ইনসাইড বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ কালজয়ী মহামানব রণদা প্রসাদ সাহা


প্রকাশ: 16/11/2023


Thumbnail

মাত্র সাত বছর বয়সে রণদার চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু হয়। বিনা চিকিৎসায় আর অবহেলায় মারা যায় মা। উচ্ছল শৈশব থমকে যায় মার অকাল মৃত্যুতে। ডানপিটে বালক জীবনের কঠিনতম সময়ে শুরু করেন তখন থেকেই। এই মৃত্যুই সাত বছরের বালকের জীবনের দর্শন বদলে দেয়।

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার (আর পি সাহা) ১২৭ তম জন্মদিন আজ। ১৮৯৬ সালের এই দিনে তিনি সাভারের কাছৈড় গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

বাবা দেবেন্দ্র পোদ্দার দ্বিতীয় বিয়ে করার পর রণদাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মামাবাড়িতে। মাত্র ১১ বছর বয়সে মামাবাড়ি থেকে পালিয়ে যান। একদিন রণদা প্রসাদ ক্ষুধার যন্ত্রণায় এক বনের ধারে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন। ওই সময়ে মুক্তাগাছার জমিদার রাজা জগৎ কিশোর চৌধুরী সেই বনে শিকার করতে আসেন এবং অচেতন অবস্থায় রণদা প্রসাদকে উদ্ধার করে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন।

মুক্তাগাছার জমিদারবাড়িতে কয়েক বছর অবস্থান করে রণদা জমিদারবাড়ির লোকজনের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার এবং শিল্প-সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে পরিচিত হন, পরবর্তী জীবনে যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই।

১৯১৪ সালে বিশ্বে মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নেতা সুরেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিপ্লবীদের আহ্বান জানালেন ইংরেজদের হয়ে বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করার জন্য। স্বেচ্ছাসেবী বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের হয়ে যুদ্ধে নামলেন রণদা প্রসাদ সাহা। ব্রিটিশ সেনাদের তখন দারুণ খাদ্যাভাব, নানা রোগে আক্রান্ত তারা। রণদা আহত সৈনিকদের সেবায় একেবারে ডুবে গেলেন। তিনি শক্রর চোখ এড়িয়ে সবার জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতেন।

ব্রিটিশ সরকার প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা ভারতীয়দের সবাইকে যোগ্যতা অনুসারে চাকরি দিয়েছিল। লেখাপড়া সামান্য হলেও যুদ্ধে তার অবদানের কথা বিবেচনা করে রেলওয়ের কালেক্টরের চাকরি দেওয়া হয়েছিল রণদা প্রসাদকে। কর্মস্থল ছিল সিরাজগঞ্জ থেকে শিলাইদহ। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়ার কারণে ১৯৩২ সালে এই চাকরিতে ইস্তফা দেন তিনি। ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে টাকা পান তা দিয়ে শুরু করেন কয়লার ব্যবসা। প্রথমে বাড়ি বাড়ি কয়লা সরবরাহ, পরে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কয়লা সরবরাহের কাজ করেন রণদা প্রসাদ।

নৌযান ব্যবসা বেশ লাভজনক দেখে প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি। একসময় এই কোম্পানিতে ৭৫টি বড় বড় পণ্যবাহী জাহাজ ছিল। মূলত নৌপরিবহন ব্যবসার মাধ্যমেই রণদা প্রসাদ সাহা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও আর পি সাহা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ সাল মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই আর পি সাহা একজন ধনী, সম্পদশালী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের প্রথম দিকে আর পি সাহা জর্জ অ্যান্ডারসন কোম্পানির সব জুট বেলিং ও প্রেসিং মেশিন, সব পাটের ব্যবসা, কোম্পানির প্রায় ১০০ একর জায়গাসহ যাবতীয় সম্পত্তি কিনে নেন। খানপুরে অবস্থিত অ্যান্ডারসন কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ই আজ কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রধান কার্যালয়।

১৯৪৩ সালে সারা দেশে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে আর পি সাহা ২৭৫টি লঙ্গরখানা খুলে টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জের অভুক্ত ও বিপন্ন মানুষের প্রায় আট মাস খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন। মানবসেবার এই স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতবর্ষের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়াভেল ১৯৪৪ সালের ৮ জুন রণদা প্রসাদ সাহাকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করেন।

পাকিস্তানের বর্বর হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা ১৯৭১ সালের ৭ মে কুমুদিনীর প্রধান কার্যালয় খানপুর থেকে রণদা প্রসাদ সাহা ও তাঁর একমাত্র কর্মক্ষম পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর আর তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে, নানান ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে রণদা প্রসাদ নিজ কর্মগুণে যে বিশাল সম্পদের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন তার পুরোটাই ব্যক্তিগত ভোগে খরচ না করে মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করে গেছেন। রণদার উত্তরসূরিরা মানবতার সেবার পরিধি বাড়িয়েছে বহুগুণ।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭