লিট ইনসাইড

নোবেল জয়ের ১১০ বছর, যেভাবে ইতিহাসকে অলঙ্কৃত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ


প্রকাশ: 15/11/2023


Thumbnail

বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রোটেনস্টাইন ১৯১০ সালে কলকাতায় আসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবি দেখতে তিনি উপস্থিত হন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। সেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয় কবিগুরুর। উইলিয়াম রোটেনস্টাইন কবির একটি ছবি আঁকেন। সেই সময় থেকেই এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়।

১৯১২ সালে ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতার ইংরেজিতে অনুবাদ করা ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্প। উইলিয়াম রোটেনস্টাইন সেই লেখা পড়ে অবাক হয়ে যান। এর আগে পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন সাহিত্য কর্ম সম্পর্কে পরিচিত ছিলেন না।

এরপর উইলিয়াম রোটেনস্টাইনের অনুরোধে বিখ্যাত শিক্ষক অজিত চক্রবর্তী মহাশয় কবির কিছু লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করে তার কাছে পাঠান। আরো অবাক হন উইলিয়াম রোটেনস্টাইন। তাকে কবিগুরু সাহিত্য চর্চা সম্পর্কে লন্ডনে বিশদে জানান প্রমথলাল সেন ও ব্রজেন্দ্রনাথ শীল।

এরপরই উইলিয়াম রোটেনস্টাইনের আমন্ত্রণে লন্ডন পাড়ি দেন কবি। জাহাজে তিনি গীতাঞ্জলি-এর কিছু কবিতা অনুবাদ করেন। সঙ্গে অনুবাদ করেন শিলাইদহে বসে তার লেখা আরও কিছু  কবিতা। সেই কবিতা পড়ে অভিভূত হন উইলিয়াম রোটেনস্টাইন। তিনি কবির খাতাটি পাঠান আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসসহ একাধিক সাহিত্য সমালোচককে। তিনি জর্জ বার্নডশ’কে চিঠি লিখে কবিগুরুর কবিতা পড়ার অনুরোধ জানান। লন্ডনে এক সাহিত্য সভায় মিলিত হন কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসসহ বেশ কিছু কবি সাহিত্যিক ও লেখক। কবিগুরুর অনুবাদ করা কবিতাগুলি শুনে তারা একের পর এক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাঠাতে থাকেন। এক দিনেই লন্ডনের সাহিত্য মহলে ছড়িয়ে পরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নাম।

নোবেল কমিটির নিয়ম অনুসারে নোবেল পুরস্কারের জন্য নাম সুপারিশ করতে পারেন বিভিন্ন দেশের স্বীকৃত সংস্থার সভ্যরা অথবা কোন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তি। কবিগুরুর কবিতা পড়ে মুগ্ধ হওয়া স্টার্জমুর মহাশয় ছিলেন রয়েল সোয়াইটি অব লিটারেচার অব ইউ কে-এর সদস্য। তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য কবিগুরুর নাম সুপারিশ করেন। কিন্তু এ কথা কবিগুরুও জানতেন না। সম্পূর্ণ গোপনে কবির নাম সুপারিশ করেন স্টার্জমুর।

বিভিন্ন দেশ থেকে আরও ২৮ জনের নামে সেই বছর সুপারিশ এসেছিল। সুইডিশ একাডেমির সদস্য হলেও স্টার্জমুর-এর হাতে ছিল একমাত্র গীতাঞ্জলি-এর অনুবাদ করা বইটি। তৎকালীন নোবেল কমিটির সভাপতি হোয়ানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামের বিরোধিত করে বলেন, একটি মাত্র বই দেখে বিচার করা সম্ভব নয়।

নোবেল কমিটিতে ছিলেন প্রাচ্যবিদ এসাইস টেঙ্গার। তিনি বাঙলা ভাষা জানতেন। তিনি কমিটির সদস্যদের প্রভাবিত করেন। সুইডিশ কবি হাইডেস্টাম গীতাঞ্জলি-এর সুইডিশ অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে নোবেল কমিটিকে চিঠি লেখেন। অবশেষে ১৯১৩ সালে নোবেল কমিটির বিচারে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ঘোষিত হয়।

নোবেল প্রাপ্তির খবর কলকাতায় প্রথম ছাপে ইংরেজি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা ‘এম্পায়ার’। ১৩ তারিখ নোবেল-পুরস্কার কমিটি কবির নাম ঘোষণা করার পর, স্টকহোমের রয়টার প্রতিনিধি খবরটি প্রথম ‘ব্রেক’ করেন। নিউইর্য়ক ইভনিং পোস্টে সে খবর প্রকাশিত হয়। রয়টারের খবর আসে পরের দিন, ১৪ নভেম্বর সকাল ৯টায়। ততক্ষণে সেদিনের কাগজ ছাপা হয়ে বেশিরভাগ বিক্রিও হয়ে গিয়েছে! সে দিনের ‘এম্পায়ার’ দেখেই শোরগোল পড়ে সন্ধেরাতের শহরে।

রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পর সমকালীন অনেক লেখক তাকে শুভেচ্ছাবার্তা জানাতে থাকেন। সেই সময় নোবেলের মত এমন সম্মানসূচক পুরস্কার প্রাপ্তির কারণে পুরো ভারতবর্ষের বাঙালি লেখকেরা আবেগের জোয়ারে ভাসতে শুরু করেন।

শোরগোলের কথা জানিয়েছেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে সীতা দেবী। ‘পুণ্যস্মৃতি’-র পাতায় তিনি লিখছেন, ‘‘কলেজ হইতে ফিরিবামাত্র শুনিলাম যে রবীন্দ্রনাথ Nobel Prize পাইয়াছেন। কলিকাতা শহরে মহা হৈ চৈ বাধিয়া গেল। শুনিলাম কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম কবিকে এই খবর টেলিগ্রামে জানাইতে গিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে টেলিগ্রাম লিখিতে জানিতেন না, অন্য কাহাকেও দিয়া লিখাইতে গিয়া দেরি হইয়া গেল, তাঁহার আগেই আর-একজন টেলিগ্রাম পাঠাইয়া দিলেন।’’

সে সময় প্রমথনাথ বিশী শান্তিনিকেতনের ছাত্র। ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’-এ তিনি লিখছেন, ‘‘শীতের প্রারম্ভে নূতন-ওঠা বেগুনভাজা পরিবেশিত হইয়াছে... সহসা অজিতকুমার চক্রবর্তী রান্নাঘরে ঢুকিয়া চীৎকার করিয়া বলিলেন, ‘গুরুদেব নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।’’

আমেরিকানদের পত্রপত্রিকায় তাকে বলা হয়েছে হিন্দু কবি, যদিও কোথাও কোথাও ছাড় দেওয়া হয়েছে এই বলে যে, যাই হোক ওই কবি একজন আর্য বটেন, সেই বিবেচনায় সাদা আমেরিকানদের সঙ্গে একেবারেই যে সম্পর্কহীন তা নয়। পরে অবশ্য তার বক্তৃতা শুনে ও রচনা পাঠ করে তাঁরা না মেনে পারেন নি যে, রবীন্দ্রনাথ মোটেই অবজ্ঞেয় নন।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭