ইনসাইড বাংলাদেশ

আনন্দাশ্রু নিয়ে দেশে ফেরেন জাতীয় নেতারা


প্রকাশ: 22/12/2023


Thumbnail

মানুষ ইতিহাস আশ্রিত। অতীত হাতড়েই মানুষ এগোয় ভবিষ্যৎ পানে। ইতিহাস আমাদের আধেয়। জীবনের পথপরিক্রমার অর্জন-বিসর্জন, জয়-পরাজয়, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি একসময় রূপ নেয় ইতিহাসে। আজ ২২ ডিসেম্বর। কিছুদিন আগেই ১৬ই ডিসেম্বর গেল আমাদের বিজয়ের দিন। কিন্তু ১৯৭১ সালের বিজয়ের ঠিক পরপরের সময়টা কেমন ছিল? সেই সময় এই ২২ ডিসেম্বর দিনটিতে কি ঘটেছিল? আজ কিছুটা জেনে আসি, ফিরে দেখে আসি সে সময়টা।

২২ ডিসেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় ফিরে পুষ্পবৃষ্টি ও অশ্রুজলে সিক্ত জাতীয় নেতারা

ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ উড়োজাহাজে ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বিকেল পৌনে ৫টার দিকে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান, অর্থ ও শিল্পমন্ত্রী এম মনসুর আলী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকসহ মন্ত্রীসভার ৭ সদস্য।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের পদার্পণের মধ্য দিয়ে ঢাকা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়। এ সময়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাদের দেখতে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। উড়োজাহাজ থেকে নামার সময় লাখো জনতা জয় বাংলা স্লোগান দিতে থাকে। বিমানবন্দরে তাদের গণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিমানবন্দরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার সদস্যদের গার্ড অব অনার প্রদান করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যরা।

এ দিন সকালে বাংলাদেশ বেতারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী আসার ঘোষণার পর থেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অগণিত মিছিল হাতে প্ল্যাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে বিমানবন্দরের দিকে আসতে থাকে মানুষ।

বিমানবন্দরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, 'গত ৯ মাসে হাজারো বাঙালির রক্ত বাংলাদেশের মাটিতে ঝরেছে। তবুও এই নবজাত রাষ্ট্র গড়ার জন্য আমরা আরও রক্ত দিতে প্রস্তুত। বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য এবং পৃথিবীর কোনো শক্তিই এই বাস্তবকে অস্বীকার করতে পারে না। আজকের এই দিনেও সমস্ত জাতির বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনি শত্রুর কারাগারে বন্দি। তবে আমরা শীঘ্রই তাকে মুক্ত করে আনবো।'

তিনি আরও বলেন, 'এই মুহূর্তটি আমার কাছে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। আমরা যে এভাবে ফিরে আসতে পারবো কখনো ভাবিনি।'

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেসব শক্তি ষড়যন্ত্র করছে তাদের সতর্ক করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, 'কোনো জাতিরই বাংলাদেশের ক্ষতি করার সাহস থাকা উচিৎ নয়। ইয়াহিয়া যেমন আজ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে ঠিক তেমনই শত্রুদের অবস্থাও এমন হবে।'

ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, 'ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব পরস্পরের সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই ভারতের জনগণ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি। ভারত এক মহান জাতি। তারা তাদের নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত থাকা সত্ত্বেও আমাদের মুক্তি সংগ্রামে সহায়তা করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পোল্যান্ড, ভুটানসহ যেসব বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো আমাদের সমর্থন এবং স্বীকৃতি দিয়েছে তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা থাকবে।'

তিনি আরও বলেন, 'সকল কৃতিত্বের অধিকারী বাংলার মানুষ। যেসব বাঙালি যুবক অস্ত্র ধারণ করেছে, প্রাণ দিয়েছে তারা প্রমাণ করেছে যে বাঙালি যুদ্ধ করতে জানে, অকাতরে প্রাণ দিতে জানে। সাড়া পৃথিবীর কাছে তারা বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেছে, ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।'

বক্তব্যের শেষ দিকে তিনি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সবাইকে শপথ নেওয়ার আহ্বান জানান।

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার বক্তব্যে  প্রথমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, 'শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে তারা প্রেরণার হয়ে থাকবেন।'

তাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, 'বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য যে গণবিপ্লবে মেতে উঠেছিলেন, সেই বিপ্লব থেমে গেলে চলবে না, বরং বিপ্লবকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে গঠনমূলক কাজে।'

তিনি বলেন, 'সাম্যবাদী অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ কায়েম করা যখন সম্ভব হবে, তখনই বিপ্লব সম্পূর্ণ হবে। শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে কাউকে বাধা সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না। আমরা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে বিস্ময়ের সঙ্গে উপস্থাপন করবো। শহীদের রক্তে গড়া এই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে সমুজ্জ্বল হয়ে টিকে থাকবে।'

এরপর একে একে মন্ত্রীসভার সদস্যরাও বিমানবন্দরে বক্তব্য দেন। বাংলাদেশ বেতার সরাসরি বিমানবন্দর থেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার সদস্যদের ঢাকায় ফিরে আসা উপলক্ষে সরাসরি ধারা বর্ণনা দেয়।

বিমানবন্দর থেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার সদস্যরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

এর আগে তারা কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে এলে হাজারো মানুষ তাদের দেখতে আসেন। এ সময় তাদের বিদায়ী সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, 'ঠিক এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর কথা। জানি না তিনি কেমন আছেন, কি অবস্থার মধ্যে আছেন, তবে তার স্মৃতি কেমন করে ভুলি?'

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সাংবাদিকেরা বিদায় মুহূর্তে তার অনুভূতির কথা জানতে চাইলে তার চোখ পানিতে ভরে উঠে। তিনি ধীর গলায় বলেন, 'ভারতের ৬০ কোটি মানুষের জন্য রেখে যাচ্ছি বুক ভরা ভালোবাসা। আর যিনি ভারতের নেতৃত্বও দিচ্ছেন সেই শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি জানাচ্ছি সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির কৃতজ্ঞতা।'

তাজউদ্দীন আহমদের কাছেও বিদায়ী অনুভূতির কথা জানতে চান সাংবাদিকেরা। জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ হিসেবে আজ আমরা ফিরে যাচ্ছি। নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে। আমাদের এখন লক্ষ্য হবে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা। তাহলেই আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানানো হবে।'

দেশব্যাপী এ দিন:

২২ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ঘোষণায় বলা হয়, আজ দেশের বিভিন্ন জেল থেকে প্রায় দেড় হাজার রাজবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪০০ বন্দিই ঢাকা ও যশোর জেলে আটক ছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক এক ঘোষণায় বলে, আগামী সোমবার থেকে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে পুরোদমে কাজ শুরু হবে।

এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে এক সভায় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যারা হত্যা করেছে তাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে গণ্য করে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য করার জন্য দাবি জানানো হয়। এ সময় দাবিতে আরও বলা হয়, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনীর যে সব ব্যক্তি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল তাদের বিচার করতে হবে।'

একই সঙ্গে সভায় বলা হয়, 'পাকিস্তান সরকারের এই পরিকল্পিত গণহত্যার জন্য শাস্তি প্রদান করতে জাতিসংঘকেও এগিয়ে আসতে হবে।' সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ড. এম এ লতিফ।

এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক প্রেসনোটে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নাম তালিকা প্রকাশ তবে। তবে এতে বলা হয় 'সমস্ত শিক্ষক এবং গবেষকদের এখনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে তারাও হানাদারদের শিকার হয়েছেন।'

 মুজিবনগর সরকার:

এ ছাড়াও মুজিবনগর সরকার, যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার নামেও পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল জনগণের রায়ে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান মুজিবনগর) শপথ গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। 



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭