ইনসাইড আর্টিকেল

জিয়ার ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতা (পর্ব-৬)


প্রকাশ: 14/11/2023


Thumbnail

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার নেপথ্যে ছিলেন জিয়া। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় জিয়া ছিলেন একজন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার এবং ঠান্ডা মাথার খুনী। তার অপকর্মের কিছু চিহ্ন পাওয়া যায় ‘মহিউদ্দিন আহমদের’ লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শিরোনামে গ্রন্তটি থেকে। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে গবেষণাধর্মী গ্রন্থটির কিছু অংশ ধারাবাহিক প্রকাশ করা হলো:

১৬ জুলাই বিকেলে তাহের করপোরাল মজিদকে তাঁর সেলে ডেকে নিলেন। বললেন, 'আমাদের অনেক ভুলভ্রান্তি হয়েছে। নেক্সট টাইম আমরা আরও কেয়ারফুল হব । এয়ারফোর্সকে রি-বিল্ড করতে হবে। ছিয়াত্তরের ১৫ জুলাই রায় ঘোষণার কথা ছিল। রায় দেওয়া হলো ১৭ জুলাই। রায় ঘোষণার সময় অভিযুক্তরা সবাই হইচই, চিৎকার করছিলেন এ রায়ে তাহের, জলিল ও আবু ইউসুফের ফাঁসির আদেশ হয়। পরে রায় সংশোধন করে জলিল ও ইউসুফকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন (১২ বছর), আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু ও আনোয়ার হোসেন (প্রত্যেকের ১০ বছর), সিরাজুল আলম খান, করপোরাল আলতাফ হোসেন ও করপোরাল শামসুল হক (প্রত্যেকের সাত বছর), নায়েব সুবেদার মোহাম্মদ জালালউদ্দিন, হাবিলদার এম এ বারেক, রবিউল আলম, সালেহা বেগম ও নায়েক সিদ্দিকুর রহমান (প্রত্যেকের পাঁচ বছর) এবং হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার ও করপোরাল আবদুল মজিদ (প্রত্যেকের এক বছর)। কারাদণ্ডের সঙ্গে তাঁদের প্রত্যেককে বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা এবং অনাদায়ে তিন মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত অতিরিক্ত কারাবাসের আদেশ দেওয়া হয়। যাঁরা 'বেকসুর খালাস' পান, তাঁদের মধ্যে ছিলেন আখলাকুর রহমান, আনোয়ার সিদ্দিক, মহিউদ্দিন, নায়েব সুবেদার বজলুর রহমান, মাহমুদুর রহমান মান্না, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, মো. শাজাহান, কে বি এম মাহমুদ, আম্বিয়া, হাবিলদার সুলতান হামিদ, নায়েক আবদুল বারী, সার্জেন্ট কাজী আবদুল কাদের, কাজী রোকনউদ্দিন, নায়েব সুবেদার আবদুল লতিফ আখন্দ, নায়েক শামসুদ্দিন ও সার্জেন্ট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। আদালতের শুনানির ওপর কোনো রকমের তথ্য বাইরে প্রকাশ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ২১ জুলাই ভোর চারটায় তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

তাহের ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, প্রাণবন্ত ও আশাবাদী। রায় ঘোষণার পর থেকে তাকে কখনো মন করতে দেখা যায়নি। তিনি যখন ফাঁসির মঞ্চের দিকে হেঁটে যান, তখনো তিনি ছিলেন দৃপ্ত, অবিচল।

'ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলার রায় মানি না'- এই স্লোগান ব্যবহার করে জাসদ ৩১ জুলাই হরতাল আহ্বান করে। হরতাল সফল করার জন্য ঢাকা নগর গণবাহিনীর কয়েকটি ইউনিটের সদস্যরা প্রস্তুতি নেন। কামরাঙ্গীরচরে হুসেনের ঘরে বাদল, মুশতাক, ইদ্রিস, ইয়াকুব এবং আরও কয়েকজন ৩০- ৪০টি 'নিখিল' বানিয়েছিলেন। একটাও ফাটেনি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তপন কুমার সাহা জুরাইনের একটি বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে নিহত হন। ঘটনাটি ছিল খুবই মর্মান্তিক ।

৩১ জুলাই কোথাও হরতাল হয়নি। জাসদ সমাজ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অনেক জায়গায় কর্মীরা কোনো শেল্টার পাচ্ছেন না। কোথাও কোথাও জনতা তাঁদের ধরে পুলিশে সোপর্দ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণবাহিনীর সদস্য আবু আলম শহীদ খান গুলিস্তান ভবনে চলচ্চিত্র নির্মাতা কাজী জহিরের অফিসে চাঁদা আনতে গেলে অফিসের কর্মচারীরা তাঁকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন। জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও গণসংযোগ সম্পাদক শাহ আলম মগবাজারে চীনা দূতাবাসের একটি অফিসে প্রচারপত্র দিতে গেলে দূতাবাসের কর্মচারীরা তাঁকে ধাওয়া করেন । তিনি দেয়াল টপকে কোনোমতে পালাতে সক্ষম হন।  সময়টা বৈরী। চারদিকে পরাজয় ও হতাশা। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। যে তারুণ্যের শক্তি নিয়ে জাসদ একদিন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, চার বছরের মাথায় তা প্রায় নিঃশেষিত।

 

 

তাহেরের ফাঁসি নিয়ে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় মাথা ঘামায়নি। দলের তরুণদের কাছে এটা ছিল একটা ভীষণ দুঃখজনক ঘটনা। রায়হান ফেরদৌস মধুর উদ্যোগে একটা কবিতা সংকলন বের করা হলো। তাহেরকে নিয়ে লিখলেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মাশুক চৌধুরী, অসীম সাহা, আবু করিম, মোহন রায়হান প্রমুখ। অসীম সাহার একটা কবিতার কয়েকটা লাইন ছিল এরকম :

তাহের তাহের বলে ডাক দিই

ফিরে আসে মৃত্যুহীন লাশ

কার কণ্ঠে বলে ওঠে আকাশ বাতাস

বিপ্লব বেঁচে থাক তাহের সাবাশ।

 

এই মামলায় যাঁরা খালাস পেয়েছিলেন, তাঁদের অনেককেই দীর্ঘদিন জেলে বন্দী রাখা হয়েছিল বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে। এঁদের একজন ছিলেন সার্জেন্ট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম। তাঁকে কখনো এক মাস, কখনো ১৫ দিন, কখনো বা এক সপ্তাহের আটকাদেশ দিয়ে আটকে রাখা হতো। ষোলো মাস পর সাতাত্তর সালের নভেম্বরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।

৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান, জাসদ-গণবাহিনীর হঠাৎ জড়িয়ে পড়া, জিয়ার সঙ্গে তাহেরের সখ্য এবং পরিণামে প্রতারণার শিকার হওয়া এসব দলের মধ্যে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। এ ছাড়া তাহেরের আগবাড়িয়ে জিয়াকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, এমনকি রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া নিয়েও বিতর্ক হয় । জাসদের মতো একটা গণমুখী রাজনৈতিক গণসংগঠনের এরকম 'সামরিকীকরণ' কতটুকু কাঙ্ক্ষিত ছিল, এ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়। এসব বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা হয়। পঁচাত্তরের ডিসেম্বরে দলের এক মূল্যায়নে বলা হয়:

৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে কোনো প্রকার সরকারি আদেশ ব্যতীতই বিপ্লবী সিপাহি ও বিপ্লবী গণবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার পেছনে একটিমাত্র যুক্তি ছিল তা হলো, নিদেনপক্ষে জিয়াউর রহমান হয়তো বা এত তাড়াতাড়ি কোনো বিদেশি শক্তির কাছে মাথা নত করবেন না, আত্মমর্যাদা বিকিয়ে নেবেন না- বিপ্লবী সিপাহিসহ সাধারণ জনতার ওপর এত শিগগির অত্যাচারের স্কিম রোলার চালাবেন না, অন্তর্বর্তীকালীন গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করবেন এবং অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে কিছুটা হলেও শিক্ষা গ্রহণ করবেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কয়েক ঘন্টা পরই জিয়াউর রহমান ও তাঁর সঙ্গীরা বেমালুম ভুলে গেলেন তাঁদের চার দিনের বন্দিজীবনের কথা।

জিয়া ও তাহেরের সম্পর্কের বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। এ নিয়ে তাহেরের মনোভাব সামরিক আদালতে দেওয়া তাঁর জবানবন্দিতে কিছুটা উঠে এসেছে সত্য, কিন্তু এটা ছিল অনেক পরে বিচার চলার সময়ের মন্তব্য। নভেম্বরের ওই মুহূর্তে তাহেরের মনে কী ছিল, তা জানার তেমন কোনো উপায় নেই। এ বিষয়ে তাহের সংসদের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি অধ্যাপক আহমদ শরীফের প্রশ্ন ছিল :

কর্নেল তাহের সম্বন্ধে আমার একটা জিজ্ঞাসা রয়েই গেল। তা এই, কর্নেল তাহের সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান বলে প্রচার করলেও মূলত এ অবসেনানী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সৈন্যদের প্রভাবিত করে তাদের দিয়েই ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট দখল করান। সিপাহি জনতার জাসদী (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) নেতা কেন পাকিস্তান ও ইসলাম পছন্দ' জিয়াউর রহমানের উপর আস্থা রাখলেন, আর কেনই বা সিআইএ এজেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদকেযিনি ট্রেইটর সর্বার্থে ও সর্বাত্মকভাবে, তাঁকে বা-ইজ্জত স্বরে নিরাপদে বাস করার সুযোগ দিলেন, হত্যা না করে, হাজতে না পাঠিয়ে বিচারের ব্যবস্থা না করে।

 

 

(সূত্র: জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি ।। পৃষ্টা: ২১৯-২২২)



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭