ইনসাইড বাংলাদেশ

নারীজাগরণের আলোর মশাল যিনি


প্রকাশ: 09/12/2023


Thumbnail

নারী-পুরুষের সমতা, নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি, নারীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা, নারী শিক্ষার অধিকার প্রভৃতি শুনলেই সর্বপ্রথম যেই মানুষটির কথা মনে পড়ে তিনি হলেন বেগম রোকেয়া। বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসে নারীরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে এই মহীয়সীকে। নারী সমাজের আজকের যে অগ্রগতি, তা অর্জনে বেগম রোকেয়ার জীবনবোধ, তার দর্শন ও কর্মময় জীবন এক অন্তহীন প্রেরণার উৎস।

বেগম রোকেয়া বাংলা সাহিত্যে প্রথম নারীবাদী লেখিকা হিসেবে পরিচিত। তার উদ্দেশ্য ছিল নারীদের কুসংস্কারমুক্ত ও শিক্ষিত করে তোলা। বাঙালি সমাজ যখন ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সেই সময় তিনি বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন। ‘নারীজাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে, তার এই পরিচয় স্বীকৃত হয়েছে তার নারীশিক্ষানুরাগী কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। নারী শিক্ষার প্রসারে এবং নারী পরাধীনতার বিরুদ্ধে তিনি কাজ করে গেছেন আমৃত্যু।

আজ ৯ ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারীর ১৪৩তম জন্মবার্ষিকী। বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রামে এক মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেঝো। বেগম রোকেয়ার পিতা জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলি হায়দার এবং মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। তার পিতা ছিলেন সেই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং উচ্চশিক্ষিত মানুষগুলোর মধ্যে একজন। কিন্ত মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন প্রচন্ড রক্ষণশীল। যার ফলে বেগম রোকেয়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করতে পারেননি। তৎকালীন সমাজে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো হত না এবং ঘরের বাইরে গিয়ে মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ ছিলো একপ্রকার স্বপ্নের মত। বেগম রোকেয়ার জন্মলগ্নে মুসলমান সমাজ ছিল নানারকম কুসংস্কারে নিমজ্জিত। তত্কালীন সময়ে মুসলিম নারীদের কাটাতে হতো গৃহবন্দি জীবন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না হওয়ার ফলে ভাইবোনদের কাছেই তার লেখাপড়ার প্রাথমিক হাতেখড়ি। ছোট থেকেই পড়ালেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে বড়ভাই নিজ গৃহেই তাকে আরবি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি শিক্ষা দেন।

জ্ঞানার্জনের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহ এবং উৎসাহের ফলে নিজের একান্ত চেষ্টায় বড় ভাই ও স্বামীর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় তিনি সাফল্য অর্জন করেনজ্ঞান চর্চায়।শিক্ষালাভে বড় দুই ভাই-বোন এবং তার স্বামী রোকেয়ার জীবনে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। বেগম রোকেয়া ১৮৯৮ সালে উর্দুভাষী ও বিপত্নীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তার জ্ঞানার্জনের পথ অধিকতর সুগম হয়। বেগম রোকেয়ার সাহিত্য চর্চার সূত্রপাতও হয়েছিল স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তিনি সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন ভাগলপুরে। তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গদ্য রচনার মধ্যে দিয়ে। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলো হলো মতিচুর, সুলতানার স্বপ্ন, অবরোধবাসিনী ও পদ্মরাগ।

বেগম রোকেয়া তার লিখালিখির মাধ্যমে নারীদের কুসংস্কারমুক্ত ও শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করেছেন সবসময়। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের শৃঙ্খলা থেকে নারীকে মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে গিয়েছেন তিনি। বেগম রোকেয়া আজীবন কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করলেও প্রগতিশীলতা ও আধুনিকতার নামে ধর্মীয় এবং সামাজিক মূল্যবোধের আদর্শ ও ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেননি কখনো। বাঙালি মুসলিম সমাজে বেগম রোকেয়াই সর্বপ্রথম শিক্ষা বিস্তারকে নারীমুক্তি ও প্রগতির বৃহত্তর অভিযাত্রার সাথে যুক্ত করেন। তার সমাজভাবনা মূলত নারীমুক্তি ভাবনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। বাঙালি মুসলিম সমাজে নারীর প্রতি যে নিষ্ঠুরতা ও অবিচার তার বিরুদ্ধেই ছিল রোকেয়ার আপসহীন সংগ্রাম। আর এ সামাজিক উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে তিনি শিক্ষাকেই প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষাবিস্তারই এই সব অত্যাচার নিবারণের একমাত্র মহৌষধ।’ শিক্ষা বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন, যা নারীদের মধ্যে তাদের আপন অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বোধ জাগাবে।

বেগম রোকেয়া শুধুমাত্র নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেননি, একাধারে তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারকও। তিনি মেহনতি মানুষের কথা বলতেন, বৈষম্যের শিকার মানুষের কথা বলতেন। তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘চাষার দুঃখ’ প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে তিনি কৃষকদের অমানবিক দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন। এছাড়া তিনি শুধু নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাই বলেননি, বাস্তবেও তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।

এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯১৬ সালে বাঙালি মুসলিম নারীদের সংগঠন ‘আঞ্জুমান খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে অসহায় নারীদের সহায়তা করা হতো বিভিন্নভাবে, বিধবা নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হতো, অসহায় ছাত্রীদের পড়ার খরচ দেওয়া হতো, দুস্থদের চিকিত্সার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করতেন।

এই অসামান্য অবদানের জন্য বাঙালি জাতি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম ছাত্রীনিবাস। রংপুরে তার নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’। পায়রাবন্দে তার পৈতৃক ভিটায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র’। মহিয়সী বাঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য আবাসিক হল “রোকেয়া হল” নামকরণ করা হয়। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হন।প্রতি বছর ডিসেম্বরের ৯ তারিখটি ‘রোকেয়া দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা নারীদের সরকারিভাবে প্রতিবছর প্রদান করা হয় বেগম রোকেয়া পদক। বাঙালি জাতি আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের কারিগর বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭