ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

ইসরায়েলে যেভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন নেতানিয়াহু


প্রকাশ: 19/11/2023


Thumbnail

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবশ্য আগে থেকেই সমালোচনার মুখে ছিলেন নেতানিয়াহু। গত বছরের নভেম্বরে নির্বাচনে জিতে ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে ডানপন্থী সরকার গঠন করেন তিনি। এরপর দেশটির বিচারব্যবস্থায় সংস্কারের চেষ্টা করে তুমুল বিক্ষোভের মুখে পড়েন। বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, এরপরও ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর যেটুকু সমর্থন ছিল, গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর তার প্রায় সবই হারিয়েছেন তিনি।

১৪ নভেম্বর একটি জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েলের ইহুদিদের মধ্যে তাঁর জনসমর্থন মাত্র ৪ শতাংশের মতো। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তায় এত ধস আগে কখনো নামেনি। এমন পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহুর বিরোধী, এমনকি তাঁর ঐতিহাসিক মিত্ররাও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে চলমান সংঘাত শেষে তাঁর পদত্যাগ চাইছেন।

ইসরায়েলের কোনো প্রধানমন্ত্রীই নেতানিয়াহুর মতো এমন নড়বড়ে অবস্থায় পড়েননি বলে মনে করেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিশেষজ্ঞ খালেদ এলগিনদি। 

তিনি বলেন, রাজনৈতিক জীবনে যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন তিনি। কারণ নেতানিয়াহুর আমলে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতার মুখে পড়েছে ইসরায়েল। 

জিম্মিদের উদ্ধারে ব্যর্থতা

৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলা পর ২০০ জনের বেশি মানুষকে জিম্মি করে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যায় নিয়ে যান হামাস সদস্যরা। ইসরায়েলের নাগরিকরা জিম্মি হওয়ায় দেশটির ৯৪ শতাংশ মানুষ নেতানিয়াহু সরকারকে অন্তত আংশিক দায়ী করছেন। গত শুক্রবার এমন দুই জিম্মির মরদেহ উদ্ধার করেছে ইসরায়েল। এর আগে কাতারসহ কয়েকটি দেশের মধ্যস্থতায় আরও চার জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস।

নেতানিয়াহুর বেশির ভাগ সমালোচনা হয়েছে হামাসের হাতে জিম্মি ব্যক্তিদের মুক্ত করার ক্ষেত্রে নেতানিয়াহুর আগ্রহের ‘ঘাটতি’ নিয়ে।

সাময়িক যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে বেশিসংখ্যক জিম্মিকে মুক্ত করার হামাসের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন নেতানিয়াহু। বলেছেন, সব জিম্মিকে মুক্তি দিলেই কেবল গাজায় হামলা বন্ধের বিষয়টি ভাববেন তিনি।

হামাসের সঙ্গে সংঘাত শুরুর কয়েক দিন পরই ইসরায়েলের জনগণের বড় একটি অংশ মনে করত, সংঘাত শেষে নেতানিয়াহুর পদত্যাগ করা উচিত। যদিও গাজায় হামলার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে তুমুল বিক্ষোভের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে নেতানিয়াহুকে সমর্থন দিয়ে আসছেন।

এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিশেষজ্ঞ জাচারি লকম্যান বলেন, ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তবে বাইডেন প্রশাসনের ধৈর্য একসময় শেষ হয়ে যেতে পারে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ইউরোপসহ অন্যান্য অঞ্চলেও যুদ্ধবিরতির পক্ষে জনসমর্থন বাড়ছে।

দলের ভেতর অসন্তোষ

নেতানিয়াহুকে নিয়ে লিকুদ পার্টির মধ্যে অসন্তোষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অনেকেই দল ছেড়ে যাচ্ছেন। এমনই একজন দলের সদোত নেগেভ আঞ্চলিক কাউন্সিলের প্রধান তামির ইদান। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সময় তিনি লিকুদ পার্টির সদস্য কার্ড ছিঁড়ে ফেলেছেন। 

ইসরায়েলের নেতিভত শহরে নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টি–সমর্থিত মেয়র ইয়েহিয়েল জোহার সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলকে বলেন, সংঘাত শেষের পর লিকুদ পার্টির ভেতরে বড় একটি দল থাকবে, যারা বতর্মান পরিস্থিতি বদলে দেবে।

নেতানিয়াহু হয়তো এখন বাইডেনের সমর্থন পাচ্ছেন, তবে এসবের ঘটনায় অনুধাবণ করা যাচ্ছে যে তাঁর নিজের ঘাঁটিই নড়বড়ে হয়ে পড়ছে।

ইসরায়েলের গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে ইসরায়েল হাইয়োম নামে ডানপন্থী একটি সংবাদপত্র প্রায়ই নেতানিয়াহুকে সমর্থন দিয়ে থাকে। সেই সংবাদপত্রও লিখেছে, ‘এই ব্যর্থতার দায় আপনাকে (নেতানিয়াহু) নিতে হবে এবং এটি আপনি অন্য কারও ওপর চাপাতে পারবেন না।’

এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র কট্টর ডানপন্থীদের সমর্থনেই নেতানিয়াহু সরকার টিকে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তারা নেতানিয়াহুকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা গাজা পরিস্থিতির দিকে সবার দৃষ্টি থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে পশ্চিম তীরে অভিযান চালাচ্ছে।

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিশেষজ্ঞ খালেদ এলগিনদি বলেন, নেতানিয়াহু তাঁর রাজনৈতিক জীবন বাঁচাতে লড়াই করছেন। সবার নজর গাজার দিকে। এই সুযোগে জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচের মতো কট্টর ডানপন্থীরা পশ্চিম তীরে যা খুশি তা-ই করতে পারছেন। সেখানে বসতি স্থাপনকারীরা তাণ্ডব চালাচ্ছে। একই কাজ করছে ইসরায়েলি বাহিনী। খুব কম মানুষের নজর সেখানে রয়েছে। তাই কট্টর ডানপন্থীরা পশ্চিম তীরে তাঁদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন।

তবে এখানেও ফাটল দেখা দিচ্ছে। গত শুক্রবার গাজায় প্রতিদিন দুই ট্রাক জ্বালানি প্রবেশের অনুমোদন দেয় নেতানিয়াহুর যুদ্ধকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা। যদিও এই জ্বালানি গাজার ২৩ লাখ মানুষের জন্য খুবই সামান্য বলে মনে করা হচ্ছে। এরপরও ইসরায়েল সরকারের এ পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন বেন-গভির ও স্মোত্রিচ।

শিকারে প্রস্তুত বিরোধীরা

এমন পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহুকে ঘায়েল করতে প্রস্তুত রয়েছে তার বিরোধীরা। এমনই একজন হচ্ছেন সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গাৎস। গাৎস বর্তমানে নেতানিয়াহুর যুদ্ধকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা যতই কমছে, ততই উত্থান হচ্ছে তাঁর।

১৪ নভেম্বরের এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘নেতানিয়াহু, নাকি গাৎস—কাকে তাঁরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেশি যোগ্য মনে করেন?’ দেখা যায়, জরিপে নেতানিয়াহুর চেয়ে ২২ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন গাৎস। তবে তিনি নেতানিয়াহুকে সরাতে পারবেন কি না, তা এখনই সুর্নিদিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। কারণ, হামাসের হামলার পর তিনি নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন। নেতানিয়াহুর অনেক সমালোচক এই কাজ করেননি।

নেতানিয়াহু হামাসের হামলার দায় ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও সামরিক বাহিনীর ওপর চাপালে, তাঁর কড়া সমালোচনা করেন গাৎস। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিশেষজ্ঞ জাচারি লকম্যানের মতে, ইসরায়েলে দীর্ঘদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদ দখলের স্বপ্ন দেখছেন গাৎস।

লকম্যানের ভাষায়, ইসরায়েলের রাজনীতির কেন্দ্রে গাৎস নিজেকে এমন একজন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, যিনি ডান, বাম ও মধ্যপন্থীদের এক ছাতার নিচে আনতে পারবেন। আর নেতানিয়াহুর মতো অনেক বোঝাই তাঁকে বইতে হচ্ছে না। যেমন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা রয়েছে, যা গাৎসের নেই।

নেতানিয়াহুর আরেকজন বিরোধী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদ। গত বুধবার তিনি দাবি তুলেছেন নেতানিয়াহুকে সরিয়ে লিকুদ পার্টির অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ার। খালেদ এলগিনদি বলেন, আগে সংঘাত শেষের পর নেতানিয়াহুর পদত্যাগ চাওয়া হচ্ছিল। তবে এখন সংঘাতের সমাপ্তির আগেই তাঁর পদত্যাগ চাওয়া হচ্ছে।

তবে রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার ইতিহাস আছে নেতানিয়াহুর। গত বছরের নির্বাচনে এ দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। দুর্নীতির অভিযোগ ঘাড়ে নিয়েও নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

খালেদ এলগিনদি বলেন, ‘৭ অক্টোবরের আগে থেকেই তাঁর জনপ্রিয়তা কমছে। হামাসের হামলা ও জিম্মিদের নিয়ে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।এরপরও এসব সমস্যা সামাল দেওয়ার কৌশল যদি কারও জানা থাকে, তিনি শুধু নেতানিয়াহুই।আমার মনে হয় না রাজনৈতিকভাবে বর্তমান পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারবেন নেতানিয়াহু।’



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭