ইনসাইড আর্টিকেল

জিয়ার ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতা (পর্ব-৮)


প্রকাশ: 16/11/2023


Thumbnail

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার নেপথ্যে ছিলেন জিয়া। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় জিয়া ছিলেন একজন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার এবং ঠান্ডা মাথার খুনী। তার অপকর্মের কিছু চিহ্ন পাওয়া যায় ‘মহিউদ্দিন আহমদের’ লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শিরোনামে গ্রন্তটি থেকে। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে গবেষণাধর্মী গ্রন্থটির কিছু অংশ ধারাবাহিক প্রকাশ করা হলো:

৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের 'ব্যর্থতার' কারণ নিয়ে পরে অনেক আলোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। আনোয়ার হোসেনের ভাষ্য অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের সামরিক প্রস্তুতি যথেষ্ট থাকলেও রাজনৈতিক প্রস্তুতি ছিল না। প্রকারান্তরে তিনি জাসদ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ আনেন।

৬ নভেম্বর কর্নেল তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে নিয়ে যখন অভ্যুত্থানের সামরিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে ফেলেছেন, তখনো জাসদ নেতৃবৃন্দ ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও গণবাহিনীকে রাস্তায় নামানোর প্রাথমিক প্রস্তুতিও নেননি। ঢাকা শহর গণবাহিনীর অধিনায়ক আমি। সরাসরি হাসানুল হক ইনুর অধীনে। তার কাছ থেকেই দলীয় নির্দেশ পেতাম। সে সময় ঢাকায় আমার নেতৃত্বে গণবাহিনীর প্রায় ছয়শত নিয়মিত সদস্য। হাসানুল হক ইনুর কাছ থেকে নির্দেশ চাচ্ছিলাম গণবাহিনীকে সক্রিয় করার। তিনি জানালেন, আপাতত তাদের অভ্যুত্থান সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। শুধু আঞ্চলিক কমান্ডারদের সতর্ক থাকতে বললেন। তার এ সিদ্ধান্তের কারণে শহর গণবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডারদের পর্যন্ত অভ্যুত্থান সম্পর্কে কিছুই জানানো গেল না।....তাহেরকে বলা হয়েছিল ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও গণবাহিনী পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি সহকারে ময়দানে থাকবে। সৈন্যরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে গণবাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্র করবে। ছাত্ররা থাকবে প্রচারের দায়িত্বে এবং শ্রমিকেরা নিয়ন্ত্রণ করবে রাজপথ। এসব আমি জেনেছি পরে। গোপন বিচার চলাকালে। নেতৃত্ব চাইলে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো শক্তি তখন জাসদের ছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নেতৃত্ব কিছুই করলেন না। কিংবা এমনও হতে পারে যে, তারা শুধু পরিকল্পনার সামরিক অংশটুকু বাস্তবায়নকেই যথেষ্ট মনে করেছেন।

জিয়াকে নিয়ে তাহের যে জুয়া খেলেছিলেন, তার মূল্য যে শুধু তিনি দিয়েছেন, তা নয়। মূল্য দিতে হয়েছে পুরো দলকে, জাসদের হাজার হাজার কর্মীকে। অনেককে পলাতক জীবন বেছে নিতে হয়। কিছু কিছু ষড়যন্ত্রও হয়। চক্রান্ত করে সিরাজুল আলম খানকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল ঢাকা নগর জাসদের কোষাধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধে। ঢাকা নগর গণবাহিনীর হাইকমান্ড তাঁর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। ছিয়াত্তরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশ দিয়ে রিকশায় চড়ে যাওয়ার সময় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয় ।

পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির (সিওসি) এক বর্ধিত সভা ছিয়াত্তরের ২৬-৩১ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিগত দিনগুলোর কার্যক্রম এবং এর সাফল্য-ব্যর্থতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। আলোচনায় যে বিষয়গুলো বেরিয়ে আসে, তা বিশেষ বিভ্রান্তি' শিরোনামে সদস্যদের মধ্যে প্রচার করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়:

আমাদের পার্টির সংগঠন ও গণসংগঠনের মধ্যে মারাত্মক ধরনের স্থবিরতা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। স্থবিরতার অর্থই হলো গতিহীনতা। গতিহীনতা সৃষ্টির মূল কারণ হলো সংগঠনের ভেতরে দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের অভাব ।... মনে রাখতে হবে, অন্ধবিশ্বাস প্রবণতা যেমন মার্ক্সবাদ নয়, ঠিক তেমনি শুধু প্রয়োগও মার্ক্সবাদ নয়।...

গণসংগঠন সমূহে স্থবিরতা নেমে আসার মূল কারণ হিসেবে আমরা লক্ষ করেছি গণসংগঠন সমূহের নিজ নিজ স্বাধীন অস্তিত্বের ক্রমবিলুপ্তি এবং ক্রমবর্ধমান হারে পার্টি সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি মাত্রাতিরিক নির্ভরশীলতা, পরস্পরের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের অভাব, কর্মীদের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অপারগতা, গণসংগঠনসমূহের বাস্তব, স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত ভূমিকার অনুপস্থিতি ইত্যাদি।

নেতৃত্বে বর্তমান কাঠামো (সর্বস্তরের) যথোপযুক্ত ও পর্যাপ্ত নয়। তাই এই বৈঠক আগামী কাউন্সিল সভার অনুমোদন সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি, স্ট্যান্ডিং কমিটি ও জরুরি স্ট্যান্ডিং কমিটিকে বাতিল ঘোষণা করে। সকল পর্যায়ের ফোরামসমূহও বাতিল ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন ফ্রন্টসমূহের সমন্বয় সাধনের জন্য বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে প্রতিনিধি নিয়ে সর্বস্তরে কেবলমাত্র একটি করে সমন্বয় কমিটি' গঠন করার সুপারিশ করা হয়। এই পার্টিকে বর্তমান স্থবিরতা ও অস্থিরতার হাত থেকে রক্ষা করে গতিশীল ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য বর্তমান উপলব্ধির ভিত্তিতে সংগঠনের একজন সদস্যের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করে। তিনি এ ব্যাপারে যেকোনো সদস্যের সহযোগিতা নিতে পারবেন এবং যেকোনো দায়িত্ব যেকোনো সদস্যের ওপর অর্পণ করতে পারবেন।...

৩১ তারিখে যে বর্ধিত সভায় 'একজন সদস্যের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত’ সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়, তিনি ওই দিন সভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। পরে তাঁর সভাপতিত্বে ২৩ সদস্যবিশিষ্ট এক সভায় তিনি 'একজন সদস্যের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত' বিষয়কে তাত্ত্বিক দিক থেকে অপর্যাপ্ত ও ভিত্তিহীন মনে করেন। তাই প্রশ্নটিকে সংগঠনের সর্বস্তরে মতামতের জন্য খসড়া প্রস্তাব হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে 'পরিচালনা পরিষদ' গঠন না করে সব ফ্রন্ট থেকে প্রতিনিধি নিয়ে একটি 'কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি' গঠন করা হবে উপরিউক্ত ব্যবস্থাসমূহ তিন মাসের জন্য কার্যকর থাকবে। এই সময়ের মধ্যে বা অনুরূপ কোনো সময়ের মধ্যে সত্যিকার প্রতিনিধিত্বমূলক কাউন্সিল আহ্বান করা হবে এবং সামগ্রিক অবস্থার পূর্ণ পর্যালোচনা করে সমস্ত বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

এই সিদ্ধান্তগুলোর ওপর লিখিত মতামত আগামী ৩০ নভেম্বরের মাধ্য কেন্দ্রের কাছে পাঠাতে হবে। এই সভার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে 'বিপ্লবী পার্টি' গঠনের প্রক্রিয়ায়। ছেন টানা হলো। সঙ্গে সঙ্গে সমাপ্ত হলো একটা ঘটনাবহুল, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, রক্তক্ষয়ী পর্বের। একটা বিপ্লবী পার্টির নিজেকে নিজেই বিলুপ্ত করার উদাহরণ খুব বেশি নেই। জাসদের নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছিলেন, এই প্রক্রিয়া আর বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না। অনেক শ্রম, ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে এই উপলব্ধি অর্জন করতে হলো।

ছিয়াত্তরের ২৬ নভেম্বর সিরাজুল আলম খান ঢাকার মোহাম্মদপুরে হুমায়ুন রোডের একটা বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন। আনসার আহমদ, খোলা চৌধুরী এবং ডা. সেলিম এই বাসার একতলায় ভাড়া থাকতেন। আনসার খোদা বখশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জাসদ ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সিরাজুল আলম খান মাঝেমধ্যে এই বাসাটি শেল্টার হিসেবে ব্যবহৃত করতেন। সারা দিন ও পরদিন কোনো গণমাধ্যমে এই গ্রেপ্তারের সংবাদ প্রচার করা হয়নি। দলের মধ্যে অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, তাঁকে মেরে ফেলা হতে পারে। ২৭ নভেম্বর আফতাব উদ্দিন আহমদ ও মহিউদ্দিন আহমদ সারা দিন বিভিন্ন পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থার অফিসে ধরনা দেন, যাতে সিরাজুল আলম খানের গ্রেপ্তারের খবরটি ছাপানো হয়। ২৮ নভেম্বর একমাত্র ইত্তেফাক-এর ভেতরের পাতায় এক প্যারাগ্রাফের ছোট্ট একটা সংবাদ ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল, ‘সিরাজুল আলম খান গ্রেপ্তার'।

করপোরাল আলতাফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তিনি পলাতক জীবন বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার এক গ্রামে টাঙ্গাইল জেলা গণবাহিনীর একসময়ের কমান্ডার খন্দকার আবদুল বাতেনসহ একদল কৃষকের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন আলতাফ। এ সময় পুলিশ বাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং গুলি করতে থাকে। সবাই নিরাপদে সরে যেতে পারলেও আলতাফ পারেননি। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। তাঁর লাশ পুলিশ গুম করে ফেলেছিল । আলতাফ ছিলেন বরগুনা জেলার হরিদ্রাবাড়িয়া গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। একাত্তরে তিনি নবম সেক্টরে মেজর জলিলের সহযোদ্ধা ছিলেন। মা, স্ত্রী ও দুটি শিশুসন্তান রেখে তিনি 'বিপ্লবের' আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। এই সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য তিনি কোনো তারকাখ্যাতি পাননি। নিচু পর্যায়ের সৈনিকদের নিয়ে এ দেশে কেউ মহাকাব্য লেখেন না।

করপোরাল আলতাফকে নিয়ে মেজর জলিল একটি কবিতা লিখেছিলেন।

কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল :

আর দেবতা নয়, নয় শান্তির দূত

নহে কাবা, নহে কবিতা। এসো বিদ্যুৎ,

এসো বিপ্লব, এসো ঝঞ্ঝা, এসো আগুন,

এসো সংগ্রামী সাথী রক্তঝরা ফাগুন।

 

(সূত্র: জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি ।। পৃষ্টা: ২২২-২২৬)



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭