ইনসাইড বাংলাদেশ

পাকিস্তান সরকার লন্ডনে আমাকে অপহরণ করতে চেয়েছিল


প্রকাশ: 02/12/2023


Thumbnail

ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে স্বাধীন হয় আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ নামক একটি ভূখন্ড। বাংলাইনসাইডার এই বিজয়ের মাসে ধারাবাহিক ভাবে ‘দ্বিতীয় পর্বে’ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চদশ খন্ড’ থেকে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে।

মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে আনি জেনেভায় উপস্থিত ছিলাম। আমি তখন বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থার সদস্য। সম্মেলন চলাকালে ২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ সালে বিবিসি’র মাধ্যমে আমি জানতে পারি যে, বাংলাদেশের অবস্থা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। ঢাকায় সাংঘাতিক কিছু হয়েছে কিন্তু বাইরের পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে উড়ছে বলে সঠিক কিছু জানা যাচ্ছে না। এই খবর শুনে আমি অত্যন্ত মর্মাহত, চিন্তিত এবং ব্যাকুল হয়ে উঠি। অধিবেশন চলা অবস্থায় মানবাধিকার সংস্থার তৎকালীন সভাপতি আঁদ্রে আগিলাকে আমি জানাই যে আমার দেশ সংক্রান্ত গভীর দুঃখজনক সংবাদ আমি জানতে পেরেছি এবং এ সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমার পক্ষে অধিবেশনে অংশগ্রহণ আর সম্ভব নয়। আমি মধ্যাহ্নে জেনেভা ত্যাগ করি এবং বিকেলের দিকে লন্ডন এসে পৌঁছি

আমি যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের দু'জন কর্মকর্তাকে চিনতাম, একজন হচ্ছেন ইয়ান সাদারল্যাণ্ড। তিনি হেলেন দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান এবং অপরজন হচ্ছেন এন, জে, ব্যারিংটন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড হিউমের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

লর্ড হিউমের সাথে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। এই মধ্যবর্তী সময় আমি বিভিন্ন একাডেমিসীয়ান এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে থাকি। এ ছাড়া বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার এ্যালেন বুলক এবং ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লর্ড জেমস-এর সঙ্গে দেখা করি। তাঁরা আমাকে স্যার হিউ স্প্রিংগার- এর সঙ্গে দেখা করতে বলেন।

ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড জেমস একটি মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা করেন এবং প্রায় বিশজন বিভাগীয় প্রধানকে ঐ গোজে দাওয়াত করেন। আমি তাদের কাছে বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করি এবং তাঁরা গভীর সহানুভূতির যঙ্গে তা শোনেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে লর্ড জেমস ঢাকায় এসেছিলেন। বিনি ভবিষ্যৎ বাণী করেন যে, ছয় মাসের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। এর পর আমি আন্তর্জাতিক জুরিষ্ট কমিশনের সাধারণ সম্পাদককে টেলিফোন করে সমস্ত ব্যাপার জানাই। তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। তাতে তিনি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য অনুরোধ জানান।

আমি যে জায়গায় থাকতাম সেখানে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে বার বার টেলিফোন করে আমাকে হাইকমিশনারের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি বারবারই তা প্রত্যাখ্যান করি। অতঃপর আমি বাসা পান্টাবার সিদ্ধান্ত নিই। কয়েকদিন পরে গোছগাছ করে যখন আমি রওয়ানা হচ্ছি ঠিক তখনই একটি টেলিফোন আসে। জানতে পারি টেলিফোনটি কলকাতা থেকে করা হয়েছে এবং অপরপারে কথা বলছেন টাংগাইল থেকে সংসদ সদস্য জনাব আব্দুল মান্নান এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। এই টেলিফোন সরকার গঠনের কয়েকদিন আগে আসে। তাঁরা আমাকে জানান যে, তাঁরা আমার সিদ্ধান্তে অত্যন্ত খুশী হয়েছেন এবং তাঁরা চান যে, সরকার গঠনের পর আমি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করি।

অস্থায়ী বাসস্থানে যাবার পর আমি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে একটি টেলিফোন পাই। কিভাবে তাঁরা আমার নতুন ঠিকানার খবর জানলো ঠিক বুঝতে পারিনি। তাঁরা আমার সঙ্গে দেখা করে জানান যে, পাকিস্তান সরকার আমাকে অপহরণ করার জন্য কিছু পাকিস্তানী লোক নিয়োগ করেছে এবং আমাকে অনুরোধ করেন সতর্কভাবে চলাফেরা করতে। তাঁরা আরো জানান, সরকারী পর্যায়ে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে যুক্তরাজ্যে থাককালে আমার জন্য হস্তবেশী কর্মচারী দ্বারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। তাঁরা বিশেষভাবে চলাফেরার ব্যাপারে আমাকে সতর্ক করে দেন এবং ভূগর্ভ রেলে ভ্রমণ করতে বারণ করেন।

এরপর আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন এবং অস্ত্র সরবরাহ কারার জন্য মুজিব নগর সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি বোর্ড অব ট্রাষ্টি গঠন করা হয়। এই বোর্ডের সদস্য ছিলেন মিঃ ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ, প্রাক্তন মন্ত্রী মিঃ টোন হাউস এবং আমি। এ কমিটিতে কয়েকজন বাঙ্গালীর সদস্য হবার কথা ছিল। কিন্তু কোন কোন বাঙ্গালী নিয়ে ফাণ্ড হবে ঠিক করতে না পারায় আপাতত এই তিনজনকে নিয়ে বোর্ড গঠিত হয়। পরে আরো নেবার কথা ছিল। কিন্তু ইতিমধো দেশ স্বাধীন হওয়ায় সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশ সরকারের নিকট হস্তান্তর করা হয় এবং বোর্ডের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানী দূতাবাস এই অর্থ সংগ্রহ অভিযানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালাতে থাকে এবং বহুলাংশে সফল হয়। কোন ব্যাংকই একাউন্ট খুলতে দিতে রাজী হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত হ্যামব্রোজ ব্যাংক রাজী হয় এবং যেখানে এ্যাকাউন্ট খোলা হয়।

জাতিসংঘের বিভিন্ন কূটনৈতিক সদস্যের সঙ্গেও দেখা করি এবং বক্তব্য রাখি। জাতিসংঘের তৎকালী অধিবেশনের সভাপতি নরওয়ের প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁর সাথেও আমার সাক্ষাৎ হয়। আমরা প্রচারপত্র বিলি করি এবং সাংবাদিকের সঙ্গে মিলিত হই।

জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের সাথে দেখা করার চেষ্টা করি। তিনি আমাদের জানান যে তাঁর সাথে সরাসরি দেখা করা আমাদের বিপক্ষে যাবে। কেননা তিনি নীরবে আমাদের জন্য কাজ করে যেতে চান। দেখা করলে পাকিস্তানের চাপ প্রয়োগের সুযোগ অনেক বেশী থাকবে। তিনি আরো বলেন যে, এ সিদ্ধান্ত আমাদের কল্যানের জন্য এবং আমাদের বক্তব্য শোনার জন্য তিনি জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে পাঠান।

আমি যখন ইংল্যান্ডের বাইরে যেতাম শেখ মান্নানকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতাম। কারণ তিনি ইংল্যান্ডে থেকেই অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন । তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। বৃটেনের বিভিন্ন জায়গায় আমরা সভা করি এবং আন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারণ করে।

এরই মধ্যে ফ্রান্সের সাথে আমরা যোগাযোগ করি এপ্রিলের শেষের দিকে। আমি সেখানে গিয়ে বিভিন্ন স্বরের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করি। সেখানে থাকতে আমার একজনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ হয়, তিনি হচ্ছেন মরিসাসের প্রধানমন্ত্রী জনাব সিট সাগর রামগোলাম। তাঁকে আমি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে অনুরোধ জানাই। বিভিন্ন অবস্থার কারণে তাঁর পক্ষে এটা সম্ভব হয়নি কিন্তু অন্য সব ধরনের সাহায্য তিনি আমাদের করেন।

নরওয়েতে দশ-বার জনের বেশী বাঙালী ছিল না কিন্তু আন্দোলন ছিল ব্যাপক। এর কারণ, নরওয়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী ছাত্র নেতা মিঃ বুল আমাদের আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। তিনি আমানের জন্য জনমত জোয়ার সৃষ্টি করেন। তাদের প্রচেষ্টায় জাতীয় টেলিভিশনে আমার বক্তৃতা প্রচার করা হয়। এক সন্ধায় ছা তার পরিষদের কার্যকরী কমিটির উদ্দেশে ভাষণ দিই। অসলোর মেয়র আমাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানান এবং একটি গ্রন্থে আমাকে সরাসরিভাবে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে উল্লেখ করেন।

 

(প্রয়াত আবু সাঈদ চৌধুরী, বিচারপতি শিক্ষাবিদ এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি)

 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭