প্রকাশ: 11/11/2023
এক পসরা বৃষ্টির পানি, ধুয়ে নিল মরুর বালি;
বহে
হিমেল হাওয়া, এই যেন শীতের
আগমনী!
হ্যাঁ,
প্রকৃতিতে শীতের বার্তা এসে গেছে। শরৎ
ঋতুকে বিদায় দিয়ে হেমন্তের সময়
চলছে। বইছে শীতের আংশিক
আভাস। দূর্বা ঘাসে কিংবা গাছের
কচি পাতায় মুক্তার মতো আলো ছড়িয়ে
ভোরের শিশির জানান দিচ্ছে শীত আসছে। ঘন
কুয়াশা ভেদ করে পূর্ব
দিগন্তে সূর্যের উদয়। ক্যাম্পাসের দিগন্ত জোড়া মাঠ ও পিচঢালা
পথে শীতের আমেজ বিরাজ করছে।
ভোরে ক্যাম্পাস অঙ্গনে পড়তে শুরু করেছে হালকা
কুয়াশা। সেই সঙ্গে অনুভূত
হচ্ছে মৃদু ঠান্ডা। এবার
শীত যদিও এখনো পুরোপুরি
আসেনি তবে কিছুদিন পরেই
পূর্ণ করে আসবে শীত।
এখনই সকালে বা রাতে কুয়াশায়
আচ্ছন্ন থাকছে এই ক্যাম্পাস। শহুরে
জীবনে কুয়াশার এই আমেজ দেখা
না মিললেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় ঠিকই দেখা মিলছে।
রাজধানী থেকে ৩২ কি:মি: দূরের এই
নগরে সকালের মত রাতের শেষ
বেলায়ও শীত পড়ছে বেশ।
শহরে এখনো শীতের তীব্রতা
ততটা নয়, তবে জাহাঙ্গীরনগরের
বিষয়টা একেবারেই ভিন্ন। শীতের আমেজ এখানে বেশ
ভালোই পড়েছে।
জাবিতে
শীত মানেই জাঁকালো। কুয়াশার চাদরে মুড়ি দিয়ে শীতের
আগমনীবার্তা নিয়ে গুটিসুটি পায়ে
শীত আসার শুরুতেই আসতে
শুরু করে শীতের অতিথি
পাখিরা। সুদূর সাইবেরিয়ার তীব্র শীত থেকে বাঁচতে
প্রতিবছর অতিথি পাখির আসর বসে এই
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর ক্যাম্পাসের লেকগুলোও
পাখিদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকে আগে থেকেই।
লাল শাপলা হাসিমুখে স্বাগত জানায় এই অতিথি পাখিদের।
হেমন্তের শেষে জাবির লেকগুলোতে
মুগ্ধতা ছড়ায় এই লাল
শাপলা। সকালে ফুটন্ত শাপলাগুলোতে পাখিদের লুকোচুরি সে এক অভিভূত
করার মতো দৃশ্য।
পরিযায়ী
পাখিরা লেকগুলোর সৌন্দর্যের নতুন মাত্রা সৃষ্টি
করে। এ যেন হয়ে
উঠে লাল শাপলার মাঝে
অতিথিদের মিলনমেলা। শুধু তাই নয়
শীতে এখানকার ছাত্র-শিক্ষকের সকালের ঘুম ভাঙে এ
অতিথি পাখির কলকাকলিতে। দেশি বিদেশি পাখির
মেলা বসে জাবির লেকগুলোতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের
‘ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার’র পেছনের লেক,
জাহানারা ইমাম এবং রেজিস্ট্রার
ভবন সংলগ্ন লেকে আসে অন্তত
কয়েক হাজার অতিথি পাখি। উপযুক্ত পরিবেশ আর নিরাপদ আশ্রয়ে
এসব অতিথি পাখি এখানে নির্ভাবনায়
মেতে থাকে কলকাকলি ও
জলকেলিতে। কেউ আবার ডুব
সাঁতারে থাকে ব্যস্ত।
কখনও কখনও চক্রাকারে উড়ে বেড়ায় ক্যাম্পাসের মুক্ত আকাশে। কখনও এসব পাখি ব্যস্ত সময় কাটায় খাবার জোগাড় করতে। তাদের এ কার্যকলাপ দেখতে এবং ক্যামেরাবন্দি করতে ক্যাম্পাসের অধিবাসীরা ছাড়াও প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য পাখিপ্রেমী পর্যটকের সমাগম ঘটে এ ক্যাম্পাসে। অনেক সময় দেখা মেলে বিদেশি দর্শনার্থীদেরও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে ১৯৮৬ সালে প্রথম
পরিযায়ী পাখি তথা অতিথি
পাখিরা আসতে শুরু করে।
আগে দেশি-বিদেশি মিলে
১৯৫ প্রজাতির পাখির দেখা মিললেও বর্তমানে
দেশি প্রজাতির সংখ্যাই বেশি।
এ নিয়ে পাখিপ্রেমীদের মধ্যে
হতাশাও দেখা যায়। কেননা
প্রতিবছর অতিথি পাখির আগমনের পরিমাণ পূর্বের বছর গুলোর তুলনায়
কমে যাচ্ছে। ফলে চিরাচরিত সৌন্দর্য
হারাচ্ছে জাবির লেকগুলো। এর কারণ হিসেবে
লেকগুলো সময়মত পরিষ্কার না করা, অতিরিক্ত
দর্শনার্থীর চলাফেরা, পাখিদের ঢিল ছোরা, গাড়ির
হর্ণ বাজানোসহ উপযুক্ত পরিবেশ না থাকাকে দায়ী
করছেন বিশেষজ্ঞ ও পাখিপ্রেমীরা।
জাবিতে
শীতকাল মানেই হলো উৎসবের ধুম।
ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন যেমন: জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, জলসিঁড়ি, চিরকুট, ধ্বনি, গীতনাট, জুডো, জাডস প্রভৃতি সাংস্কৃতিক
সংগঠনগুলোর টানা ২-৩
মাস সাংস্কৃতিক কর্মসূচির ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে ক্যাম্পাসবাসীকে শীতের
আগমনী বার্তা পৌঁছে দেয়। যেগুলোর জন্য
ক্যাম্পাসসহ আশেপাশের মানুষ অপেক্ষা করে থাকে প্রতিবছর।
এখানে
পাখিদের অভ্যর্থনা জানাতে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় পাখিমেলার।
পাখি মেলার পরেই প্রতিবছর শীতের
এই সময়ে আয়োজন করা
হয় প্রজাপতি মেলারও। জাবিতে শীতের অন্যতম বড় আকর্ষণ ক্যাম্পাসের
পিঠার দোকানগুলো। শীতের পিঠা-পুলির আয়োজনে
মাতোয়ারা থাকে এখানের শিক্ষার্থীসহ
ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা। দুপুরের
পর থেকে রাত পর্যন্ত
এসব দোকানে চলে শীতের নানা
রকম পিঠা তৈরি। সারাক্ষণ
এসব দোকানে ভিড় লেগেই থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের
বটতলা, পরিবহন চত্বর, রবীন্দ্রনাথ ও রফিক-জব্বার
হল চত্বর, বঙ্গবন্ধু হল চত্বর, মীর
মশাররফ হোসেন হল, জাহানারা ইমাম
ও প্রীতিলতা হলের মাঝখানের স্বপ্ন
চত্বরসহ পিঠার জন্য বিশেষ ভাবে
গড়ে ওঠা মেডিকেল সংগলগ্ন
পিঠা চত্বরে শীতের পিঠা তৈরি ও
খাওয়ার ভীড় এতই বেশি
থাকে যে, পিঠা পেতে
গেলে অর্ডার দিয়ে অনেক্ষণ অপেক্ষা
করতে হয়। শুধু ক্যাম্পাসের
শিক্ষার্থীরাই নয়, এই পিঠার
টানে ছুটে আসেন সাবেক
শিক্ষার্থীসহ ঢাকার আশপাশের অঞ্চলের মানুষজন।
জাহাঙ্গীরনগরের শীত মানেই গায়ে চাদর জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে চায়ের আড্ডায় মেতে ওঠা। বাহারি ভর্তা আর গরম ভাত খাওয়ার ধুম। নানান স্থানে পিঠা পুলির মেলা। আবার শীতকে বরণ করে নিতে এই ক্যাম্পাসেই আয়োজন হয় ‘হিম উৎসব’।
শীতকালে এই ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের ফুল ফোটে। গাঁদা, লাল শাপলা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, বিশ্বসুন্দরী, জিনিয়া, দোপাটি, জুঁই, চামেলি, টগর, জবা প্রভৃতি ফুল শোভাবর্ধন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হল, অ্যাকাডেমিক ভবন, রাস্তার পাশে দেখা যায় এসব ফুল।
শীত
আসলেই জাবিতে খেজুরের রস খাওয়ার হিড়িক
শুরু হয়। ক্যাম্পাসের পরিবহণ
চত্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের গ্রামগুলো থেকে সংগৃহীত টাটকা
খেঁজুরের রস পাওয়া যায়
খুব সকালে, যা শীতের আমেজকে
বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ!
লাল
মাটির এই আঙ্গিনার বিকালটারও
থাকে অন্য রূপ ।
সূর্যের আলো যায় যায়
এমন সময় মৃদু বাতাসে
মন যেন কোথায় ছুটে
যায়! হালকা শীতে এ এক
অন্যরকম অনুভূতি। ঘন গাছপালার মাঝে
কুয়াশার লুকোচুরি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। তার মাঝে পাখিদের
কিচিরমিচির আর খুনসুটি আরও
রহস্যময় করে তোলে এর
প্রকৃতিকে।
সর্বোপরি,
জাবিতে যে শীত আসছে
তা বুঝা যায় গোধূলীর
সোনালী সূর্য অস্ত না যেতেই
মাঝারি কুয়াশার চাদরে আকড়ে ধরা প্রকৃতির
দিতে তাকিয়ে। হিমেল বাতাসে হাড়ে কাঁপন ধরানো
অনুভূতি ক্যাম্পাসবাসীর গায়ে জড়িয়ে দেয়
শীতের গরম কাপড়। এর
প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি
এখানকার শিক্ষার্থীদের অকৃত্রিম ভালোবাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে একটি আধুনিক গ্রামে
পরিণত করেছে। তাই জাহাঙ্গীরনগরে শীতের
আগমন কোনোভাবেই গ্রাম থেকে আলাদা নয়।
এক কথায় শীত আসলে
এই ক্যাম্পাস যেন সাজে নতুন
রূপে। অতএব যারা শহরের
মধ্যেও গ্রামের শীতের আমেজ পেতে চান
তারা ঘুরে আসতে পারেন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭