ইনসাইড আর্টিকেল

জিয়ার ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতা (পর্ব-৬)


প্রকাশ: 13/11/2023


Thumbnail

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার নেপথ্যে ছিলেন জিয়া। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় জিয়া ছিলেন একজন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার এবং ঠান্ডা মাথার খুনী। তার অপকর্মের কিছু চিহ্ন পাওয়া যায় ‘মহিউদ্দিন আহমদের’ লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শিরোনামে গ্রন্তটি থেকে। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে গবেষণাধর্মী গ্রন্থটির কিছু অংশ ধারাবাহিক প্রকাশ করা হলো:

সরকারি বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে জাসদ ইতিমধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। ছিয়াত্তরের মার্চে রায়হান ফেরদৌস মধুর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের কিছু কথাবার্তা হয়। তৎকালীন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে মধু জানতে চেয়েছিলেন, জিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া করে দিশাহারা জাসদ কর্মীদের বাঁচানোর একটা উপায় বের করা যায় কি না। এখন তো তাদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।' সিরাজুল আলম খান টেবিলে জোরে একটা ঘুষি দিয়ে বললেন, 'কী বলিস, তাহেরের ট্রায়াল শুরু হচ্ছে, গণ- অভ্যুত্থান হয়ে যাবে।' জাসদ নেতৃত্ব এটা কোনোভাবেই বুঝতে পারছিলেন। না, দেয়ালে তাঁদের পিঠ ঠেকে গেছে ।

ছিয়াত্তরের ৩১ মার্চ দেশের সব জায়গায় মিছিল আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এর নাম দেওয়া হলো 'মার্চ মিছিল'। ঢাকার মিছিল প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে একটা দাবিনামা পেশ করবে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। দাবিসংবলিত একটি প্রচারপত্র বিলি করা হলো সারা দেশে। প্রধান দাবিগুলো ছিল:

-ভারত-রাশিয়া-আমেরিকার প্রভাবমুক্ত শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে হবে।

-ফারাক্কা সমস্যার সম্মানজনক সমাধান করতে হবে।

-চীনের সঙ্গে বাস্তব, কার্যকর ও স্থায়ী বন্ধুত্ব স্থাপন করতে হবে।

-নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে।

-সকল রাজবন্দীর মুক্তি দিতে হবে।

-সেপাইদের দাবিগুলো মানতে হবে।

-শ্রমিক-কর্মচারীদের নিম্নতম মাসিক বেতন ৩০০ টাকা ধার্য করতে হবে।

-বর্তমান সামরিক সরকারের পরিবর্তে সর্বদলীয় ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ঘোষণা করা হয়, মিছিল থেকে দুজন প্রতিনিধি, সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ সরকার এবং জাসদ জাতীয় কমিটির সহসভাপতি এহসান আলী খান রাষ্ট্রপতির কাছে দাবিনামা পেশ করবেন। প্রচারপত্রটি ছাপা হয় জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ ও বিপ্লবী গণবাহিনীর যৌথ নামে।

পুলিশ ও সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী ‘মার্চ মিছিল’টি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মিছিলটি ছিল শান্তিপূর্ণ। ছয় শতাধিক নেতা- কর্মীকে মিছিল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১০ মে রাজশাহী জেল থেকে রাষ্ট্রপতি সায়েমকে লেখা এক চিঠিতে আবু তাহের '৭ নভেম্বরের সকালে গৃহীত নীতিমালা মেনে চলার আহ্বান জানান। তিনি সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি এবং ১৯৭৬ সালের অক্টোবরের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান ।

জাসদ ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। এই দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে 'দেশদ্রোহিতা' ও 'অরাজকতা' সৃষ্টির অভিযোগ এনে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল। গ্রেপ্তারকৃত ও পলাতক নেতাদের 'প্রহসনের বিচার' ও দলকে বেআইনি ঘোষণার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এ সময় পার্টি একটি মূল্যায়নের চেষ্টা করে এবং কিছুটা পিছু হটার' কৌশল নেয়। সাম্যবাদ-এর ষষ্ঠ সংখ্যায় একটি বিশ্লেষণে বলা হয় :

এমতাবস্থায় রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে গায়ে পড়ে কোনোরূপ শক্তি পরীক্ষায় যাওয়া আমাদের উচিত হবে না, উচিত হবে না এমন কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা, যাতে শত্রুরা অপপ্রচারের সুযোগ পায় এবং সে অপপ্রচারের দরুন জনগণেরও মনে হতে পারে যে জাসদ বুঝি সত্যি সত্যিই ঐক্যবিরোধী এবং জাসদই বুঝি গণতন্ত্র, নির্বাচন ও শান্তির অন্তরায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের আজকের প্রধান দায়িত্বই হচ্ছে জনগণের মধ্য থেকে বুর্জোয়া গণতন্ত্র-সম্পর্কিত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রধানত নিঃশেষ করে আনা ।....

প্রসঙ্গত উল্লেখ থাকা প্রয়োজন, সর্বপ্রকার সন্ত্রাসবাদী ঝোঁক ও বেধড়ক খতম অভিযানের প্রবণতা চূড়ান্ত বিচারে অমার্ক্সবাদী ও বিপ্লবের পক্ষে ক্ষতিকর বিধায় আমাদের এরূপ ঝোঁক ও প্রবণতা থেকে সর্বদাই মুক্ত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, চাপিয়ে দেওয়া হামলাকে মোকাবিলা করা এক কথা, কিন্তু খতম অভিযান, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা ইত্যাদির মাধ্যমে মোকাবিলাকে ডেকে নিয়ে আসা ভিন্ন কথা বিশ্বের দেশে দেশে সন্ত্রাসবাদীরা, নিহিলিস্ট-নারদনিকেরা চরমতম মূল্যের বিনিময়ে যে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেআমরা কোনোক্রমেই তার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারি না।

ছিয়াত্তরের ২১ জুন সামরিক সরকার জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ৩৩ জনের বিরুদ্ধে একটি গোপন বিচার-প্রক্রিয়া শুরু করে। এঁদের মধ্যে ১৬ জন ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরিরত। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাঁদের অভিযুক্ত করা হয়। মামলার শিরোনাম ছিল 'রাষ্ট্র বনাম মেজর জলিল ও অন্যান্য'। অভিযুক্তরা ছিলেন মেজর এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, লে. কর্নেল আবু তাহের, হাসানুল হক ইনু, আনোয়ার হোসেন, আবু ইউসুফ খান, রবিউল আলম সরদার, সালেহা বেগম, মোহাম্মদ শাজাহান, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখলাকুর রহমান, কে বি এম মাহমুদ, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, আনোয়ার সিদ্দিক, মেজর জিয়াউদ্দিন, নায়েব সুবেদার বজলুর রহমান, হাবিলদার মেজর সুলতান আহমদ, নায়েব সুবেদার আবদুল লতিফ আখন্দ, নায়েক সিদ্দিকুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট কাজী রোকন উদ্দিন, সার্জেন্ট কাজী আবদুল কাদের, সায়েন্টি সৈয়দ রফিকুল ইসলাম, করপোরাল শামসুল হক, করপোরাল আবদুল মঞ্জিল, হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, হাবিলদার শামসুদ্দিন, সিরাজুল আলম খান, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মহিউদ্দিন, হাবিলদার বারেক, নায়েক আবদুল বারী, নায়ের সুবেদার জালাল ও করপোরাল আলতাফ হোসেন। অভিযুক্তদের মধ্যে সাতজন ছিলেন 'পলাতক'। এ ছাড়া সাতজন রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন হাবিলদার আবদুল বারী, করপোরাল ফকরুল আলম, করপোরাল মোজাম্মেল হক, করপোরাল মোয়াজ্জেম হোসেন, লিডিং ক্রাফটম্যান জোবায়ের আনসারী, সিপাহি মইনউদ্দিন এবং নায়েব সুবেদার মাহবুব। সালেহা বেগম ছিলেন অভিযুক্তদের মধ্যে একমাত্র নারী। তিনি একসময় যশোর জেলা ছাত্রলীগের সভানেত্রী ছিলেন। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা অভিযোগ আনা হয়েছিল।

কর্নেল ডি. এস ইউসুফ হায়দারকে চেয়ারম্যান করে পাঁচ সদস্যের একটি সামরিক আদালত গঠন করা হয়। আদালতের অন্য সদস্যরা ছিলেন কমাণ্ডার সিদ্দিক আহমদ, উইং কমান্ডার মোহাম্মদ আবদুর রশীদ, ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল আলী এবং ম্যাজিস্ট্রেট মো. হাসান মোরশেদ।

সরকারপক্ষের কৌঁসুলি ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ টি এ আফজাল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল ওহাব এবং পিপি আবদুর রাজ্জাক। অভিযুক্তদের পক্ষে ১৬ জন আইনজীবী ছিলেন। তাঁরা হলেন আতাউর রহমান খান, জুলমত আলী খান, কে জেড আলম, আমিনুল হক মো. জিনাত আলী, এ কে মুজিবুর রহমান, সিরাজুল হক, মহিউদ্দিন আহমেদ, আবদুর রউফ, কাজী শাহাদাত হোসেন, শরফুদ্দিন চাকলাদার, খাদেমুল ইসলাম, আবদুল হাকিম, শামসুর রহমান, শরফুদ্দিন ভূঁইয়া এবং এ ডি এম কামরুল ইসলাম। আদালত বসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে। প্রথম দিন রোল কল হয়। দুবার নাম ডাকা সত্ত্বেও সার্জেন্ট রফিকুল ইসলাম সাড়া দেননি। তখন একজন তাঁকে চিনিয়ে দিলে তিনি বলেন, 'আমার নাম ঠিকভাবে ডাকা হয়নি বলে আমি জবাব দিইনি।' চেয়ারম্যান বললেন, 'আপনার নাম তো সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। রফিক জবাবে বললেন, 'না, আমার নাম সৈয়দ রফিকুল ইসলাম বীর প্রতীক। পুরো নাম না বললে আমি জবাব দেব না।' আদালত তাঁর দাবি মেনে নেন।

দ্বিতীয় দিনেও গোলমাল হলো। সার্জেন্ট রফিক এফআইআর দেখতে চাইলেন। যখন আদালত থেকে বলা হলো, এটা এখন সরবরাহ করা যাবে না, তখন সার্জেন্ট রফিক বললেন, 'তাহলে আমাকে যেতে দিন, আমি আমার সেলে গিয়ে বিশ্রাম নেব। চেয়ারম্যান রেগে গিয়ে বললেন, 'শাট আপ অ্যান্ড সিট ডাউন। সার্জেন্ট রফিক চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে জুতা ছুড়ে মারলেন। দেখাদেখি আরও কয়েকজন জুতা ছুড়লেন। রব পৌঁড়ে দরজার কাছে গিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করলেন। আদালতের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা দৌড়ে পালালেন। ওই দিনের মতো আদালত পণ্ড হয়ে গেল। পরদিন থেকে তাঁদের আদালতকক্ষে খালি পায়ে হাতকড়া পরিয়ে আনা হলো। এভাবেই চলতে থাকল আদালতে আসা-যাওয়া। অভিযুক্ত ও বিচারকদের বসার জায়গার মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হলো। আদালত চলার সময় অভিযুক্তরা এমন ভাব করতেন, যেন তাঁরা কোনো জায়গায় বসে আড্ডা দিচ্ছেন। এই 'অবৈধ আদালতের কার্যক্রমের ব্যাপারে তাঁদের কোনো আক্ষেপ ছিল না। হয়তো কেউ কারও কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকেন, কেউ-বা আপন মনে গলা ছেড়ে গান ধরেন:

মা, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে

তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি...

আদালতে মামলা শুরু হওয়ার দু-তিন দিন পর এমন একটা ঘটনা ঘটল, যা ব্যাখ্যার অতীত। আখলাকুর রহমানের সঙ্গে সার্জেন্ট সৈয়দ রফিকুল ইসলামের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি সার্জেন্ট রফিককে ডেকে বললেন, "ওবা, কর্নেল তাহেরের তো ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট অইব।' রফিক বিস্মিত হলেন, এই মামলায় এ ধরনের সাজা হতেই পারে না। তিনি আখলাকুর রহমানকে বললেন, "আফনে কী কন? এইডা অসম্ভব। অইতেই পারে না। আখলাকুর রহমান আপন মনেই বলে উঠলেন, 'সুলতান ফকির কইছেন। সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থানার রূপগুলি গ্রামের জনৈক সুলতান গুড়ির জেলগেটে আখলাকুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে এই কথা বলে গেছেন। সার্জেন্ট রফিক ভেবে পেলেন না, তার বাড়ির পাশের গাঁয়ের এই ফকিরকে তিনি চেনেন না, অথচ সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের আখলাকুর বহমান কী করে এই ফকিরের খোঁজ পেলেন? সিলেটের কিংবদন্তি সাধক শাহ নাসিরউদ্দিনের বংশধর আখলাকুর রহমান মনে করতেন, সুলতান ফকির জালালির মধ্য দিয়ে হজরত শাহজালালের পুনর্জন্ম হয়েছে।

 

 

(সূত্র: জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি ।। পৃষ্টা: ২১৩-২১৯)



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭