ইনসাইড বাংলাদেশ

অনেক হারানোর মধ্য দিয়ে এল স্বাধীনতা-মুক্তি-বিজয়: ডঃ অজয় রায়


প্রকাশ: 16/12/2023


Thumbnail

ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে স্বাধীন হয় আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ নামক একটি ভূখন্ড। বাংলাইনসাইডার এই বিজয়ের মাসে ধারাবাহিক ভাবে ‘চতুর্দশপর্বে’ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র পঞ্চদশ খন্ড’ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ড.অজয় রায়ের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করছে-

২৫শে মার্চের কাল রাত্রিতে ইয়াহিয়ার সামরিক চক্রের চাতুরিতে ঢাকায় শিল্পী কামরুল হাসান অঙ্কিত ইয়াহিয়ার জানোয়ার মুখ উন্মোচিত হল। শুরু হল অপারেশন সার্চলাইট, হল নয় মাসব্যাপী গণহত্যাযজ্ঞের উদ্বোধন-বাংলার রক্তে, বাঙালীর রক্তে।

কামান, মর্টার আর মেশিনগানের বিকট কানফাটা গর্জনে সে রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। প্রচণ্ড শব্দে ভেঙ্গে গিয়েছিল জানালার কাঁচ। আর্ত মানুষের অসহায় চীৎকারকে ছাপিয়ে সারারাত ধরে শুনেছিলাম আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ, ট্রাক ও ট্যাঙ্কের পদচারণ ধ্বনি। শঙ্কিত চিত্তে আমরা অপেক্ষা করছিলাম যে কোন মুহূর্তে পৈশাচিক বাহিনীর উপস্থিতি। বুঝতে কষ্ট হয়নি সারারাত ধরে কিসের হোলি উৎসব-কাদের রক্তে ঢাকার রাজপথ পরিণত হচ্ছে রক্ত-নদীতে।

যা আমরা আশঙ্কা করেছিলাম অবশেষে তাই ঘটল। সারাদেশের সাথে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজও অপেক্ষা করছিলাম উদ্বেগব্যাকুল চিত্তে ইয়াহিয়া-মুজিবের আলোচনার ফলাফল। অসহায়ভাবে লক্ষ্য করছিলাম ইয়াহিয়া সরকারের সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি। আমরা আশঙ্কা করছিলাম এ ধরনের এক ভয়ংকর পরিস্থিতির, অনুমান করেছিলাম আসন্ন গণহত্যার পূর্বাভাষ। তাই মার্চের ২২/২৩ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ও দেশের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে গণহত্যার পূর্বাভাষ জানিয়ে আমরা প্রেরণ করেছিলাম জরুরী বার্তা-ইউ, এন, ও-র সেক্রেটারী জেনারেল ও বিশ্বের অন্যান্য নেতৃবর্গের কাছে। আমাদের আশঙ্কা অমূলক ছিল না।

সে রাত্রে পাকিস্তানের বীর জোয়ানেরা কত বাংগালীকে হত্যা করেছিল তার সংখ্যা হত্যাকারীরাও বলতে পারবে না। শুধু এটুকু জানি-রাজারবাগে শত শত পুলিশ প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে নীলক্ষেত কমলাপুর এলাকার শত শত বস্তিবাসী, আত্মাহুতি দিয়েছে জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলের অসহায় ছাত্ররা, রাস্তার অসহায় নিরস্ত্র মানুষ আর রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেড তৈরীরত শত শত সাধারণ মানুষ ও অকুতোভয় শ্রমিকেরা।

সব রাতের শেষ আছে। ২৫শে মার্চের কালরাত্রিও এক সময় পোহাল। দূরাগত আজানের ধ্বনি ভেসে আসল। না-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ থেকে সেদিন আজানের ধ্বনি উচ্চারিত হয়নি-সাহস পাননি নামাজের আহবান জানাতে ধর্মপ্রাণ মুয়াজ্জিন। যেন মনে হল দূরাগত ঐ আজানের ধ্বনির মধ্যে সারা বাংলাদেশের কান্না ঝরে পড়ছে। এমন বিষাদ আর ক্রন্দনময় আজান ধ্বনি জীবনে শুনিনি।

রাত পোহাল, সকাল হল, ২৬শে মার্চের সকাল। সূর্যদেব কি সেদিন আমাদের সাথেও কেঁদেছিল, না, রোষে গর্জন করে ছড়িয়েছিল দাবাগ্নি! পর্দা সরিয়ে দেখলাম আমাদের এলাকায় বেশ কিছু সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের উপস্থিতি। দেখলাম মাঠের এককোণে জড় করা কয়েকটি মৃতদেহ, চোখের সামনে টেনে নিতে দেখলাম পাশের ভবনে একতলার অধিবাসী মুকতাদিরের মৃতদেহ। 

দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডঃ মুর্তজাকে দিয়ে ও আরও কয়েকজনকে দিয়ে আমাদের ভবনের দিকে এল। আতঙ্কে অপেক্ষা করছিলাম যে কোন মুহূর্তে মৃত্যুদূতের আগমন। নীচের তলায় লোকজন ছিল না কিছুক্ষণ দরজায় লাথি মারল, সৌভাগ্য ওরা চারতলা পর্যন্ত উঠে এল না। একটু পরে লাশগুলি নিয়ে আমাদের উদ্দেশে পুনর্বার সাবধানবাণী উচ্চারণ করে ওরা স্থান ত্যাগ করল। আমরা বাঁচলাম।

রেডিওতে ঘোষিত হল, অবাঙালী কণ্ঠে, কর্কশ আর ভাংগা বাংলায়, সারাদেশে কঠোরভাবে সান্ধ্য আইন বলবৎ করা হয়েছে: রাস্তায় বা ঘরের বাইরে দেখা মাত্র গুলি করা হবে। পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী প্রতিরোধ আন্দোলনকে ভেংগে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। স্নান মুখে সহধর্মিণী পাশে এসে দাঁড়াল। উদ্বেগ ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করল 'বঙ্গবন্ধুর' খবর কি? কি জবাব দেব! আমিও ভাবছিলাম তাঁর কথা। পেরেছেন কি নিজেকে বাঁচাতে? নিরাপদ স্থানে সরে গিয়েছেন কি! ভাবছিলাম অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কথা, ছাত্র নেতাদের কথা। পরে সন্ধ্যায় শুনলাম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার রেডিও ভাষণ-সমগ্র পরিস্থিতির জন্য বাংগালী, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করে কুৎসিৎ ও অশালীন ভাষায় আক্রমণ করলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে স্বয়ংসিদ্ধ প্রেসিডেন্ট কর্কশ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন- The man and his party are the enemies of Pakistan......He had attacked the solidarity and integrity of Pakistan-this crime will not go unpunished." সেই কণ্ঠ এতদিন পরে আজও আমার কর্ণে ধ্বনিত হয়।

এত নিরাশার মধ্যেও আশার আলোর ঝলকানি বয়ে আনল 'আকাশবাণী'-ভেসে এল রেডিও তরংগে মধুর আশ্বাসবাণী-"সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি'। আকাশবাণী জানাল পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার আশেপাশে, রংপুর, দিনাজপুরে, কুষ্টিয়া, যশোর, চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে বাঙালী মুক্তিফৌজের যুদ্ধ চলছে। রাত্রে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকাও শোনাল একই বার্তা। এত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও আশ্বস্ত হলাম, না, বাঙালী রুখে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

পথে পথে মিলিটারী-চোখে চোখে তাদের দানবীয় দৃষ্টি। দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে ঘৃণা। তার মধ্য দিয়ে ক্লান্ত- স্নান-বিষণ্ণ মুখে ফিরে এলাম বাসায়। এলাকা প্রায় জনশূন্য। সহকর্মীরা চলে গেছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। উদ্বিগ্না মাতা, উৎকণ্ঠিতা স্ত্রী জানতে চাইলেন আমরা কোথায় যাব? বুঝতে পারছিলাম নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া উচিত, কিন্তু কোথায় যাব? ঢাকার, বাংলাদেশের কোন স্থান আজ নিরাপদ? একবার ভাবলাম নদীর ওপারে জিঞ্জিরার দিকে যাওয়ার, যেদিকে সবাই যাচ্ছে। কিন্তু মিলিটারী চক্রব্যূহ ভেদ করে হাঁটা পথে সদরঘাট পর্যন্ত যাওয়ার ঝুঁকি অনেক, আর সেদিকেরও যে কি অবস্থা কে জানে। পরে শুনেছিলাম পলায়নপর নিরস্ত্র জনতার ওপর সদরঘাট এলাকায় নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে অসংখ্য নরনারী-এই পিশাচ বাহিনী।

২৭শে মার্চ থেকে শুরু হল আমার পলাতক জীবন, আত্মগোপনের পালা। ঢাকার নানা স্থানে-কখনও সপরিবারে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পালিয়ে বেড়িয়েছি। পরে জেনেছি বিশ্ববিদ্যালয় আবাসে একাধিকবার মিলিটারী আমার সন্ধানে গিয়েছিল। বহুবার বিপদের মধ্যে পড়েছি। তবু সাহস করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি সে সময়, দেখেছি ওদের অত্যাচারের নানা রূপ অসহায়ভাবে। ওদের নারকীয় কাণ্ডকারখানা আর অত্যাচার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছি। সেই দুঃসময়ে ঢাকায় আত্মগোপনে যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও আমাকে এবং আমার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল, নানাভাবে সাহায্য করেছিল তাদের কথা কোনদিন ভুলব না।

২৮শে মার্চ রাত্রে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে তোপ দেগে গুঁড়িয়ে দেয়া হল। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতীক-আমাদের সংগ্রামের প্রতীক এখন মসজিদে রূপান্তরিত। রিক্সা করে একদিন ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার কালে দেখলাম-কারা যেন সবুজ রঙে বাংলা ও উর্দু বড় বড় হরফে লিখে রেখেছে "মসজিদ-মসজিদ"। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক রাত্রে ডিনামাইট দিয়ে ঐতিহাসিক রমনা কালী মন্দির উড়িয়ে দেয়া হল-ধূলিস্যাৎ করা হল আনন্দময়ী আশ্রম। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে খবর পেলাম মোহাম্মদপুর এলাকার অনেক বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছে। 

বুঝতে পারছিলাম সপরিবারে ঢাকায় আর থাকা নিরাপদ নয়। শুভানুধ্যায়ীরা বিশেষ করে ডঃ আজাদ পরামর্শ দিলেন ঢাকা ছেড়ে মুক্তাঞ্চলে চলে যাওয়ার। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অসুস্থ স্ত্রী আর বৃদ্ধা মাতাকে নিয়ে। ১১ই এপ্রিল আকাশাবণীর মারফৎ জানলাম মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার কথা। ইতিমধ্যে স্বাধীনতার কথা ঘোষিত হয়েছে-যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। পরে আগরতলায় আমার এক ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা- সঞ্জয়ের সাথে দেখা হওয়ায় তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা নোয়াখালী শহরে কিভাবে স্বাধীনতার কথা জানতে পারে। সে আমায় জানিয়েছিল যে, ২৭শে মার্চ সকাল থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এ সম্পর্কে মাইকযোগে প্রচার করতে থাকে এবং বঙ্গবন্ধুর বাণী সম্বলিত একটি হ্যান্ডবিল জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। 

আত্মীয়রা গ্রামে আছেন-ওদিকে মিলিটারীর দৌরাত্ম্য নেই। মুক্তাঞ্চল বলা চলে। সে আমাদের ওখানে নিয়ে যেতে রাজী হল। ওর নাম নুরুল ইসলাম। স্থির হল নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চ বা নৌকায় আমরা ঐ গ্রামের দিকে যাব। ডঃ আজাদ পরামর্শ দিলেন হিন্দু পরিচয়ে কিছুতেই যাওয়া যাবে না। যেতে হলে মুসলমান পরিচয়ে। কিন্তু বিপত্তি হল মাকে নিয়ে। মা কিছুতেই প্রথম জিজ্ঞাসাতে মুসলমান নাম বলতে পারেন না, মুখ দিয়ে আসল নাম বেরিয়ে আসে। অতএব স্থির হল আমরা রাস্তায় জিজ্ঞাসাবাদের পাল্লায় পড়লে নেটিভ ক্রিশ্চিয়ান পরিচয় দেব। নাম স্থির করার প্রয়োজন নেই। ক্রিশ্চিয়ানরা বাংলা নামেই পরিচয় দেয়। হলিক্রস কলেজের পরিচিত এক সিষ্টারের কাছ থেকে 'ক্রশ', কিছু বাংলা ও ইংরেজী বাইবেল ও অন্য পুস্তক যোগাড় হল। মা ও স্ত্রী 'ক্রশ' ঝুলালেন গলায়। স্থির হল ১৫ই মে আমরা ঢাকা ত্যাগ করব। ডঃ আজাদ ওর প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসেবে পরিচয় পত্র জোগাড় করে দিলেন।

কয়েকদিন গ্রামে কাটালাম। একদিন রাতে দাউদকান্দি-কুমিল্লা মহাসড়কের দু'পাশের কয়েকটি গ্রামে মিলিটারী অপারেশন চালাল। এর ঢেউ আমাদের গ্রামেও এসে লাগল। গ্রামবাসীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল। বিশেষ করে হিন্দু জনসাধারণ। আমার আত্মীয়রাও স্থির করল ওরা ভারতে চলে যাবে কিছু দিনের মধ্যেই। তাই স্থির করলাম ভারতে গিয়েই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার। স্থির করলাম ২২শে মে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব। স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর একটি ছোট দলও আমাদের সাথে যাবে তবে ওরা ভিন্ন পথে, আমরা মিলিত হব সি এন্ড বি রোড পার হয়ে গোমতী নদীর ওপারে। গভীর রাত্রে একজন পথ প্রদর্শক সাথে নিয়ে আমরা আবার পথে নামলাম। দীর্ঘপথ কখনও হেঁটে, কখনও নৌকাযোগে পেরিয়ে আশ্রয় নিলাম চান্দিনার কাছে এক গরীব নাপিতের বাসায়। 

সেদিন বিকেলে ভারতীয় চলচ্চিত্র, ডকুমেনটেশন বিভাগ আমার একটি সাক্ষাৎকার চিত্রায়িত করল। ঢাকা ও বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলছে তার একটি বিশদ বিবরণ দিলাম। এই চিত্রায়ন পরে ভারতের নানা স্থানে প্রদর্শিত হয়েছিল। পরদিন ছিল নজরুল জয়ন্তী, সত্যবাবুর উদ্যোগে উদ্বাস্তু ও যুবশিবিরের ছাত্ররা অনুষ্ঠান করল। আমরা অনেকেই বক্তৃতা করলাম। দেখা হল চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীর সাথে। তাঁকে সব জানালাম। তিনি পরামর্শ দিলেন কোলকাতায় চলে যাওয়ার জন্য। সেখানে মুজিব নগরস্থ বাংলাদেশ সরকার ও ডঃ এ আর মল্লিকের সাথে দেখা করার জন্য। সেখানে আমাদের মত লোকের নাকি বিশেষ প্রয়োজন।

স্থির করলাম কোলকাতা চলে যাওয়ার। কয়েকদিন শরণার্থী শিবির ও যুবশিবিরে ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশ থেকে আগত বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজনদের কাছ থেকে পাক বাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করলাম। দেখা হয়েছিল দেবদাস চক্রবর্তী ও ডঃ এস আর বোসের সাথে। সমস্যা দেখা দিল অসুস্থ স্ত্রী ও মাকে নিয়ে। ওঁদের চিকিৎসা ও বিশ্রামের প্রয়োজন। স্থির হল আসামে শিবসাগরে কর্মরত বড় ভাইয়ের কাছে মা ও স্ত্রীকে রেখে আমি কোলকাতা চলে যাব। 

কোলকাতা পৌঁছলাম জুন মাসের মাঝামাঝিতে। আশ্রয় পেলাম মাসীমার ভবানীপুরস্থ বাসায়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সাথে দেখা করলাম তিনি আমাকে বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যানিং সেলের সাথে যুক্ত থেকে কাজ করার নির্দেশ দিলেন। যোগাযোগ হল ডঃ এ আর মল্লিক, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ খান সারওয়ার মুর্শিদ, অধ্যাপক আলী আহসান ও অন্যান্য অনেকের সাথে। মুক্তিযুদ্ধের কাজে সর্বাত্মকভাবে নেমে পড়লাম। ডঃ আনিসুজ্জামান সরকারের বিশেষ কাজে জড়িয়ে পড়ায় মে মাসে গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব আমার উপর বর্তাল। অবরুদ্ধ ঢাকায় অবস্থানকালে ও বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে নারকীয় হত্যার একটি প্রতিবেদন আমরা তৈরী করেছিলাম সেসময়। 

জয়নুল আবেদীন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, ঢাকা থেকে চলে এসেছেন। ওঁর কাছ থেকে ঢাকার বিস্তারিত খবর পাওয়া গেল। ঢাকায় গেরিলাদের কর্মতৎপরতার কথা জানা গেল। খবর পাওয়া গেল মুনীর চৌধুরীর, অধ্যাপক হাবিবুল্লাহর, কবি শামসুর রাহমানের, হাসান হাফিজুর রহমানের। তিনি আরও জানালেন-ঢাকার কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন সাহসিকতার সাথে।

অবশেষে এল সেই দিন ৩রা ডিসেম্বর। সন্ধ্যে সাতটায় এলগিন রোডে নেতাজীভবনে সম্বর্ধনা সভা-উত্তর ইউরোপীয় কয়েকটি দেশের ডেমোক্রেটিক সোস্যালিষ্টিদের একটি প্রতিনিধিদলের আগমন উপলক্ষে। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করান হচ্ছে তাদের। হঠাৎ শিক্ষক সমিতির জনৈক কর্মী সভা থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে এল। জানাল, পাকিস্তানী বিমান ভারতের গভীরে নানাস্থানে হামলা চালিয়েছে। আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলাম সেদিন। আমাদের স্বাধীনতা আসন্ন। যুদ্ধ শুরু হল। ভারতীয় বাহিনী যোগ দিলেন আমাদের সাথে মিত্র বাহিনীরূপে।

কিন্তু এরই মধ্যে হৃদয়বিদারক খবর এল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৩ই ডিসেম্বর পাকসৈন্য ও তাদের অনুচরেরা হত্যা করেছে ৪০ জন বিশিষ্ট নাগরিককে। বিচলিত হয়ে পড়লাম, আশঙ্কা করলাম হয়তো ঢাকাতেও অনুরূপ ঘটেছে বা ঘটতে চলছে। কোলকাতায় মিত্র বাহিনীর সদর দপ্তরের সাথে, বি এস এফ-এর সাথে যোগাযোগ করে আবেদন জানালাম, যে করেই হোক, ঢাকাস্থ বুদ্ধিজীবীদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবন রক্ষা করতে হবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘন ঘন আবেদন জানান হল-নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার। কিন্তু আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। স্বাধীনতার প্রাকমুহূর্তে আমরা হারালাম শ্রেষ্ঠ সন্তানদের-চরম মূল্য দিতে হল স্বাধীনতার। তবু এর মধ্য দিয়ে এল স্বাধীনতা। মুক্তি। বিজয়। আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তানী বাহিনী, বিনাশর্তে, যৌথ কম্যাণ্ডের কাছে। দিনটি ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭