লিট ইনসাইড

আমার ২০২৩ খ্রি.


প্রকাশ: 01/01/2024


Thumbnail

বছরের শেষ দিনের গোধূলির  আবছায়ায় আকাশের দিকে  তাকিয়ে ভাবছিলাম, নিতান্তই গতানুগতিক ধারায় আরও একটা বছর চলে গেল। চলে যাওয়া মানে, জীবনতরী নামক সময়ের ভেলায় ভেসে যাওয়া কোলাহল থেকে আরও ৩৬৫ দিন কমে গেল। চিরতরে ফুরিয়ে গেল সে দিনগুলি। যা আর কখনো কারও হাতের মুঠোয় ধরা দিবে না। এত নিঃশব্দ নিরাসক্ত বা নিরানন্দ সময় আগে কখনো যাপন করি নি। তবুও করতে হয়েছে, না করেও উপায় ছিল না। মানুষকে অনেক কিছু পারতে হয়। বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে এটা নতুন অভিজ্ঞতা লাভের মতন। বছরটার অনেকদিন আমি দুপুর থেকে বিকাল অবধি একাকীত্বের সঙ্গে কথা বলে পার করেছি। হ্যাঁ, নিঃসঙ্গতাও কখনো ভালো বন্ধু হয়ে ওঠতে পারে। যেমন,অন্ধকারের মধ্যেও অনুপম সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে।

ধরা যাক, আমার চারপাশে কেউ নেই, অসংখ্য শূন্য চেয়ার-টেবিল, দেশি-বিদেশি পত্র-পত্রিকা এবং বইপুস্তকের অগণিত সারি। শেলফের পর শেলফে বইগুলি সুবিন্যস্তভাবে থরে থরে সাজানো রয়েছে। আমি একটা পুরানো  বইয়ের পাতায় চোখ পেতে শব্দহীন একা বসে আছি। কখনো বা হাতের  ইলেকট্রনিক যন্ত্রটির গায়ে কোমল স্পর্শ করে এটা-ওটা লিখে সময়কে বিদায় দিয়েছি। সারাদিন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কারো ফোন কল নেই, একটু গুরুত্ব আছে এমন কাউকে ফোন করলেও সাড়া নেই। অথচ কিছুদিন আগেও এদের মুক্তোঝরানো কথামালায় আমি মুগ্ধ বিভোর থেকেছি। তবে নিজের জন্মভিটার গ্রাম থেকে মাঝেমধ্যে কিছু মানুষের আবদার শুনেছি। এরা খুবই সামান্য, বলা যায় নূন্যতম সামাজিক অস্তিত্বের অধিকারী সাধারণ। ফোনে তারা নিজের বা পারিবারিক সমস্যার ফিরিস্তি জানিয়ে সান্ত্বনা খুঁজেছে। যদিও এদের নাম আমার ফোনে লিপিবদ্ধ নেই। প্রান্তিক এ মানুষগুলির জন্য বছরব্যাপী আমার সাধ্যাতীত প্রচেষ্ঠা ছিল। কেউ কেউ শতভাগ না হলেও কিঞ্চিৎ উপকৃত হয়েছে। বিগত হওয়া বছরটা থেকে প্রকৃত প্রাপ্তি বলতে এটাই। 

২.
বলা যায়, বছর ধরে রুটিনে বাঁধা একই কাজ করেছি। খানিক বিলম্বে ঘুম থেকে ওঠা। অফিসে যাওয়ার মত করে হলেও খুব ধীরগতির প্রস্তুতিতে নিচে নেমে আসা এবং স্বচালিত গাড়ি নিয়ে লাইব্রেরির দিকে রওয়ানা হওয়া। আমার কোনো তাড়া থাকে না, কর্মহীন বেকারের সময় বলে কথা। একটা দিন গেলেই চললো। কিন্তু অনেক সময় দিনটা অস্বাভাবিক দীর্ঘ হয়ে যায়। মির্জা গালিবের মতন করে বললে, "বিকেল যায় না, অথচ বছর চলে যায়"। কোনদিন পাঠক সমাবেশ কেন্দ্র শাহবাগ, বাংলা একাডেমির সেল সেন্টারে, কখনো ঢাকা ক্লাবের বিস্তৃত লাইব্রেরির নির্জনতায়, বা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ওপরে বাতিঘরে , এশিয়াটিক সোসাইটি বা ধানমন্ডির বেঙ্গল বইঘরের উপর তলায় যেদিন যেদিকে মন টানে। 'কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা'। বই খুঁজি, বই পড়ি, বই কিনি। এসময়ে  আড্ডা বা আলাপ আলোচনার পরিসর খুবই সীমিত হয়ে ওঠেছে । এটা হয় কালেভদ্রে পরিচিতজনের সাক্ষাত সাপেক্ষে। লাইব্রেরিতে থাকা নতুন প্রজন্ম, ছাত্র-ছাত্রীরা আমার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করবে না। এদের সময়ের প্রতিটা মুহূর্তের মূল্য অনেক। আবার আমার বয়েসীরা মোটামুটি কোনো না কোনো কর্মেই ব্যস্ত। তাদের হাতে রয়েছেম অবসরোত্তর কর্মহীনের কর্মযজ্ঞ। সঙ্গত কারণেই আমি একা কিন্তু একসঙ্গে।

৩.
২০২৩ সালে আমি প্রায়শই দেশের সর্ব্বোচ্চ আদালত হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে গিয়েছি। সেখানে  বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত বন্ধু-স্বজনের মুখোমুখি হলেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে-- 'আরে ভাই এখানে কেন ? মামলায় জড়িয়েছেন বুঝি '? বলতাম, না, মামলা দায়ের করেছি। একটি বিশেষ সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে রীট পিটিশনে বাদী হয়েছি। এতে সিভিল ও মিলিটারি সার্ভিসের আরও অনেক সহকর্মী সংযুক্ত  আছেন। 'কেন সরকারি কর্মচারীদের অবসরের পর অতিরিক্ত তিনবছর অপেক্ষা করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে? cooling off Period নামে এমন নিষেধাজ্ঞা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই ! নেট দুনিয়ায় দৌড়াদৌড়ি করে পাওয়া গেল, কেবল পাকিস্তান নামের অদ্ভুত দেশটায় এটা বহাল আছে। আমাদের আরপিও'র বিধানটাও হাস্যকর- বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীরা সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ বাকী সব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। শুধুমাত্র জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বেলায় অযোগ্য হবেন। যা দেশের সর্বোচ্চ আইন বা law of the land সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমাদের দেশ-বরেণ্য আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীরসহ আরও কয়েকজন বিজ্ঞ সলিসিটর  অসাধারণ যৌক্তিকতায় এসব আদালতের সামনে তুলে ধরেছিলেন। এ নিয়ে একটা খোলা  কলামও লিখেছিলাম , যা একাধিক জাতীয় দৈনিক প্রকাশ করেছে। যদিও দিনের শেষে আমাদের  তেমন সুফল আসেনি।

৪. 
সারা বছরে অসংখ্য কলামধর্মী লেখা লিখে বাংলাদেশ প্রতিদিন, সমকাল, আমাদের সময়, বাংলা বিচিত্রাসহ একাধিক দৈনিকে পাঠিয়েছি। বেশির ভাগই প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকের প্রশংসা বাক্যে সাড়াও মিলেছে। বছরের শেষার্ধে এসে আসছে একুশে বইমেলায় প্রকাশিতব্য দুটো বইয়ের পান্ডুলিপি নিয়ে কাজ করেছি। একটা বিদেশ ভ্রমণ বিষয়ে আমার পাখির চোখে দেখা ও অভিজ্ঞতার খন্ড লিপিকা। নাম রেখেছি 'অচেনা আকাশ'। এটা ধার করা নাম। বড়ো বড়ো দিকপাল লেখকও নামের জন্য কবিদের নিকট হাত পেতে থাকতো। প্রকাশ করবে জার্নিম্যান বুকস। অপর বইটি আমার প্রয়াত স্ত্রী জেবুকে নিয়ে। ২০২০ সালে করোনায় অকাল প্রয়াণের পর তার ওপর রচিত আমার আবেগঘন রচনাগুলি এতে স্থান পেয়েছে। নাম দিয়েছি 'বেদনার জলছবি' বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'অন্যপ্রকাশ' এর দায়িত্ব নিয়েছে। আশা করি বইয়ের লেখাগুলি পাঠককে টেনে নিতে পারবে। কেউ কেউ অশ্রুসজল হলেও অবাক হব না।

৫. 
২০২৩ সালে বেশ কিছু সেমিনার সিম্পোজিয়াম ও বইয়ের প্রকাশনার আয়োজনে আমন্ত্রিত হয়ে দর্শক সারিতে উপস্থিত থেকেছি। বিশেষ করে এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমির অডিটোরিয়ামে, জাতীয় যাদুঘর মিলনায়তনে, শিল্প-কলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে, বেঙ্গল বইঘরে ইত্যাদি স্থানে। কথা শুনেছি, দেশের বয়োবৃদ্ধ অসংখ্য শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও গুণীজনের। এদের কিছু নাম নেয়া যায়, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. হারুন অর রশীদ, বাংলা পিডিয়ার অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, ড.ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, হাসনাত আবদুল হাই, আসফ-উদ-দৌলাহ, অধ্যাপক মাহফুজা খানম, ইমেরিটাস অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রমুখ। এঁরা বেঁচে থাকা কীর্তিমান মানুষ।   বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, লেখক ও সাবেক সচিব হাসনাত আবদুল হাই এর সঙ্গে একদিনের বিকাল থেকে রাত অবধি নিরন্তর গল্পকথায় কাটিয়েছি। এককালের একান্ত সচিব হিসেবে যা তখন পারি নি। সেদিন অকপটে সবই পেরেছিলাম। লেখালেখি, উভয়ের ব্যক্তিজীবন, বিপত্নীক সময়ের সাতকাহন, দীর্ঘ জীবনের রহস্যময় রসিকতা কিছু বাদ যায় নি। বছরব্যাপী বিপ্লবী কবি মোহন রায়হানের পক্ষ থেকে বাণী চিরন্তনীতে উৎকীর্ণ করা সুপ্রভাত পেয়েছি। তবে স্মরণীয় হল, শেষ দিনের দুপুরটা। ৩১ ডিসেম্বর '২৩ তারিখ। বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন এর সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ সৌজন্যের সাক্ষাৎ প্রাপ্তি। 

৬.
সারা বছরই সন্তানদের সান্নিধ্যে ছিলাম। টেবিলে খাবার প্রস্তুত করে বাবার জন্য অপেক্ষায় থেকেছে তারা । কখনো সম্মতি পেয়ে আগে খেয়ে নিয়েছে। বাসায় ফিরে  নাতনি এবং নাতিকে একই সঙ্গে আলিঙ্গন করে কোলে তুলে নিয়েছি। আমার এমন আনন্দাস্রু বা আবেগ আপ্লুত হওয়ার ভাষা সবসময় অব্যক্ত থেকে গেছে। সাড়ে ছ'মাসের ছোট নাতিটাও বুঝতে পারে আমি তার নিকটতম কেউ, রক্ত দিয়ে বাঁধা এক পরমাত্মীয়। আমার চোখে তার চোখ পড়তেই কী অপরূপ নিস্পাপ দেবতুল্য হাসিতে সে বারবার  বুঝিয়ে দেয়, 'শোন, মনে রেখো, আমি যে তোমার আসল বন্ধু হে' ! কখনো কখনো ওরা একে অপরকে সাংঘাতিকভাবে ঈর্ষাও করে, কে আগে আমার কোলে উঠবে। অথচ এই আমি এদের দু'জনকে একসঙ্গে উঠাবার শক্তি এবং বয়স প্রতিদিনই একটু একটু করে হারাচ্ছি।

শুভ নববর্ষ ২০২৪ খ্রি.
লেখক, গল্পকার, কলামিস্ট। 


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭