ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের বাণী বদলে গাওয়ায় সমালোচনার ঝড়


প্রকাশ: 09/12/2023


Thumbnail

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল' গানটি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র উৎসবে এ গানটি পরিবর্তন করে গাওয়া হয়েছে। যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। 

মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। এ সময় গানটি গাওয়ার জন্য দর্শকদের উঠে দাঁড়াতে বলা হয়। তারপর বিশিষ্ট শিল্পীরা গানটি পরিবেশন শুরু করেন। গানটি গাওয়ার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গানের মতোই গাওয়া হয়। তবে এর শেষ লাইনটি খানিকটা বদল করে গেয়েছেন শিল্পিরা। 

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তার কালজয়ী গান। মূল গানে থাকা ‘বাঙালির পণ, বাঙালির আশা' এবং ‘বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন' অংশটিকে ‘বাংলার পণ, বাংলার আশা', ‘বাংলার প্রাণ, বাংলার মন' করে গাওয়া হয়েছে বলে রেকর্ডিংয়ে শোনা যাচ্ছে। এই পরিবর্তন উৎসবের জমাটি আবহে সেভাবে নজর কাড়েনি। পরে তা নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা।

গানটির পরিবেশনায় ছিলেন রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী এবং গায়ক ইন্দ্রনীল সেন, শ্রীরাধা বন্দোপাধ্যায়, রূপঙ্কর বাগচী, ইমন চক্রবর্তী, মনোময় ভট্টাচার্য, অদিতি মুন্সীরা৷ মঞ্চে তখন উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 

ছাড়া বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও উপস্থিত ছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। এ ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলার সংগীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা।

গানের শব্দ পরিবর্তনের প্রস্তাব

কয়েকমাস আগে এ ধরনের পরিবর্তনের কথা উঠার পর তা করা যায় কি না জানতে চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তবে বিভিন্ন স্তরে এই নিয়ে আপত্তি থাকায় পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। রাজ্য সরকার জানিয়ে দেয়, গানটির শব্দে পরিবর্তন আনা হবে না।

মুখ্যমন্ত্রী বলার পরও কীভাবে পরিবর্তিত গানকে রাজ্য সংগীত হিসেবে গাওয়া হল, তা নিয়ে বিস্ময় ও প্রশ্ন জেগেছে৷ গানের শিল্পীরা এ ব্যাপারে উত্তর দেননি।  আবার কারো বক্তব্য, কাগজে যা লেখা ছিল, তাই গেয়েছেন! কেউ বলেছেন কী গেয়েছেন মনে নেই!

৭ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় রাজ্য সংগীত সংক্রান্ত বিল পাশ হয়। গত সোমবার বিধানসভা মিউজিয়ামে উদ্বোধনের সময় এই গান গাওয়া হয়েছিল। চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে এই গান বিকৃত পরিবেশিত হওয়ার পর তা নিয়ে চলছে সমালোচনা।

বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের কঠোর প্রতিক্রিয়া

ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলার সংগীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা৷ রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার বলেন, ‘‘এটা অপকর্ম৷ ক্ষমতার অপব্যবহার যে-ই করেছে, তাদের আমি তীব্র ধিক্কার জানাই। ইতিহাস নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। এই গানে রবীন্দ্রনাথ কথা লিখেছেন, সুর দিয়েছেন৷ এটা বদল করা যায় না৷''

বিশ্বভারতীর আশ্রমিক সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রবি ঠাকুর গান নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা পছন্দ করতেন না৷ সেটা তিনি নিজেই বলেছেন৷ তার পরও এই পরিবর্তন কাম্য নয়৷''

শিল্পী ও গবেষক শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বদলে গাওয়া এক ধরনের রাষ্ট্রীয় ঔদ্ধত্য। সকলের প্রতিবাদ করা উচিত৷ যে শিল্পীরা এই গান গাইলেন, তারা কেন প্রতিবাদ করলেন না? তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত। দেড়শো বছর ধরে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের গান শুনছেন, গাইছেন। ভোটে জিতেছি বলে সেটা পাল্টে দিতে পারি না।’

পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও উপস্থিত ছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তারাও এ বিষয়টি নজরে এনেছেন। 

প্যারোডি পরম্পরা

অবশ্য পাল্টা যুক্তিও রয়েছে৷ কেউ কেউ বলছেন, কিন্তু প্যারোডি তৈরি ও বাণীর ইচ্ছেমতো পরিবর্তন কি এক?

সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এই পরিবর্তনকে আমি সমর্থন করি না। রবীন্দ্রনাথের গান নজরুল ও দ্বিজেন্দ্রলাল পরিবর্তন করে প্যারোডি করেছিলেন। কিন্তু সেটা প্যারোডিই ছিল। তার মাধ্যমে কখনো বার্তা দেওয়া হত, কখনো বা নিছক ব্যঙ্গ বা হাস্যরস তৈরির চেষ্টা থাকত৷ রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দ বদলে দিলে সেটা রবীন্দ্রসংগীত থাকে না। তা হলে রাজ্য সংগীতের জন্য নিজেদের গান তৈরি করতে হতো।''

রবীন্দ্র থেকে নজরুল

কবিগুরুর সৃষ্টি আর এখন স্বত্বের অধীন নয়। তা বলে তার যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে মাঝেমধ্যেই। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ক অধ্যাপক রুমা মিত্র বলেন, ‘‘যে কোনো গান তার গীতিকার বা সুরকারের সম্পদ৷ সৃষ্টিকে বিকৃত করার অধিকার কারো নেই৷ এটা অনধিকার চর্চা। স্রষ্টা কী ভেবে গানে ওই কথা লিখেছেন, সেটা যারা পরিবর্তন করছেন, তারা কি জানেন? পরিবর্তন করার ফলে কি খুব ভালো জিনিস তৈরি হলো? এ নিয়ে আরো আলোচনা হলে এমন বিকৃতি এড়ানো যায়।’

সম্প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের গানে পরিবর্তন করায় সমালোচনার মুখে পড়েন বিখ্যাত ভারতীয় সুরকার এ আর রহমান। একটি ছবিতে ‘কারার ওই লৌহ কপাট' গানটি ভিন্ন সুর সংযোজনায় ব্যবহার করা হয়। তীব্র প্রতিবাদ জানান শিল্পীদের একাংশ৷ পরে ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেছে ছবির নির্মাতারা।

রবীন্দ্র গানের বদল নিয়ে তেমন প্রতিবাদ অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। আলোচনা পুরোটা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। 

শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘বাঙালি এখন মেরুদণ্ডহীন জাতি। তাদের সব প্রতিবাদ ওই ফেসবুক আর সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রতিবাদ করতে বাড়ির বাইরে বেরোতে হয় না, রাস্তায় নামতে হয় না।’





প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭