ইনসাইড আর্টিকেল

জিয়ার ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতা (পর্ব-৫)


প্রকাশ: 12/11/2023


Thumbnail

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার নেপথ্যে ছিলেন জিয়া। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় জিয়া ছিলেন একজন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার এবং ঠান্ডা মাথার খুনী। তার অপকর্মের কিছু চিহ্ন পাওয়া যায় ‘মহিউদ্দিন আহমদের’ লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শিরোনামে গ্রন্তটি থেকে। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে গবেষণাধর্মী গ্রন্থটির কিছু অংশ ধারাবাহিক প্রকাশ করা হলো:

সিরাজুল আলম খান যদিও পার্টি ফোরামের সমন্বয়কারী ছিলেন, তাঁর সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ করা সম্ভব হতো না। ফোরামের কার্যকরী সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া। ২৬ নভেম্বর দুপুরে আনোয়ারের কাছ থেকে আম্বিয়া টেলিফোনে জানতে পারেন, ধানমন্ডিতে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। আনোয়ার স্পষ্ট করে বলেননি কী ঘটেছে। বিধানকৃষ্ণ সেন টেলিফোনে আম্বিয়াকে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ঘটনাটির বিবরণ দিয়ে জানতে চান, 'হঠকারিতা করে সবাইকে ফাঁসানোর মতলব করছে কারা?" আম্বিয়া উত্তরে বলেন, তিনি এর বিন্দু-বিসর্গও জানেন না। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি নিজেও স্তম্ভিত। জাসদের নেতারা কেউ এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নন । ঢাকা নগর গণবাহিনীর রাজনৈতিক কমিসার রফিকুল ইসলাম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের মাঠে বসে ছিলেন। একজন এসে তাঁকে ভারতীয় হাইকমিশনে ঘটে যাওয়া বিষয়টি সম্পর্কে জানালে তিনি বিস্মিত হন এবং ভাবতে থাকেন, তাঁর অজান্তে এত বড় একটা ঘটনা কীভাবে ঘটল।

তবে বোঝা যায়, বেশ কয়েক দিন ধরেই এই মিশনটি নিয়ে পরিকল্পনা হচ্ছিল। স্কোয়াডের অন্যতম সদস্য নজরুল ইসলাম বাচ্চু গণবাহিনীর সদস্য ও লালমাটিয়া কলেজের ছাত্রী আয়েশা পারুলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। পারুল থাকতেন কলেজের হোস্টেলের দোতলার একটা কামরায়। বাচ্চু তাঁর কাছে একটা ট্রাংকে বেশ কিছু কাগজপত্র রেখেছিলেন তিনি কয়েক দিন আগে পারুলকে বলেছিলেন, 'একটা রেকি হবে। দলে একজন মেয়ে থাকতে হবে। আমি যাব না, তবে আপনাকে যেতে হবে। পারুলের আর রেকিতে যাওয়া হয়নি । ২৫ নভেম্বর বিকেলে বাচ্চু হোস্টেলে এসে পারুলের সঙ্গে দেখা করে জানান, 'আগামীকাল সকালে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। দুপুরে রেডিওর খবর শুনবেন।

২৬ নভেম্বর রেডিওতে সব শুনে পারুল হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। পরদিন হোস্টেলে তাঁর খোঁজে পুলিশ আসে। হোস্টেলের সুপার নূরুন্নাহার বেগম এবং বিজ্ঞানের শিক্ষক বদিউজ্জামান ঘটনা সামাল দেন। পারুলের বিষয়টি তাঁরা দেখেন খুবই সহানুভূতির সঙ্গে। বদিউজ্জামানের শ্যালক খায়ের এজাজ মাসুদ জোস পার্টি ফোরামের ইমার্জেন্সি স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য। বাচ্চু ছিলেন তিতুমীর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র এবং স্কোয়াডের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী । তিনি ছিলেন অভিনেতা বেশী জামানের ভাগনে। পারুল বাচ্চুর স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বাচ্চুকে হারিয়ে তাঁর মা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন।

ঢাকার পূর্ব পাশে বেরাইদ গ্রামে ঢাকা নগর গণবাহিনীর একটা জরুরি সভায় আনোয়ার হোসেন এই ঘটনার সব দায় স্বীকার করেন। সভায় শরীফ নুরুল আম্বিয়া এবং ঢাকা নগর গণবাহিনীর অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন । অধিকাংশ সদস্য আনোয়ারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানোর দাবি জানান। শেষে তাঁকে লঘু শাস্তি দেওয়া হয়। তাঁকে সদর গণবাহিনীর কমান্ডারের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। আনোয়ারের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার অপরাধে রাজনৈতিক কমিসার রফিকুল ইসলামকে ভৎসনা করা হয়। এত বড় একটা ঘটনা সিরাজুল আলম খানের সম্মতি ছাড়া ঘটতে পারে বলে অনেকেরই বিশ্বাস হয়নি। আবুল হাসিব খান কিছুদিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। পরে মানিকগঞ্জের গণবাহিনীর কমান্ডার আনিসুর রহমান মানকে ঢাকা নগর গণবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

ভারতীয় হাইকমিশনে অভিযান চালানোর কয়েক দিন আগে সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনীর কয়েকজন সদস্য রায়ের বাজারে বসবাসকারী জনৈক জয়নুল হক শিকদারের কাছ থেকে দুটো পিস্তল জোর করে নিয়ে এসেছিলেন। সেনাবাহিনীর একটা জিপ নিয়ে গিয়েছিলেন। পিছলগুলো লাইসেন্স করা ছিল। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ অন্য অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে এই পিস্তল দুটোও উদ্ধার করে। পরে অনুসন্ধান করে পুলিশ এগুলোর মালিকের নামধাম জোগাড় করে। শিকদারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অস্ত্র 'খোয়া যাওয়ার বিষয়ে পুলিশকে তথ্য না দেওয়ার কারণে শিকদারের জেল হয়।

জাসদের পার্টি ফোরাম থেকে ২৬ নভেম্বরের ঘটনার বিষয়ে একটা সার্কুলার প্রকাশ করা হয়। ভারতীয় হাইকমিশনে অভিযানকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, যাঁরা এটা করেছেন, তাঁরা বিপ্লবীও নন, প্রতিবিপ্লবীও নন । তারা হচ্ছেন অবিপ্লবী। এটা পড়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ হন এবং এ ধরনের মন্তব্যকে তারা নিহতদের প্রতি চরম অবজ্ঞা ও অবমাননা হিসেবে দেখেন।

[জাসদের নেতা-কর্মীদের পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য সবাই গা ঢাকা দেন। তবু গ্রেপ্তার এড়ানো কঠিন হয়ে পড়ল। একে একে আখলাকুর রহমান, মোহাম্মদ শাজাহান, আ ফ ম মাহবুবুল হক, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অনেক সংগঠক গ্রেপ্তার হন। পুলিশের একটি দল সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে মেজর জিয়াউদ্দিনকে ধরে নিয়ে আসে। প্রথমে তাঁকে খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়। খুলনা শহরে তখন একটা মেলা চলছিল। মেলা প্রাঙ্গণে তাঁকে বেঁধে রাখা হয়েছিল, যাতে সবাই দেখতে পান।

ছিয়াত্তরের জানুয়ারিতে জাসদের পার্টি প্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন আসে। কেন্দ্রীয় ফোরাম ভেঙে দিয়ে একটি 'সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটি' (সিওসি) গঠন করা হয়। এই কমিটিতে ৩৭ জন সদস্য ছিলেন। মনে হচ্ছিল, সারা দেশ জিয়ার নেতৃত্বে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে নিয়োজিত, সব রাজনৈতিক দল সামরিক সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার কৌশল নিয়েছে। একমাত্র জাসদ থেকে গেল স্রোতের বিপরীতে।

 

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাসদ চেষ্টা করল একটি 'গণতান্ত্রিক বিরোধী দল হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে ১৯৭৬ সালের ২ মার্চ প্রকাশিত এক পুস্তিকায় জাসদ ১৯৭২-৭৫ সালের সরকারের একটা সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করে এভাবে:

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর দীর্ঘ চার বছর শেখ মুজিবের একদলীয় শাসনামলে পরিকল্পনাহীন অবাস্তব অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, দুর্নীতি, অযোগ্যতা, জেল-জুলুম-সন্ত্রাস, অকথ্য নির্যাতন, চোরাকারবার, মজুতদারি, খুন-রাহাজানি, গুন্ডামি এবং ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকা, বিশেষ করে ভারত-রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা গোটা দেশ ও জাতিকে চরম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অরাজকতার মধ্যে ফেলে দেয়। স্বাধীনতা লাভের পরপরই স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা দেশের মানুষের জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার জন্য গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন এবং পরবর্তীকালে মুজিবের স্বৈরাচারী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য স্বৈরাচারবিরোধী সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং দাবিও করা হয়।

 

 

(সূত্র: জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি ।। পৃষ্টা: ২১০-২১২)

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭