ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনেও গঠিত হয় সরকার


প্রকাশ: 11/12/2023


Thumbnail

নির্বাচন হলো এমন একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো দেশের জনগণ প্রশাসনিক কাজের জন্য একজন প্রতিনিধিকে বেছে নেয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যেকোনো দেশের জন্য এটি একটি আবশ্যিক প্রক্রিয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দেশের আইনসভার পদগুলি পূরণ করা হয়। তবে বিভিন্ন দেশেই নির্বাচন নিয়ে রয়েছে নানা রকম বিতর্ক। যতই সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলা হোক না কেন একটি দেশের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না বা বিতর্ক হবে না, এমনটা আজ পর্যন্ত কোথাও দেখা যায়নি। এমনই বেশ কয়েকটি নির্বাচন ঘিরে বিশ্বব্যাপী রয়েছে মুখরোচক বিতর্ক। বিতর্ক সত্ত্বেও এসব নির্বাচনে গঠিত হয়েছে নতুন সরকার। প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচারকে পাশ কাটিয়ে দেশগুলো চালিত হয়েছে নতুন ক্ষমতায়।

 

নাইজেরিয়ার নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ছিল না?

এ বছরের মার্চে সংঘটিত নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তোলা হয় দেশটিতে। নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হয়নি এ অভিযোগের সাথে সাথে ফলাফল প্রকাশের আগেই বিরোধী সব দল এই নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তোলেন। ক্ষমতাসীন দল ছাড়া ভোটগ্রহণে স্বচ্ছতার অভাব নিয়েও অভিযোগ করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। কিন্তু নাইজেরিয়ায় সামরিক শাসন অবসানের পর সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল এটি। লাখ লাখ মানুষ এই নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। সেনাশাসন শেষ হওয়ার পর প্রথমবারের মত এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন দেখে দেশটি। নাইজেরিয়ার আধুনিক গণতন্ত্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নির্বাচনটিতে। এরপরও এ নির্বাচন ঘিরে ছিল অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু এবং অবাধ না হবার অভিযোগ।

এই নির্বাচন আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে ভোট দেবার যোগ্য মানুষের সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ৭০ লাখ। আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট গ্রহণ শেষ হবার পরও দেখা যায় ভোটাররা লম্বা লাইনে ভোট দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। দেশটিতে ১৯৮৯ সালে সামরিক শাসনের অবসান ঘটার পর থেকে রাজনীতির অঙ্গনে প্রাধান্য পেয়ে এসেছে মূলত দুটি দল- ক্ষমতাসীন এপিসি এবং পিডিপি। এ বছর মার্চের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদু বুহারির উত্তরসূরী হিসাবে তৃতীয় আরেকটি দলের প্রার্থীর দিক থেকেও তৈরি হয় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। ঐ প্রার্থী ছিলেন লেবার পার্টির পিটার ওবি, যাকে সমর্থন করেছিল নাইজেরিয়ার বহু তরুণ ভোটার। ফলে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার যে অভিযোগ তা এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের কাছে একেবারেই ব্যর্থ হয়ে যায়।

কারচুপির অভিযোগ দেয়া এই নির্বাচনে উল্টো নাইজেরিয়ার তরুণদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ চোখে পড়েছিল। এবারে দেশটিতে ভোটদানের যোগ্যতাসম্পন্ন জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই ছিল তরুণ, যাদের বয়স ৩৫ এর নিচে। ফলে ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যেখানে মাত্র ৩৫% ভোট পড়েছিল ২০২৩ সালের নির্বাচনে সে তুলনায় অনেক বেশি ভোট পড়ে। লাখো মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছিলেন এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।

ক্ষমতাসীন অল প্রগ্রেসিভস কংগ্রেস পার্টির প্রার্থী ৭০ বছর বয়স্ক মি. বোলা টিনুবু, যিনি ২০০৭ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে লেগোসের গর্ভনর পদে থাকাকালীন সেই শহরকে দেশটির বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন, অবশেষে তিনিই মোট ভোটের ৩৭ শতাংশ পেয়ে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ী ঘোষিত হন। এরপর থেকেই আসতে থাকে অভিযোগের তীর। নির্বাচনটি একটি অবাধ, স্বচ্ছ, বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশিত ন্যূনতম মান পূরণ করতে পারেনি বলে মন্তব্য করেন লেবার পার্টির পিটার ওবি।

এদিকে টিনুবুর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) আতিকু আবুবাকার পান ২৯ শতাংশ এবং লেবার পার্টির পিটার ওবি পান ২৫ শতাংশ ভোট। বলা হয়েছিল, নাইজেরিয়ার ৩৬টি রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ ভোটের ২৫% যে প্রার্থী পাবেন এবং যিনি এককভাবে সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন তিনিই বিজয়ী ঘোষিত হবেন এবং কোন প্রার্থী নির্ধারিত সংখ্যক ভোট না পেলে ২১ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভোটাভুটি হবে। ফলাফলের প্রেক্ষিতে কোন প্রার্থী নির্ধারিত সংখ্যক ভোট পাননি এমন চিত্র কিন্তু দেখা যায়নি। তবুও তরুণদের পছন্দের পিটার ওবি এই ফলাফল চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তবে শেষ অবধি এই নির্বাচনে জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের চিত্র এবং বিরোধীদলের মোট ভোটের সংখ্যার কাছে এই নির্বাচনের ফলাফলকে বাতিল করার চেষ্টার যে পায়তারা তা ধোপে টিকতে পারেনি। গত মে মাসে বোলা টিনুবু প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

 

কম্বোডিয়ার বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে যত তর্ক:

ক্ষমতাসীন কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টির (সিপিপি) নেতা হুন সেন। সেই ১৯৮৫ সাল থেকে কম্বোডিয়া শাসন করছেন তিনি। বিগত ৩৮ বছর ধরে ৭০ বছর বয়সী এই হুন সেন কম্বোডিয়ার ক্ষমতায় আছেন। এ বছরের গত ২৩ জুলাই কম্বোডিয়ার সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টিসহ (সিপিপি) সব মিলিয়ে ১৮টি দল অংশ নেয়। কিন্তু কম্বোডিয়ার প্রধান বিরোধী দল ‘ক্যান্ডেল লাইট পার্টি’ নির্বাচনে অনুপস্থিত থাকায় বেশ সহজেই এবারও প্রধানমন্ত্রী হুন সেনই ক্ষমতার মসনদ নিশ্চিত করেন। বেশ বড় একটা সময় ধরে হুন সেন ক্ষমতায় আছে। সেই সাথে এবারের কম্বোডিয়ার জুলাইয়ের নির্বাচনে হেভিওয়েট বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করার কারণে তার অধীনে সংঘটিত নির্বাচন নিয়ে বিশ্বজুড়ে হয়েছে নানা বিতর্ক। কিন্তু এসকল বিতর্ককে পেছনে ফেলে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সংঘটনের মাধ্যমেই হুন সেন প্রতিবারের মতো এবারও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এই নির্বাচনে দেশটির প্রধান বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করে নির্বাচনটি বানচাল করার চেষ্টা চালায়। এর প্রেক্ষিতেই গত ২৩ জুন কম্বোডিয়ার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিপিপি দেশটির নির্বাচন আইন সংশোধন করেছে। যেখানে বলা হয়েছে— যদি কেউ নাগরিকদের ভোট না দিতে উৎসাহিত করে তবে তা অপরাধমূলক ‘উসকানি’ বলে বিবেচিত হবে।

সরকার সতর্ক করে বলেছিল, যারা এমনটা করবে তাদের জেল-জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে। হুন সেনে দাবি করেছিলেন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং যারা মানুষকে ভোটদানে বিরত রাখার ‘অপচেষ্টা’ চালায় তাদের রুখতেই এই আইন সংশোধন করা হয়। আর এই নতুন সংশোধিত আইনেই আবারও একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হুন সেন ক্ষমতায় আসেন। যেখানে কম্বোডিয়ার প্রধান বিরোধী দল ‘ক্যান্ডেল লাইট পার্টি’ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচনটিকে বানচাল করার যথাসাধ্য চেষ্টা করার পরও ব্যর্থ হয়। যদিও এবারের নির্বাচনের পর টানা চার দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা ৭০ বছর বয়সি হুন সেন তার ছেলের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন। তার বড় ছেলে রয়েল কম্বোডিয়ান সেনাবাহিনীর সাবেক কমান্ডার হুন ম্যানেটের কাছে এই ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি।

বিশ্বজুড়ে শুধু বাংলাদেশের নির্বাচনেই অনিয়ম হয় না। নির্বাচন নিয়ে টুকটাক অনিয়মের অভিযোগ পৃথিবীর সকল দেশেরই স্বাভাবিক ঘটনা মাত্র। কোনো দেশই নির্বাচনের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত বা পবিত্র নয়। এমন বহু অনিয়ম বা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হবার অভিযোগ পাশ কাটিয়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকার গঠিত হয় বা হচ্ছে, কারণ নির্বাচনের সাথে সাথে বিরোধীদলের এসব অভিযোগ যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসব গ্রাহ্য করলে কোনো দেশেরই সরকার গঠন কখনো সম্ভব হতো বলে মনে হয় না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ এক্ষেত্রে পাথেয় হিসেবে কাজ করে।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭