প্রকাশ: 04/12/2023
পাকহানাদার বাহিনীর জন্য মহাবিপদ আসন্ন হয় ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর। এর আগের দিন যখন পাকিস্তান ভারত আক্রমন করে তখন থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতীয় বাহিনী (মিত্রবাহিনী। বিজয়ের শেষ প্রান্তে এসে এই দিনটি তাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর দিনটি ছিল শনিবার। এই দিন বাংলাদেশের সকল রণক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকায় হানাদার বাহিনী সর্বত্র পিছু হটছিল। পাকিস্তানী বিমান বাহিনী ক্রমশ পঙ্গু হয়ে পড়ছিল। সীমান্ত শহর দর্শনা সম্মিলিত বাহিনীর দখলে চলে আসে।
এদিকে ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এগিয়ে আসে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, করাচী-শত্রু ঘাঁটিতে চলে বোমাবর্ষণ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আকাশে চলে জোর বিমান যুদ্ধ। সর্বাত্মক যুদ্ধের এই দিনে পশ্চিম সেক্টর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সব ক’টি কলাম পূর্বে এগিয়ে যায়। কোথাও তারা সোজাসুজি পাকঘাঁটিগুলোর দিকে এগোয় না। মূল বাহিনী সর্বদাই ঘাঁটিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে পাক বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রত্যেক ঘাঁটিতে অবিরাম গোলাবর্ষণ চালাতে থাকে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলো বার বার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভৃতি এলাকার সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। ঢাকার বিমান যুদ্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করে। প্রথম রাতের আক্রমণেই পাকিস্তানের বিমান বহরের প্রায় অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর মিলিত প্রত্যাঘাত, ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ ও নৌবাহিনীর অবরোধের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধের চিত্র এভাবে আমূল পরিবতির্ত হয়।
ভারত গেরিলা বেষ্টিত ঢাকায় ফাইটার দিয়ে সব দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। প্রায় ৮০০০ গেরিলা সারা শহরে সক্রিয় ছিল। গুল টেক্সটাইল মিলসে মুক্তিফৌজের গেরিলারা শত্রুদের বাংকারে হামলা চালিয়ে ২৭ সৈন্যকে হত্যা করলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সেই এলাকা থেকে পিছু হটে। ১১ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর এইদিন বিকাল ৩টার সময় হানাদার বাহিনীর কামালপুর ঘাঁটির সেনারা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
একইদিন জামালপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় মুক্তিবাহিনী অভিযান করার জন্য সমবেত হয়। ভালুকা থানার চাপড়াবাড়ী এলাকায় রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৩ জন রাজাকার হত্যা করা হয়। একই দিন কোম্পানি কমান্ডার মোছলেহ উদ্দিন আহমেদ ও প্লাটুন কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন আহমেদ একদল মুক্তিসেনা নিয়ে কাঁঠালী ও বাশিল এলাকায় পাক বাহিনীর ওপর আক্রমণ করলে ৭ জন পাকসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয় ।
৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল সিআর দত্ত এবং জেড ফোর্সের মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিলেটের কানাইঘাট দখলের পর এলাকায় শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেন। ৩নং সেক্টরের মুক্তি বাহিনী শমসের নগর বিমান বন্দর এবং আখাউড়া রেল স্টেশন দখল করে। ৮নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর দখল করে যশোরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিন পিএনএস গাজী বিশাখাপত্তম বন্দরের কাছে আক্রান্ত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
এই দিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক চিঠিতে বলেন- ‘মাননীয়া, ৩ ডিসেম্বর আপনাদের দেশে পাকিস্তান সামরিক জান্তার অতর্কিত আক্রমণের কথা শুনে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। ... ইয়াহিয়া ও তার জেনারেলদের মাধ্যমে আপনার দেশে যে ধ্বংস সংঘটিত হয়েছ এখন আমাদের উচিত এই আগ্রাসন দমন করতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এর প্রতিবাদ করা ও স্বাধীনতা লাভের জন্য একজোট হওয়া। তাই আমি অনুরোধ করতে চাই, আমরা যদি কূটনৈতিকভাবে একজোট হই তাহলে সহজেই আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা লাভ করতে পারব। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলাদেশ সরকার এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে যে কোন বিপদেই দুই দেশের পাশে সমানভাবে দাঁড়াবে। আমরা আশাবাদী যে আমাদের এই একতা ইয়াহিয়া বাহিনীর ঘৃণ্য চক্রান্তকে প্রতিহত করবে ও আমাদেরকে একটি আশাব্যঞ্জক ফলাফল দেবে। আমরা যে কোন বিপদেই আপনাদের পাশে দাঁড়াব ও পূর্ণ সহযোগিতা করব।’
তৎকালীন সময়ে ঢাকায় বিবিসির বিশেষ প্রতিনিধি বলেছেন, শহরে ক্রমাগত বিমান স্থাপনায় ভারতীয় বিমান রকেট ও কামানের শেলিং করছে। তিনি দুটি বিমানকে গ্রাউন্ড টায়ারের আক্রমণে ভূপাতিত হতে দেখেন। নিউইয়র্ক টাইমস এর সংবাদ ভাষ্য থেকে জানা যায়, এই সঙ্কটে সাড়া দিয়ে সংঘাতের মূল কারণটি চিহ্নিত করা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের অসহনীয় নিপীড়ন প্রতিবেশী ভারতের অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল। লন্ডনের দ্য ডেইলি মিররের সংবাদ থেকে জানা যায়, পাকিস্তান শুধু ভারত নয় পুরো পশ্চিম এশিয়াকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। এরপর রচিত হতে থাকে বাংলাদেশের বিজয়ের ইতিহাস।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭