ইনসাইড বাংলাদেশ

মনে হচ্ছিল একটা সাজনো ব্যাপার, একটা সুদৃশ্য চালবাজি


প্রকাশ: 08/12/2023


Thumbnail

ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে স্বাধীন হয় আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ নামক একটি ভূখন্ড। বাংলাইনসাইডার এই বিজয়ের মাসে ধারাবাহিক ভাবে ‘অষ্টম পর্বে’ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চদশ খন্ড’ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আসাদুজ্জামানের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে-

যদিও সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তবুও অনেকের মত আমার মনেও দ্বিধা ছিল যে আসলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আদৌ ক্ষমতা লাভ করবে কিনা। বিশেষ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবার পরেও যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করা নিয়ে পাকিস্তানীরা বিভিন্ন অজুহাতে গড়িমসি করতে লাগলো তখন এই ধারণা আমার আরো দৃঢ়বদ্ধ হয়। সবই মনে হচ্ছিল একটা সাজনো ব্যাপার, একটা সুদৃশ্য চালবাজি, যার মাধ্যমে গভীর কিছু ঢেকে রাখার প্রচেষ্টা চলছে।

আমি সে সময় রাজশাহীর জেলা প্রশাসক ছিলাম। জানুয়ারীর পরে আমাকে প্রাদেশিক সরকারের অর্থ- বিভাগের যুগ্ম-সচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়। আমি ঢাকায় এসে সার্কিট হাউসে উঠি এবং চারিদিকে খোঁজ খবর রাখতে থাকি। বাইশে ফেব্রুয়ারী যখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ভেংগে দেয়া হয় তখন আমার আশংকা আরো ঘনীভূত হয় যে অবস্থা হয়তোবা খুব খারাপ, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এবং এই সবই হচ্ছে তারই পূর্বপ্রস্তুতি।

একটি সভায় আমরা একসাথে মিলিত হই এবং আলোচনার পর কয়েকটি সিদ্ধান্ত এবং ঐকমত্যে উপনীত হই। আসন্ন দুর্যোগ যে অভাবনীয় কিছু সেটা সবাই ধারণা করে এবং বুঝতে পারে এই চক্রান্তের পিছনে একটা উদ্দেশ্য কাজ করছে-সেটি হচ্ছে বাঙালীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে শেষ করে দেয়া।

আমি ২৩ তারিখে আমার গ্রামের বাড়ী টাংগাইলের উদ্দেশে রওয়ানা হই। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সাথে আলাপ হয়। ২৪ তারিখে আমার শ্যালিকা ঢাকা ছেড়ে আসে এবং আমাদের জানায় যে, ঢাকা এখন একটা ভয়ের শহরে পরিণত হয়েছে। ২৫ তারিখে আলোচনা ভেংগে যায়। ২৬ তারিখে ঢাকার ঘটনা আমরা জানতে পাই। এই ঘটনা শোনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা একত্রিত হন এবং সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন আগামী কর্মসূচীর।

যে সব মানুষ এলাকায় আছে তাদের দু'টি ভাগে বিভক্ত করতে হবে। যথা-ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং ট্রেনিংবিহীন। এছাড়া আমরা পুলিশ ও আনসারদেরও যোগদান করতে অনুরোধ জানাই। এইভাবে বিভিন্ন কর্মীশিবির খোলা হয়। মূল সমস্যা অবশ্য একটাই, সেটা হচ্ছে অস্ত্র। খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে ডি, সি, এবং পুলিশ অফিসার উভয়ই অনুপস্থিত। তাঁদেরকে সংবাদ দেয়া হয় এবং তাঁরা এসে এই আন্দোলনে যোগদান করেন।

এই সময় টাংগাইলের ছাত্রনেতা কাদের সিদ্দিকী আমার সাথে দেখা করেন এবং বলেন যে তিনিও কিছু ছেলেকে ট্রেনিং দিচ্ছেন এবং আমাকেও এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন। খবর নিয়ে জানা যায় যে জেলা সদর দপ্তরে বি, ডি, আর ক্যাম্প আছে এবং সেখানে প্রচুর অস্ত্র আছে। আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করি।

তারা আমাদের জানান যে, কোনভাবে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র নেয়ার চেষ্টা করলে তারা শুধু দেবেনই না বরং সংগ্রামেও যোগদান করবেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের ওপর একটা ভুয়া আক্রমণের ব্যবস্থা করি। প্রায় সাথে সাথেই বি, ডি, আর সৈন্যরা পাকিস্তানীদের বন্দি করে এবং আমাদের সাথে যোগদান করে।

টাংগাইল এসে খবর পাই যে পাক-সেনারা টাংগাইল অভিমুখে আসছে। পরে আবার খবর আসে যে মির্জাপুর পর্যন্ত এসে তারা ফিরে চলে গেছে। ই, পি, আর-এর কিছু সৈন্য নিয়ে আমি মির্জাপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। আমরা কালিহাতিতে এসে থামি এবং আমি মির্জাপুর গিয়ে সংসদ সদস্য শওকত আলী খানের সাথে দেখা করি। তিনি আমাদের বক্তব্য শোনেন এবং একমত হন যে প্রতিরোধ করলে মির্জাপুরের আগেই করতে হবে।

আমাদের প্রধান কাজ ছিল অস্ত্র হেফাজতে রাখা। কাদের সিদ্দিকী এই কাজের দায়িত্বে ছিলেন। গিয়ে দেখি তিনি দুটো ট্রাকে অস্ত্র বোঝাই করছেন। নতুন সদর দপ্তরের উদ্দেশে আমরা রওনা হই। আমি সিদ্ধান্ত নেই যে আমার পরিবারকে গ্রামের বাড়ীতে রেখে আসবো, একসাথে থাকবো না। এখানে বলা যেতে পারে যে, এক এলাকা থেকে আর এক এলাকায় আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। খবর পেলাম টাংগাইল পাকিস্তানীরা দখল করে নিয়েছে। তখন ঠিক করি যে জামালপুর যাবো। সেখানে এম, পি, নিজামউদ্দীনের সাথে দেখা হয়। অন্ত্রের অভার পুনর্বার প্রকটভাবে জানতে পারি। এরপর আমি নিজ পৈতৃক নিবাসে যাই। গিয়ে দেখি ডাইনামাইট দিয়ে সেটা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং জানতে পারি যে আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্য ঘোষণা দেয়া হয়েছের এমতাবস্থায় সিদ্ধান্ত নেই সিরাজগঞ্জ যাওয়াটাই শ্রেয় হবে।

সিরাজগঞ্জ আমাদের গ্রামের ঠিক উল্টো দিকেই অবস্থিত। আমরা হেঁটেই পার হয়ে যাই। এর মধ্যে একটি ঘটনা ঘটে যায়। ডি, সি-র স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন এবং তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হন। আমার পরিবারও তাঁর সাথে ঢাকার দিকে রওয়ানা হয়। বাবার ধারণা ছিল সেটাই ভালো হবে। পথিমধ্যে তাঁরা গোপালপুরে এসে জানতে পারেন যে কারফিউ জারি রয়েছে। রাত্রে ওখানকার থানার ও, সি এসে জানায় যে আমার নামে গ্রেপ্তারী পরওয়ানা রয়েছে এবং আমাকে পেলে পাকসেনারা হয়ত সবাইকেই হত্যা করবে। তারা কোন রকমে সেখান থেকে ফিরে আসেন। আমরা আবার সাংগঠনিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। জানতে পারি পাকিস্তানীরা আরিচা পর্যন্ত এসে গেছে। তখন আমরা বগুড়ার উদ্দেশে রওয়ানা হই। এর মধ্যে নগরবাড়ীর পতন ঘটে ১১ই এপ্রিলে।

আমরা সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয়দের সাথে যোগাযোগ করি এবং অস্ত্র সাহায্য কামনা করি কিন্তু সে সময় কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। তাদের কাছে নাকি কোন আদেশ ছিল না আমাদের সাহায্যের ব্যাপারে। অবশ্য আমরা নিজেরাও জানতাম না যে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে।

এমন সময় খবর এলো যে জয়পুরহাট দিয়ে পাকিস্তানীরা আসছে হিলির দিকে। সেখানে মুকুল সাহেব ছিলেন, খবর পাঠালাম আমার এবং তাঁর নিজের পরিবারসহ হিলি চলে আসতে। কিন্তু খবর পাঠানোর বহুক্ষণ পরও কাউকে না আসতে দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ি। তখন কিছু লোক এবং অস্ত্র নিয়ে জয়পুরহাটের দিকে যেতে থাকি। পথিমধ্যে পাঁচবিবির কাছে হঠাৎ জীপ গাড়ীর আলো দেখি এবং তারপরই সবার সাথে দেখা হয়। জানতে পারি যে মুকুল সাহেবকে যে কোন কারণেই হোক পাঞ্জাবী বলে সন্দেহ করা হয় এবং অন্যদেরকে বিহারী মনে করা হয়।

আমাদের অর্থের মূল উৎস ছিল বিভিন্ন ট্রেজারী থেকে লব্ধ টাকা। এর সঙ্গে যোগ হয় হোসেন আলী সাহেবের নিয়ন্ত্রণাধীন দূতাবাসের টাকাগুলো। একাউন্ট রক্ষা করা এবং সরকারী অর্থের অডিট করা আমার বিভাগের প্রধান কাজ ছিল।মুজিবনগর সরকারের কাজ ছিল প্রধানত দুটি- এক, যুদ্ধ করা, দুই, শরণার্থীদের দেখাশোনা করা। আমাদের দায়িত্ব ছিল ভারতীয় সরকারের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা করা। এই সাহায্য ছিল প্রধানত ভারতীয়। কিন্তু রিলিফ ক্যাম্পগুলো ছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে।

সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল মুক্তিফৌজ গড়ে তোলা। ছেলেদের প্রশিক্ষণ দান ছিল এই কর্মসূচীর প্রধান অংশ। এই লক্ষ্যে “যুব নিয়ন্ত্রণ বোর্ড" গঠিত হয়। উইং কমান্ডার মীর্জা এর প্রধান ছিলেন। ফ্লাইট লেঃ রেজা তাঁকে সহায়তা করতেন। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। লাখ লাখ তরুণ ও যুবক এসে তাতে যোগদান করে। এই যুবশিবিরগুলোকে মুজিবনগর সরকারের অর্থে চালানো হতো।

জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল গঠন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই আঞ্চলিক প্রশাসনিক এলাকাগুলো যেমন সেই এলাকার সব দায়িত্ব বহন করতো তেমনি এদের প্রায় সামগ্রিক অর্থ যোগানোর দায়িত্ব ছিল আমাদের বিভাগের। তবে আমরা খুব টেনে খরচ করতাম যেহেতু আমাদের অর্থ ছিল কম এবং কেউই বলতে পারতো না যুদ্ধ কতদিন চলবে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার আমাদের সব হিসাবের সঠিক হিসাব গ্রহণ করে।

মুজিবনগর সরকার একটি প্লানিং বোর্ড স্থাপন করেছিল। এই প্রতিষ্ঠানকে বলা যেতে পারে আগামী বাংলদেশের একটি প্রতিবিম্ব স্বরূপ। যে সব পরিকল্পনা এখানে তৈরী হয় তা ছিল সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলক। বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা তৈরী হয় বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। এই পরিকল্পনাগুলো ছিল স্বাধীন দেশের জন্য-সেই স্বাধীনতা যত দ্রুতই আসুক বা দীর্ঘকাল পরেই আসুক।

আমরা জানতাম মুক্তিযুদ্ধে সৈন্যবাহিনীই প্রধান ভূমিকা পালন করবে তবে আমরা একই সাথে সচেষ্ট ছিলাম একটি সক্রিয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। যাতে প্রয়োজনের সময় আমরা একটি কার্যকরী সরকার তৎক্ষণাৎ চালু করতে পারি। প্রায় সব টাকা-পয়সা প্রদান করা হতো চেকের মাধ্যমে। এখানে বলা যায় যে সমগ্র মুজিবনগর সরকারের অধীনে এক হাজারেরও বেশী কর্মচারী ছিল। আমাদের টাকা-পয়সা বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংকেও রাখা হতো- যদিও সরকার হিসেবে আমাদের কোন আনুষ্ঠানিক অস্তিত্ব ছিল না।

উপসংহারে বলা যায় সময়টা ছিল একেবারেই বিশেষ ধরনের। নিজেদের শুধুমাত্র সরকারী চাকুরে বলে কখনও মনে হয়নি। আমরা ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের একটি অংশ। কোন কষ্টই বড় কষ্ট ছিল না। কোন ত্যাগের প্রশ্নে ছিল না দ্বিধা। কখনও ভাবিনি আমদের কি হবে। একটা কথাই কেবল মনে হতো- কাজটা যে করেই হোক সমাধা করতে হবে। তার জন্য যা করার দরকার সবই করতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম অন্য সবার মত । 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭