আজ ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ খ্রি:।
আমার বিবাহ বার্ষিকী। সাড়ে তিন বছর আগে জেবু চলে যাওয়ায়, শুধু আমার বার্ষিকী বলছি। ৩৪ বছর পার হলো। এটা নিঃসন্দেহে দীর্ঘ সময়। ১৯৮৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিয়ে এবং পরদিন ১৬ ডিসেম্বর গ্রামে বৌভাত হয়। বিয়ের তারিখ ১৪ ডিসেম্বর স্হির করতে চাইলে আমি মামাকে বলেছিলাম, এটা বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস। কতবার মহসিন হল থেকে ভোরবেলায় রায়ের বাজারে গিয়েছি। স্লোগান দিয়েছি, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দিব না ইত্যাদি। এদিনে আমাদের বিয়ের তারিখ হতে পারে না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিয়ে বললেন, "সঠিক বলেছ, আমার মনে ছিলনা"। তবে ১৫ তারিখে হোক, এবং শেষ পর্যন্ত তাই হলো।
২.
সবই ঠিক ছিল। কেবল বরযাত্রী গমনের পথে বিপত্তি সৃষ্টি করলো আকস্মিক ঘটে যাওয়া এক হঠকারী কান্ড। পাকুন্দিয়ার এক অজ গ্রাম শিমুলিয়ায় মেজর (অবঃ) মতিউর রহমান নামের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। তিনি তখন পীর মতিউর রহমান নাম ধারণ করেছিলেন। যতদূর জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অনন্য সাধারণ ভূমিকা ছিল। কিশোরগঞ্জ শত্রুমুক্ত হওয়ার দিবসে তিনি ক্যাপ্টেন হামিদ নামেই পরিচিত ছিলেন। সেদিন তিনি বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। শিমুলিয়া গ্রামের পরিস্থিতির ভয়াবহতা এমন হলো যে, গোলাগুলির পর্যায়ে চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পরে মানুষ গেরিলা যুদ্ধের তাণ্ডব দেখেছিল। এতে অসংখ্য প্রাণহানী ঘটে। জানা যায়, সেদিন পীরের ভক্ত অন্তত ২২ জন অনুসারী মৃত্যুবরণ করে। যাদের মৃতদেহ পোস্ট-মর্টেম করতে কিশোরগঞ্জে আনা হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত এরা নাকি আফগান বাহিনীর মতন বিশেষ পোশাকে সশস্ত্র সজ্জিত হয়ে ছিল। টার্গেট, পীরের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া। ক্ষমতার সিঁড়িতে পা রাখা। তখন কিশোরগঞ্জ শহরে প্রবেশের রাস্তা সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ঘটনা মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী সর্ব্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। চতুর্দিকে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। সম্ভবত তখন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুজ্জামান এবং পুলিশ সুপার সদ্য প্রয়াত সাবেক আইজিপি নূরুল আনোয়ার। বলাবাহুল্য, আমি তখন প্রশাসন ক্যাডারের সহকারী কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মনোনীত (designate) । ২০ ডিসেম্বর '৮৯ রাজশাহীতে যোগদান করার কথা।
৩.
সেকালে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংকটেও এটা তাবৎ পৃথিবীর সংবাদ হয়ে উঠেছিল। বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার সকাল সন্ধ্যার বাংলা পর্বের সংবাদগুলিতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ঘটনা স্বচক্ষে দেখে এসেও রেডিওতে কান পেতে থাকতো অগণিত মানুষ। কিশোরগঞ্জ হয়ে ওঠলো টক অব দি কান্ট্রি। তখনো গোটা দেশ দীর্ঘ সামরিক শাসনের করতলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস জুড়ে জেনারেল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতির পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এর ভেতরেই একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর তার ধর্মীয় মতবাদের ঝান্ডা উড়িয়ে দিল প্রত্যন্ত গ্রামে। ভাবলে আজও আমি শঙ্কিত বোধ করি, শিউরে ওঠি।
৪.
তখনো কিশোরগঞ্জে সবেমাত্র হাতে গোনা দু'চারটা ভিডিও ক্যামেরার আগমন ঘটেছে। আমাদের বিয়ের সামান্য আনুষ্ঠানিকতার পর্বটি ধারণ করে রাখার উদ্দেশ্যে যাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, ঠিক মাহেন্দ্রক্ষণে এদের আর হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিক ওদিক থেকে খোঁজ নিয়ে শেষে সংবাদ এলো ক্যামেরা ওয়ালাকে হাইজ্যাক করা হয়েছে। এদেরকে জোর করে পুলিশের গাড়িতে উঠিয়ে সোজা মেজরের আস্তানায়। সেদিনকার সকল ভিডিও রেকর্ডিং কারও সামাজিক অনুষ্ঠানের না হয়ে হয়েছিল শিমুলিয়ার কুরুক্ষেত্রের। তাই আমাদের ছোট্ট ও অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানটির কোনো লাইভ ভিডিও নেই। এটা থাকার আর সুযোগও নেই। আছে কাঁচা হাতের তোলা কতিপয় স্থিরচিত্র। এসব নিয়ে আমার কোনো কালেই উৎসাহ বা ভ্রুক্ষেপ না থাকলেও জেবুর মনখারাপের অন্ত ছিল না। প্রায়ই বলতো, 'মানুষের কত সুন্দর জীবন্ত দৃশ্য আছে, কেবল আমাদের নাই। এ ভিডিও থাকলে আজ আব্বাকেও হাঁটতে কথা বলতে দেখতে পেতাম'। আমি বরঞ্চ উল্টো মজা করে বলতাম, যতদিন বুদ্ধিজীবী দিবসের পরে মহান বিজয় দিবস পালিত হবে, ততদিনই আমাদের তারিখটা সরকারি খরচে বর্ণিল আলোক সম্পাতে বেঁচে থাকবে। সে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলতো, মানুষের ভাগ্য বলে কথা!
৫.
আহা! মানুষের জীবন কী বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর। চোখ কী বিস্ময়কর সম্পদ। ঘটনার পৌনঃপুনিক ঘনঘটায় সময় যেমন দ্রুত ফুরিয়ে যায়, ভুলে যেতে যেতে একদিন অলক্ষ্যে মানুষও হারিয়ে যায়। তবুও স্মৃতি, স্হান, কাহিনি ও ভাষা যেনো অম্লান অক্ষয়।
লেখক: গল্পকার ও কলামিস্ট।