এডিটর’স মাইন্ড

নির্বাচনের মাঠে ‘কোরবানির হাট’


প্রকাশ: 27/11/2023


Thumbnail

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কল্যাণ পার্টির নেতা লে. জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। ২৭ অক্টোবর, বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন এই সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা।’

সৈয়দ ইবরাহিম চৌকস সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কোরআন এবং ইসলামী ব্যাখ্যায় তিনি অনবদ্য। মুসলিম যুদ্ধের কৌশল নিয়ে একটি চমৎকার গ্রন্থের লেখক এই মেধাবী মানুষটি। সহজ সরল সদালাপী। নির্বাচনে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, তাতে যথেষ্ট যুক্তি আছে। আছে সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। কিন্তু তার নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি শরিকরা। নির্বাচনী এলাকায় তিনি এখন বিএনপি কর্তৃক অবাঞ্ছিত। ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর সৈয়দ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। নুর বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা কোরবানির গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন।’ শুধু নুর নয়, একই রকম বক্তব্য রেখেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গত শুক্রবার এলডিপির নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছেন, ‘এ বয়সে এসে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হতে চাই না।’ সৈয়দ ইবরাহিম গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। বরং নিজের বুদ্ধি বিবেচনার দ্বারাই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমার ধারণা। কোরবানির হাটে নিজেকে বিক্রির অভিপ্রায় থাকলে তিনি নিশ্চয়ই তৃণমূল বিএনপি, কিংবা বিএনএমে যোগ দিতেন। এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গেও যোগাযোগ করতেন। সৈয়দ ইবরাহিম তা করেননি। এটি তার নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তে ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। তবে নির্বাচনের মাঠে এখন কেনাবেচার খেলা জমে উঠেছে। সন্দেহের তালিকায় থাকা অনেক নেতাই বলছেন, ‘আমি গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হব না।’ রাজনীতিতে এ কেনাবেচার ইতিহাস অনেক পুরোনো। নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন। নিজেদের আদর্শকে কোরবানি দিয়েছেন।

বিএনপির এখন পর্যন্ত অবস্থান নির্বাচনে না যাওয়ার। এখনো দলটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, অন্তত কাগজে-কলমে। অবরোধের ঘোষণা দিয়ে চুপচাপ বসে নদীর ঢেউ গুনছেন নেতারা। বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেছিল ৩৪টি দল। এদের মধ্যে বেশ কিছু দল এখন নির্বাচনী মাঠে নেমেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সামনে আরও চমক অপেক্ষা করছে।’ বিএনপির এখন অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো, নির্বাচন বর্জনের পক্ষে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বাড়ানো। এজন্য রাজনীতিতে কেনাবেচার খেলা চলছে। জাতীয় পার্টির একজন নেতা স্বীকার করেছেন, জাতীয় পার্টি যেন নির্বাচনে না যায় সেজন্য ‘বড় অফার’ দেওয়া হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। কান পাতলে নানা কথা শোনা যায়। এখনো জাতীয় পার্টি নাকি নিলামে আছে। দর-কষাকষি এখনো চলছে। শেষ মুহূর্তে ভালো দর পেলে, ২০১৪ সালের মতো, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে পারে দলটি, এমন গুঞ্জনও শোনা যায়। বিএনপির শরিকদের মোটা অঙ্কের উপঢৌকনের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা নির্বাচনে না যায়। আদর্শ বা নীতি নয়, টাকার লোভে নির্বাচন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তও এক ধরনের কেনাবেচা। গরু-ছাগলের মতো কোন কোন রাজনীতিবিদের কত দাম ওঠে তা জানার অপেক্ষায় আমরা। বিএনপির প্রধান লক্ষ্য নির্বাচনে না যাওয়াদের পাল্লা ভারী করা। নির্বাচন যেন গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়ে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের পর বলে—‘এটা পাতানো খেলা। আবার নির্বাচন করতে হবে।’ সে আশায় রাজনীতির হাটে এখন লন্ডনি পাউন্ডের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। শুধু জোট নয়, ঘরেই অবিশ্বাস-সন্দেহের দোলাচলে বিএনপি। দলটির বেশ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের সঙ্গে তারা গোপন আঁতাত করছেন। নির্বাচনে যাওয়ার জন্য তারা ‘গরু-ছাগলের’ মতো বিক্রি হয়েছেন। এজন্য ঘর সামলাতে ব্যস্ত বিএনপি। এর আগে সিলেট সিটি নির্বাচনে দলের নেতাকে ধরে রাখতে ‘নজরানা’ দিয়েছিলেন দলের শীর্ষ নেতা। নির্বাচনে না দাঁড়ানোর বিনিময়ে তিনি কী কী পেয়েছেন, তা গোপনই রয়ে গেছে। তবে দলীয় পদ প্রাপ্তিও যে এক ধরনের উৎকোচ, তা নিশ্চয়ই জনগণ উপলব্ধি করে। এবার বিএনপি আরও মরিয়া। জনপ্রিয় এবং নির্বাচনে যেতে আগ্রহীদের তা থেকে দূরে রাখতে নানা টোপ দেওয়া হচ্ছে। পদ-পদবির সঙ্গে আছে নগদ প্রলোভন। আন্দোলন নয়, বিএনপিতে চলছে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’র রাজনীতি। আদর্শহীন রাজনীতিতে টাকা-পয়সা ও পদ-পদবির লোভই শেষ অস্ত্র।

এটা স্পষ্ট, আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড়া একটি অর্থপূর্ণ নির্বাচন চায়। এমন একটি নির্বাচন যেখানে ভোটারদের উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। দৃশ্যত নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ একা তো নির্বাচন উৎসবমুখর করতে পারবে না। এজন্যই বাজারে এসেছে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, ইসলামী জোট, যুক্তফ্রন্টসহ নানা জাতের-রঙের বাহারি রাজনৈতিক দল। জাতীয় পার্টিসহ এসব নতুন রং করা পুরোনো গাড়ি নির্বাচনী মহাসড়কে চলাচল শুরু করতেই দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। জনগণ ধীরে ধীরে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী হতে শুরু করেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা গোটা দেশকে আচ্ছন্ন করেছিল, এখনকার পরিস্থিতি তার ধারেকাছেও নয়, বরং দেশ স্বাভাবিক। বিএনপি রাজনীতির মূলধারা থেকে প্রায় ছিটকে যাচ্ছে ক্রমাগত। নির্বাচনের মহাসড়কে এত গাড়ি নামাতে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ কসরত করেছে। বিনিয়োগ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ছোট একটি গল্প বলতে চাই। এক ব্যবসায়ী তার ম্যানেজারকে নির্দেশ দিলেন, একজন কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে একটা কাজ বাগাতে হবে। ম্যানেজার ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। এসে মালিককে বললেন, ‘উনি (ঘুষ) খান না।’ ব্যবসায়ী হেসে বললেন, ‘কত খান না?’ পরে ব্যবসায়ী নিজেই ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দফারফা করলেন। এখন আমরা এমন এক আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বসবাস করি, যেখানে আদর্শ মূল্যহীন, নীতি অর্থহীন। সবকিছুই কেনাবেচা হয়। রাজনীতিতে কেনাবেচা এখন ‘হালাল’। তাই কে ‘নগদে’, কে ‘আশ্বাসে’ নির্বাচনে এলো; তার হিসাব খুঁজে লাভ নেই। নির্বাচনী মাঠ এখন কোরবানির গরু-ছাগলের হাট। তবে এখানে ক্ষমতাসীনরা একাই ক্রেতা নয়। বিরোধীরাও নিলামে শক্তিশালী পক্ষ। বাংলাদেশে কেনাবেচার রাজনীতি নতুন নয়। সৈয়দ ইবরাহিমই প্রথম রাজনীতিতে ‘ডিগবাজি’ দিয়েছেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ’৭৫-এর পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গরু-ছাগলের হাট প্রথা চালু হয়। সহজভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগলের মতো কেনাবেচার জনক জিয়াউর রহমান। তিনি সামরিক গোয়েন্দাদের দিয়ে বিএনপি গঠন করেছিলেন। বিভিন্ন লোককে বিএনপিতে যোগদানের জন্য নগদ অর্থ, ব্যবসা, টেন্ডার, ব্যাংক ঋণ দেওয়ার প্রথা চালু হয় জিয়ার হাত ধরেই। তিনি একদিকে যেমন স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ, মশিউর রহমানকে (যাদু মিয়া) দলে ভেড়ান, তেমনি চৈনিক বাম, গলাকাটা পার্টির তরিকুল ইসলাম, মান্নান ভূঁইয়াদেরও কাছে টানেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কে এম ওবায়দুল রহমানের মতো নেতাদের বিএনপিতে নিয়ে জিয়া আওয়ামীবিরোধী ‘ককটেল’ সৃষ্টি করেন, যার নাম বিএনপি। জিয়া রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে সত্যিই ডিফিকাল্ট করেছিলেন। তার নেতৃত্বে রাজনীতিতে প্রবেশ করে কালো টাকার মালিক, মাস্তান, দুর্বৃত্তরা। তবে রাজনীতিতে গরু-ছাগলে হাটকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদ কবি ছিলেন, তাই রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগল বানিয়েছিলেন তিনি কাব্যিক ঢঙে। বিকেলে জনসভায় এরশাদকে তুলোধোনা করেছিলেন ব্যারিস্টার কোরবান আলী। সন্ধ্যায় গোটা জাতি অবাক বিস্ময়ে দেখল স্বৈরাচারের মন্ত্রী হয়ে নিজেকে কোরবানি দিলেন মুজিব সৈনিক। কাজী জাফর আহমেদ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কিংবা মিজান চৌধুরীর জাতীয় পার্টিতে যোগদান ছিল একেকটি প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতার অনুপম কাব্য। তাদের ডিগবাজি এত বিস্ময়কর যে, অলিম্পিকে এরকম কোনো খেলা থাকলে অবলীলায় তারা স্বর্ণপদক পেতেন। রাজনীতিকে এরশাদ রীতিমতো গরু-ছাগলের হাট বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই হাটেই এরশাদ নিঃস্ব রাখালে পরিণত হন ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে। এরশাদের পতনের পর গরু-ছাগলদের রশি আর রাখালের হাতে থাকেনি। যারা এরশাদের জন্য জান কোরবার করার প্রতিযোগিতা করতেন, তাদের প্রায় সবাই যোগ দেন বিএনপিতে। স্বৈরাচারের দোসররাই যখন এরশাদকে স্বৈরাচার বলে গালি দেয়, তখন লজ্জায় মুখ লুকানো ছাড়া উপায় কি? এখানেও কেনাবেচার রাজনীতি। এরশাদের চাটুকার গোষ্ঠীর ব্যারিস্টার মওদুদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বহুজনকে সস্তায় কিনে নেয় বিএনপি। ভাবখানা এমন বুড়ো গরুর দাম কম! স্বৈরাচারের উপ-রাষ্ট্রপতি ২০০১ সালে বিএনপির আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। বিএনপির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডিগবাজির রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ বিরোধী দল ভাঙার জন্য, বিরোধী নেতাদের ভাগিয়ে আনার যে ‘অস্ত্র’ বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি আবিষ্কার করেছিল, আজ সেই অস্ত্রেই তারা ঘায়েল হচ্ছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ১৯৮৮ সালে নির্বাচনের জন্য এরশাদ আ স ম আবদুর রবকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করতে বিএনপি মৃতপ্রায় খুনিদের দল ‘ফ্রিডম পার্টি’কে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। ক্ষমতায় থাকার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা থেকে রাজনীতিতে যারা ‘গরু-ছাগলের হাট’-এর প্রবর্তন করেছিলেন, তারাই এখন কোরবানির হাটের পণ্য। ’৭৫-এর পর রাজনীতির যে কেনাবেচার অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, সেই অধ্যায় আজ ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব’ হয়ে উঠেছে। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি তাতেই ক্ষতবিক্ষত। শুধু রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন না। রাজনীতিই এখন হয়ে উঠেছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। সবচেয়ে বড় বাণিজ্য।


সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭