয়
কমে গেলে তারা দামী
বিলাস পণ্য কেনা কমিয়ে
দেয়, কম দামী বিলাস
পণ্য কেনে। এতেই বাড়ে লিপস্টিক
এর বিক্রি এবং ব্যবহার। জুলিয়েট
শোরের এই তত্ত্ব জনপ্রিয়তা
পায় ২০০০ সালে। মার্কিন
মন্দায় প্রসাধনী সংস্থা ‘এন্টি লডার’ ‘দ্য লিপস্টিক ইফেক্ট’
শব্দটি ব্যবহার শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রে
২০০১ সালে নাইন—ইলেভেনের
পর সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে লিপস্টিকের ব্যবহার বেড়েছিল শতকরা ১১ ভাগ। ২০০৮
সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও একই প্রবণতা দেখা
দেয়। এর ফলে তীব্র
অর্থনৈতিক সংকট এখন ‘লিপস্টিক
ইফেক্ট’ হিসেবেই পরিচিত।
লিপস্টিক
শুধু অর্থনৈতিক সংকটের প্রতীক নয়, এটা প্রতিবাদের
ভাষা হিসেবেও পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১২ সালে নারী
স্বাধীনতার দাবীতে মেয়েরা রাস্তায় নামে গায়ে লাল
রঙের লিপস্টিক লাগিয়ে। সেখান থেকে লাল লিপস্টিক
এখনও দ্রোহের প্রতীক। ২০১৫ সালে মেসিডোনিয়ায়
শুরু হয় সরকার বিরোধী
বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভে অংশ
নেয়া এক নারী ব্যরিকেডে
থাকা এক পুলিশে বর্মে
লাল চুমু একে দেন।
এই চুমুটিই মুহুর্তে হয়ে যায় সরকার
বিরোধী বিক্ষোভের প্রতীক। ২০১৮ সালে সরকারের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হয়েছিল লিপস্টিক।
দেশটিতে নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও লাল লিপস্টিক মেখে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনে আটকদের মুক্তি দাবী করেন। ২০১৯
সালে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে
সোচ্চার হন চিলির নারীরা।
কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে, লাল
স্কার্ফ মাথায় দিয়ে, লাল লিপস্টিক ঠোটে
লাগিয়ে প্রতিবাদ করেন চিলির প্রায়
১০ হাজার নারী। আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রীর লিপস্টিক তত্ত্ব কি সেই বার্তা
বাহক? তিনি কি অর্থনৈতিক
সংকটকে কবুল করলেন, তিনবার
লিপস্টিক লাগানোর তথ্য হাজির করে?
তীব্র আর্থিক সংকটে এখন নারীদের সৌন্দর্যের
সম্বল শুধু লিপস্টিক, এই
বার্তাটি দিয়ে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে
অবস্থান নিলেন? কারণ আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী
মস্ত বড় ব্যবসায়ী। দেশে—বিদেশে ঘুরেছেন বিভিন্ন সুশীল গোল টেবিলে, পাঁচতারকা
হোটেলে জমকালো অনুষ্ঠানে তাকে হরহামেশাই দেখা
যায়। তিনি অর্থনীতিতে ‘লিপস্টিক
তত্ত্ব’ জানবেন না, তা কি
করে হয়? তাই জেনে
বুঝেই তিনি প্রতীকী ভাষায়
সরকারের সমালোচনা করলেন। অথবা শ্রীলংকা কিংবা
ব্যাংককের নারীদের মতোই বাংলাদেশে নারীদের
লিপস্টিক ব্যবহার বেড়েছে বলে বাণিজ্যমন্ত্রী কুৎসিত
ইঙ্গিত করলেন? নাকি তিনি প্রতিবাদের
ভাষা হিসেবে ‘দিনে তিনবার লিপস্টিক’
লাগানোকে দেখার চেষ্টা করেছেন? বিএনপি—জামায়াত যেমন প্রকাশ্যে দাবী
করে, দেশের মানুষ ফুঁসে আছে সরকারের বিরুদ্ধে।
জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। আমাদের মহান বাণিজ্যমন্ত্রী কি
সেই বার্তাকেই ধারণ করলেন? প্রতীকী
ভাষায় তিনি বুঝিয়ে দিলেন
বিরোধী দলের বক্তব্য সঠিক।
সরকারে থেকে তিনি সরকারের
বিরুদ্ধে স্যাবোটাজ করছেন? এজন্যই তিনি লিপস্টিক তত্ত্বের
কথা বললেন?
অথবা
তিনি বিভ্রমে আছেন। ক্ষমতা, চাটুকারদের বেষ্টনীর মধ্যে থেকে জনবিচ্ছিন এই
মন্ত্রী মানুষের কষ্ট বুঝতে অক্ষম।
মন্ত্রীত্ব তাকে এক রূপকথার
জগতে নিয়ে গেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে,
তাতে মানুষ আর পারছে না।
কিন্তু আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী আছেন বিভ্রমে। তিনি
মানুষের কষ্ট, যন্ত্রণা বুঝতে অক্ষম। মানুষের কষ্ট নিয়ে নোংরা
তামাশা করছেন। বাণিজ্যমন্ত্রীর লিপস্টিক তত্ত্বের প্রেক্ষিতে আমার প্রয়াত বাম
কবি নবারুন ভট্রাচার্যের সেই বিখ্যাত কবিতাটি
মনে পড়লো—
‘এই
ভাবেই
তুমি
বুলেট কে ভেবেছে লিপস্টিক
বোমার
ধোঁয়াতে দেখেছো মেঘের ব্যবসা
তাই
শিশুদের ছেঁড়া হাত
বুক
ফুটো মানুষ, থ্যাঁতলানো হাসপাতাল
নজরেই
পড়েনি তোমার।‘
সৈয়দ
বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭