ইনসাইড বাংলাদেশ

কর্মচারীদের ছয় মাসের বেতন দিয়ে বলি অফিসে তারা যেন আর ফিরে না আসে


প্রকাশ: 07/12/2023


Thumbnail

ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে স্বাধীন হয় আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ নামক একটি ভূখন্ড। বাংলাইনসাইডার এই বিজয়ের মাসে ধারাবাহিক ভাবে ‘সপ্তম পর্বে’ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চদশ খন্ড’ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. কামাল সিদ্দিকীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে-

১৯৭০ সালের মাঝামাজি আমি নড়াইলে এস,ডি,ও হিসেবে যোগদান করি। নড়াইলে আসার পর বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজকর্মের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট-এর দায়িত্ব পালন করা অন্যতম ছিল। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে পড়ে, যেহেতু রাজনৈতিক কর্মীদের আমি সবসময় জামিনে মুক্তি দিতাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এটা চাইত না। এবং তাদের অনুরোধ বা উপরোধ উপেক্ষা করার ফলে তারা আমাকে শুভ নজরে দেখত না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আমি নড়াইলেই ছিলাম। এই নির্বাচনকে সৎ নির্বাচন বলা যায় এবং আওয়ামী লীগ সামগ্রিকভাবে সমস্ত আসনে জয়লাভ করেন। নির্বাচনে জয়লাভ হলেও পরিস্থিতি আমার কাছে ভাল ঠেকছিল না। মার্চের প্রথমদিকে আমি ঢাকায় আসি এবং সামগ্রিক অবস্থা দেখে আমার এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, পাকিস্তানীদের সাথে আওয়ামী লীগের আলোচনা ব্যর্থ হয়ে।

১১ই মার্চ একটি ঘটনা ঘটে যায়, ফলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। ঐ তারিখে আমি ক্যান্টনমেন্টে কোন কাজে গাড়ি নিয়ে যাই। আমার গাড়িতে কালো ফ্ল্যাগ ছিল। এই ফ্ল্যাগ দেখা মাত্র পাহারারত সৈনিক চীৎকার করে আমাকে নামতে বলে এবং গুলি করতে উদ্যত হয়। গাড়ি থামাবার পর সে আবার বলে কালো পতাকা নামাও। আমি উত্তর দিই যে, কিছুতেই আমি কালো পতাকা নামাবো না। সৈনিকটি তখন বলে কালো পতাকাসহ ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করা চলবে না। আমি বলি, কালো পতাকা ছাড়া ক্যান্টনমেন্টে আমি ঢুকতে পারি না এবং সেখান থেকেই ফিরে আসি।

২৫শে মার্চ একটি জরুরী কাজে আমি খুলনায় অবস্থান করছিলাম। ২৫শের রাত্রির ঘটনার পর ২৬ তারিখে রূপসা নদী পার হয়ে আমি কালিয়ায় পৌছি। সেখানে একটি জনসমাবেশে আমি বক্তৃতা দিই এবং বলি যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের সবাইকে এখন লড়তে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হবার সিদ্ধান্ত ছিল পূর্বপরিকল্পিত। ১৪ই মার্চ ঝিনাইদহে আমরা কয়েকজন সরকারী কর্মচারী মিলিত হই। এর মধ্যে ছিলেন তৌফিক এলাহি চৌধুরী, শাহ ফরিদ, মাহবুব (পুলিশ) এবং অন্য কয়েকজন। এখানে আমরা শপথ নিই যে প্রয়োজন হলে দেশের জন্য আমরা অস্ত্র ধারণ করবো। ২৭শে মার্চ নড়াইলে ফিরে এসে দেখি যে, অবস্থা বেশ খারাপ। নড়াইল কম-বেশী জনশূন্য এবং লোকেরা অত্যন্ত ভীত। আমি একটি মাইক নিয়ে শহরের রাস্তায় নেমে পড়ি। এবং ৪টায় একটি সমাবেশের আহবান করি। এই সমাবেশে আমি ঘোষণা করি, নড়াইল স্বাধীন বাংলাদেশের অংশ এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।

২১ মার্চ প্রায় চার লক্ষ লোকের এই বিশাল গণবাহিনী যশোর আক্রমণ করে। এই অভূতপূর্ব দৃ্শ্য পাকিস্তানীদের জন্য যথেষ্ট ছিল। তারা সহজেই বুঝেছিল যে, এই বিশাল জনস্রোতকে সমনাসামনি পরাস্ত করা সম্ভব নয়। এক কথায় তারা ভীতি ভীতি ছড়িয়ে ছত্রভংগ হয়ে ক্যান্টনমেন্টে পালিয়ে যায়। বহু পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের হাতে ধরা পরে। উল্লেখ্য যে, এরই মধ্যে তারা লুটতরাজ ও ধর্ষণে লিপ্ত হয়েছিল। বহু বিহারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিল। তাদের অনেকেই আমাদের হাতে মৃত্যুবরণ করে।

পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে এত সহজেই হার মানানো সম্ভব নয়। তারা বিশাল কামান দিয়ে নড়াইলের ওপরে আক্রমণ চালায় এবং আমাদের প্রচুর ক্ষতি হয়। প্রায় তিনশত আনসার কামানের গুলিতে মারা যায়। এছাড়া বিমান বাহিনী প্রায় সারাক্ষণ নড়াইলের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। সিদ্ধান্ত নিই যে, আমাদের যুদ্ধবন্দীদের বিচার করা হবে।

আমরা পাকিস্তানী প্রশাসনযন্ত্রকে বিকল করে দিয়েছি, জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম এবং যুদ্ধের মনোভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি এবং এর ফলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয় যে, বিদ্রোহের প্রথম স্তর সম্পূর্ণ হয়েছে, এখন জনগণের মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেয়ার কাজ। আমি সরকারী কর্মচারীদের ছয় মাসের বেতন দিয়ে বলি যে, অফিসে তারা যেন আর ফিরে না আসে। সক্ষম যোদ্ধাদের বলি সীমান্তের দিকে চলে যেতে যেহেতু নড়াইলকে আর রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এরপর আমি নড়াইল ত্যাগ করি। আমার ইচ্ছা ছিল বাবা-মার সাথে শেষবারের জন্য একবার দেখা করা এবং সে উদ্দেশ্যেই আমি এপ্রিল মাসের ৭/৮ তারিখে ঢাকায় আসি। ঢাকায় আমাদের বাসার দিকে যখন রওয়ানা হচ্ছি তখনই আমার একজন পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়। তিনি আমাকে জানান যে, নড়াইলের সব ঘটনার খবরই ঢাকায় এসে পৌঁছে গেছে। সেনাবাহিনী জানে আমি বহু পাকিস্তানী হত্যা করেছি।

তারপর কলকাতায় গিয়ে কীড স্ট্রীটে সমবেত হই। এখানে বহু এমপির সাথে দেখা হয় এবং ১৭ই এপ্রিলের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার কথাও জানতে পারি। এর পরে পাকিস্তানী দূতাবাসের জনাব হোসেন আলী এবং আনোয়ারুল করিম চৌধুরীর সাথে দেখা করি এবং সমস্ত ঘটনার বর্ণনা দিই। তাদের বক্তব্যও আমি শুনি। তবে আমার মনে হচ্ছিল যে, কলকাতায় আমার অবস্থানের কোন প্রয়োজন নেই, এবং আমি তখন খুলনা সীমান্তের গজাডাংগা ক্যাম্পে যোগদান করি। এই ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন।

মে এবং জুন মাস ট্রেনিং এবং ছোটখাটো অপারেশন পরিচালনার মধ্যে কাটে। জুন মাসের শেষে জেনারেল ওসমানী এই ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন এবং আমার খোঁজ করেন। তিনি আমাকে বলেন যে, মুজিব নগর সচিবালয়ে আমার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর এই সিদ্ধান্তে আমার প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও করার কিছু ছিল না।

সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের দিকে খন্দকার মোশতাক মুজিব নগর সরকারের ভেতর কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ছিল যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। অতএব, যদিও জাতিসংঘ প্রেরিত প্রতিনিধিদলে তার নেতৃত্ব করার কথা ছিল কিন্ত তাকে বাদ দেয়া হয় এবং তার স্থলে দলের প্রধান হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিয়োগ করা হয়।

পরবর্তীকালে খন্দকার মোশতাকের ভূমিকা একেবারেই গৌণ হয়ে পড়ে। তিনি মুজিব নগর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হিসেবে বহাল থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মহলে তাঁর প্রভাব একেবারেই ছিল না। যখন থেকে এই অভিযোগ সবার মধ্যে প্রচারিত হলো যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরকারের অনুমতি ছাড়া যোগাযোগ করেছেন তখন থেকে তিনি প্রায় গৃহবন্দী ছিলেন। একবার তিনি গঙ্গার পারে সান্ধ্য ভ্রমণের অনুমতি চেয়েছিলেন কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তা নাকচ করে দেন।

একটি ঘটনা যেটা এখানে উল্লেখ করা যায় সেটি হচ্ছে, কিছু সংসদ সদস্যের মাধ্যমে ইসরাইলের অনুপ্রবেশের চেষ্টা। ইসরাইল সরকার ভারতীয় ডানপন্থী রাজনীতিকদের সংগে যোগাযোগ করেন। তাঁরা আবার বাংলাদেশের কিছু সংসদ সদস্যের মাধ্যমে ইসরাইলী সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই খারাপ ঠেকে এবং আমি সরকারী কর্মচারীর দায়িত্ব বহির্ভূত একটি কাজ করি। আমি তথ্যটি সিপিএম-এর পত্রিকায় জানিয়ে দিই এবং খবরটি এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর ফলে ইসরাইলী লবীর তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়।

কলকাতায় মওলানা ভাসানীর সংগেও আমার দেখা হয়। তাঁর অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। তাঁর দেখাশুনা করার জন্য কেউ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে তিনি কলকাতায় ছিলেন এক প্রকার বন্দীর মত। আমি নিজে থেকেই তাঁর জন্য কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা করি। একটি ব্যাপার বেশ মনে পড়ে। তিনি এসবের মধ্যেও তাল টুপির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি সারা কলকাতা খুঁজে তাঁর জন্য এই টুপি সংগ্রহ করি। এছাড়া মওলানা ভাসানীর বিভিন্ন বক্তব্য আমি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতাম এবং অনেক ক্ষেত্রে তাঁর কাছে খবর নিয়ে যেতাম।

ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সব জল্পনা-কল্পনা এবং কোন্দলের সমাপ্তি ঘটে। ১৬ তারিখ দেশ স্বাধীন হয় এবং ১৮ তারিখ আমি খুলনায় ডি, সি, হিসেবে যোগদান করি। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭