প্রকাশ: 05/12/2023
ডিসেম্বর
মাস বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে
৩০ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে স্বাধীন হয় আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি
হয় বাংলাদেশ নামক একটি ভূখন্ড। বাংলাইনসাইডার এই বিজয়ের মাসে ধারাবাহিক ভাবে ‘পঞ্চম
পর্বে’ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চদশ খন্ড’ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াহিদুল
হকের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে-
১৯৭১ সালের আন্দোলন হঠাৎ করে
হয়নি। এর পেছনে সংগ্রাম ও চেতনার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই ইতিহাসের সাথে সবাই পরিচিত।
তবে আমার বিশ্বাস যে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন এই চেতনা প্রবাহের ধারাকে এগিয়ে নিয়েছে সবচেয়ে
বেশী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীরা সবসময়ে এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে রাজনৈতিক
কর্মীদের সাথে। নিজেদের বৃত্তে এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকেনি এবং এর চরিত্রও কেবলমাত্র
কলা-ক্রিয়ার মধ্যে সীমিত ছিল না।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী
উপলক্ষে যেসব সভা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তার মূল সুর ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা।
স্বাভাবিক কারণেই পাকিস্তান সরকার এর বিরোধিতা করে। কিন্তু যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা এই
উৎসাহ উদযাপনে সৃষ্টি হয় তা থামিয়ে রাখার মত শক্তি কারও ছিল না। এই উদ্যাপনের সরাসরি
ফসল হচ্ছে 'ছায়ানট' যা পরে আমাদের গভীরতম বিশ্বাস ও মূল্যবোধ প্রসারের অন্যতম কেন্দ্রস্থলে
পরিণত হয়। অতএব বাঙালীদের রাজনীতি সব সময় তার সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করেছে। হয়ত বা অন্য
যে কোন দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের চেয়েও।
১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর খবর
আসে যে মহাপ্রলয় হয়েছে তখন প্রথমে খুব একটা কাউকে নাড়া দেয়নি। ঐ সময় আমরা কয়েকজন খবরের
ভাষা থেকে বুঝি যে ওখানটায় একটা কিছু ঘটেছে। তাড়াহুড়ো করে 'দুর্যোগ নিরোধ কমিটি' গঠন
করে নগ্ন পদযাত্রা শুরু করি রাস্তায় "ভিক্ষা দাওগো পুরবাসী" গানটা গেয়ে।
আমরা তখনকার দিনেই প্রায় ৫০ হাজার টাকা উঠাই। এর মধ্যে দুর্যোগের ব্যাপকতার খবর চারিদিকে
ছড়িয়ে পড়ে। দুর্যোগবাসীদের সাহায্য করার জন্য আমরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাতেই কাজ করতাম।
জায়গার নাম ছিল চর কাজল (রায়পুরা)। ৭ই মার্চ সেখানে ছিলাম। পরে ঢাকায় ফিরে এসে দেখি
অবস্থা খুবই খারাপ যদিও কত খারাপ তা ধারণা করিনি।
পঁচিশে রাতে আমি আমার সংবাদপত্র
অফিসেই ছিলাম। সারারাত ধরে শুধু আওয়াজ শুনেছি। ২৬ তারিখে বের হওয়া যায়নি। অতএব ২৭ তারিখে
আমরা অফিস ত্যাগ করতে সমর্থ হই।
মির্জা সামাদ একজন প্রবীণ কমিউনিষ্ট
নেতা। তার সাথে আমার আলাপ হয় পরিস্থিতি নিয়ে। অস্ত্র সংগ্রহ করা এবং প্রয়োজনবোধে ভারতীয়
সাহায্য নিয়ে পাকসেনাদের পরাজিত করা। আমার মনে হয়েছিল রাজনৈতিক কারণেই ভারত আমাদের
পক্ষে থাকবে।
২রা এপ্রিল কামাল সিদ্দিকী,
কাজী ইকবাল এবং আবুল খায়ের লিটুকে নিয়ে গাড়ীতে করে আমরা রওয়ানা এই। পথে সাভার থেকে
আমরা হাসান ইমামকে তুলে নিই। তাঁর পরিবারও সাভারে ছিল দেওয়ান ইদ্রিসের গৃহে।
আরিচা দিয়ে আমরা নৌকাপথে ঝিনাইদহ
যাই এবং আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ্য করি যে নদীর ওপারে 'জয় বাংলায়' পতাকা উড়ছে। সেখানে বাংলাদেশ
স্বাধীন। আমার সাথে থানা পুলিশ অফিসার মাহবুবের আলাপ হয়। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন
তৌফিক এলাহী চৌধুরী, কামাল সিদ্দিকী এবং আরো কয়েকজন। জানতে পারি কামাল সিদ্দিকী প্রায়
১০০ পাকিস্তানী সৈন্যকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন।
এরপর কলকাতায় গিয়ে রাজনৈতিক
নেতা অনসুর হাবিবের বাসায় উঠি। দেখা করি ভবানী সেন এবং ইন্দ্রমীয় গুপ্তের সাথে। তাদের
বোঝাবার চেষ্টা করি যে ভারতীয় সেনাবাহিনী যদি যশোর দখল করে নেয় এবং দূর্গ স্থাপন করতে
পারে তবে আমরা নিজেরাই যুদ্ধ করতে পারবো। এর মধ্যে লক্ষ্য করি যে যারা বাংলাদেশ থেকে
এসেছে তারা এখনও একত্রিত হয়নি যদিও 'কিড ষ্ট্রিট'-এর এম, পি হোটেলে অনেকেই জমায়েত হয়েছে।
আমার সাথে আওয়ামী লীগারদের কোন যোগাযোগ ছিল না অতএব আমি হাসান ইমামকে বলি তাদের সাথে
লাগযোগ করতে। অমিতাভ দাশগুপ্ত (ভারতীয় বামপন্থী নেতা) এদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং
তিনি চেষ্টা করেন আমাকে এদের সাথে কাজ করার সুযোগ করে দিতে কিন্তু তা সম্ভব হয়ে ওঠে
না যেহেতু জানা যায় আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কারও প্রবেশাধিকার নাই।
এরপর মৈত্রী দেবীর সাথে যোগাযোগ
হয়। তিনি এই পর্যায়ে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। জানা যায় যে একটি বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার
চেষ্টা চলছে। তাঁরই উদ্যোগে প্যাড ছাপানো হয়। ষ্ট্যাম্প ইত্যাদিও প্রস্তুত করা হয়।
আরও খবর পাওয়া যায় যে বিএসএফ-এর মাধ্যমে একটি বেতার ট্রান্সমিটারও পাওয়া যাবে।
এপ্রিলের শেষের দিকে খবর আসে
যে 'জয় বাংলা' নামে একটা পত্রিকা বার হচ্ছে। এর অফিস বালু হাক-কাক লেনে। এও খবর শুনি
আবদুল মান্নান এই পত্রিকার দায়িত্বে আছেন। জহির রায়হান তাঁর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন
কিন্তু তাঁকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। যা হোক বেতার কেন্দ্রের ব্যাপার নিয়ে
আমরা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ি। শামসুল হুদা চৌধুরী, মোস্তফা মনোয়ার, কামরুল হাসান, এম আর
আখতার মুকুল এবং আমি একটি কমিটি গঠন করি।
পশ্চিম বঙ্গ শিল্পী সাহিত্যিক
সহায়ক সমিতি গঠিত হয়েছে। দিপেন বিশ্বাস ছিলেন এর সংগঠক। অর্থও সংগৃহীত হয় এবং প্রায়
সব শিল্পী-সাহিত্যিকের সাথে জড়িয়ে পড়েন। যে সাংস্কৃতিক দল তৈরি হয় তার সভাপতি হন সনজীদা
খাতুন, আদি হই পরিচালক। এর নাম দেয়া হয় 'বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'।
মে মাসে এটা গঠিত হয়। স্কোয়াডের সদস্য সংখ্যা ছিল একশজনের মত।
১৪৪, লেলিন সরণীতে পি, পি,
আই অফিসের একটি কক্ষে রিহার্সাল হোত। তিরিশ দিনের প্রতিদিনই রিহার্সাল হয়। ৩রা জুন
প্রথম অনুষ্ঠান হয় রবীন্দ্র সদনে। শাহরিয়ার কবির রচিত 'রূপান্তরের গান' নামে একটি রীতি
আলেখ্য। আলোকসজ্জা ও মঞ্চ সাজাবার দায়িত্বে ছিলেন মোস্তফা মনোয়ার। যদিও আমাদের সামর্থ্য
সীমিত ছিল তবুও অনুষ্ঠান কল্পনাতীতভাবে সফল হয়।
জহির রায়হান ছিলেন একজন খাঁটি
দেশপ্রেমিক। কি প্রচণ্ড পরিশ্রমে সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন তা বলা হয় না। একটা বিশেষ
ঘটনার উল্লেখ করা যায়। একদিন হঠাৎ খবর পাওয়া গেল যে 'জীবন থেকে নেওয়া' ছবির একটা প্রিন্ট
কলকাতায় এসেছে। সারাদিন খোঁজার পর পাওয়া গেল সেটি। শেরপুর এলাকার একটি সিনেমা হলের
মালিক সাহস করে নিয়ে এসেছেন। মালিক জানালেন এটা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং প্রিন্ট
তিনি দেবেন না। তখন মীমাংসায় বসা হলো। জনাব খায়ের (সংসদ সদস্য) এর দায়িত্ব নিলেন। ষাট
হাজার টাকা নগদ দেওয়া হল মালিককে। এরপর ঠিক হল ছবি দেখিয়ে যা আয় হবে তার অর্ধেক পাবে
শিল্পীরা আর বকিটা পাবে এম, সি, এ। জহির রায়হান নিজে কিছুই নিলেন না।
একই মাসে জনাব তাহেরউদ্দিন
ঠাকুর এসে বলেন যে দিল্লীতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হতে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশের পক্ষে
আমরা যাবো গান শোনাতে। ৩৫ সদস্যের একটি দল নিয়ে আমরা পৌছাই। আমাদের অনুষ্ঠান অসাধারণভাবে
সফল হয়। মঞ্চ নির্দেশনায় মোস্তফা মনোয়ার আশ্চর্যরকম আবহ সৃষ্টি করেন। সমগ্র অনুষ্ঠান
যে কি রকম সাড়া জাগায় তা বলার নয়। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর ভারতীয় গণসঙ্গীতের দুই প্রধান
পুরুষ বিনয় রায় এবং জ্যোতিন্দ্র মিত্র মঞ্চে আসেন এবং গান শোনান। সে অভিজ্ঞতা বলার
নয়।
এভাবে আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে
যাচ্ছিলাম বিভিন্ন শিবিরে। একই সাথে চলছিল অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টা। তখন ডিসেম্বর মাস।
আমি গেলাম জহির রায়হানের কাছে এই ব্যাপারে আলাপ করার জন্য। তাকে খুব অনমনা মনে হচ্ছিল।
আমি কথাটা তুলতেই তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, 'ওয়াহিদ ভাই, এসবের প্রয়োজন হবে না। আমি ১৬
তারিখে ঢাকায় যাচ্ছি। আমি এই কথার কোন কিছুই বুঝলাম না। কারণ, দেশ যে মাত্র কদিন পরই
স্বাধীন হবে ভাবিনি। যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে দেশ স্বাধীন
তখন আমি নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন সাহেবের সাথে ছিলাম। আনন্দে যে কি করেছি তা বলার নয়।
১৬ তারিখেই দেশ স্বাধীন হয়। সেদিনের কথা জহির রায়হান বলেছিলেন দু'সপ্তাহ আগে।
প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান
বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭