ওয়ার্ল্ড ইনসাইড

নির্বাচন তো শেষ, এবার কি করবে যুক্তরাষ্ট্র?


প্রকাশ: 08/01/2024


Thumbnail

গতকাল (৭ জানুয়ারি) হয়ে গেল বহুল প্রতীক্ষিত বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর এই নির্বাচনের প্রায় সাত মাস আগে, গত বছর মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু একটি নির্বাচন করার জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করে। সেই তখন থেকেই মার্কিনিদের অজানা সেই ভিসা নিষেধাজ্ঞার খড়গের চাপে এদেশের মানুষের মনে বিরাজ করেছে চাপা এক উত্তেজনা। আর সেটি এই নির্বাচনকে ঘিরেই। সময়ে সময়ে যা আরও ঘনীভূত হয়েছে। অবশেষে, গতকাল সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংঘটিত হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের মানুষের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, এবার কি করবে যুক্তরাষ্ট্র? অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার দোহাই দিয়ে কি নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসবে বাংলাদেশকে? নাকি তাদের মতবাদে আসবে পরিবর্তন, গতকালের সফল এবং আশাব্যঞ্জক নির্বাচনটিকে দেখার পর। ইতোমধ্যেই অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষক দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। যাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকও রয়েছেন। তবে কি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ চাপাবে না? কিন্তু কেন?


যে সকল দেশের ওপর আরোপিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার খড়গ এবং কেন-

নাইজেরিয়া:

গত বছরই বিভিন্ন দেশে নির্বাচন 'অবাধ এবং নিরপেক্ষ' না হবার অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যাদের মধ্যে নাইজেরিয়া অন্যতম। এ বছরের মার্চে সংঘটিত নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তোলা হয় দেশটিতে। নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হয়নি এ অভিযোগের সাথে সাথে ফলাফল প্রকাশের আগেই বিরোধী সব দল এই নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তোলে। ক্ষমতাসীন দল ছাড়া ভোটগ্রহণে স্বচ্ছতার অভাব নিয়েও অভিযোগ করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এর পরপরই সেখানে ভোটারদের ভয় দেখানো, ভোটের ফলাফল কারচুপি ও গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয় আমেরিকা।

নাইজেরিয়ার ২০১৯ সালের নির্বাচনের পরও ঠিক একইভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার অভিযোগে জড়িতদের বিরুদ্ধে দুই দফায় কতিপয় ব্যক্তির উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আমেরিকা। যদিও যাদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। ফলে তাদের পরিচয় কেউ জানে না। গোপনীয়তার অধিকারের জন্য আমেরিকা সেসব নাম প্রকাশ করেনি।

ধারণা করা হয়েছিল ২০১৯ সালে ভিসা নিষেধাজ্ঞার পর আর এসব হবে না। কিন্তু বাংলাদেশে ভিসা নীতি ঘোষণার ঠিক নয় দিন আগে একই ধারা ব্যবহার করে নাইজেরিয়াতেও ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। যদিও কিছু ব্যক্তির উপর যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিলেও নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির তেমন কোন পরিবর্তনই হয়নি।

কম্বোডিয়া:

নাইজেরিয়ার মত কম্বোডিয়াতেও যুক্তরাষ্ট্র চালিয়ে আসছে নিষেধাজ্ঞার খড়গ। কারণও মোটামুটি একইরকম। ক্ষমতাসীন কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টির (সিপিপি) নেতা হুন সেন, সেই ১৯৮৫ সাল থেকে কম্বোডিয়া শাসন করছেন। বিগত ৩৮ বছর ধরে ৭০ বছর বয়সী এই হুন সেন কম্বোডিয়ার ক্ষমতায় আছেন। গত বছরের ২৩ জুলাই কম্বোডিয়ার সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টিসহ (সিপিপি) সব মিলিয়ে ১৮টি দল অংশ নেয়। কিন্তু কম্বোডিয়ার প্রধান বিরোধী দল ‘ক্যান্ডেল লাইট পার্টি’ নির্বাচনে অনুপস্থিত থাকায় বেশ সহজেই প্রতিবারের মত এবারও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন হুন সেন। সেই সাথে এবারের কম্বোডিয়ার জুলাইয়ের নির্বাচনে হেভিওয়েট বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করার কারণে তার অধীনে সংঘটিত নির্বাচন নিয়ে বিশ্বজুড়ে হয় নানা বিতর্ক।

সর্বশেষ কম্বোডিয়ার ঐ নির্বাচনকে ‘মুক্ত বা নিরপেক্ষ, কোনোটাই নয়’ হিসেবে চিহ্নিত করে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন। দেশটিতে নিষেধাজ্ঞার খড়গ বসিয়ে দেয়। কম্বোডিয়ার বেশ কিছু ব্যক্তিসহ অনেকের ওপরই ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটি। সেই সঙ্গে বিদেশি কিছু সহায়তা কর্মসূচিও স্থগিত করে তারা।

শুধু ২০২৩-এ নয় কম্বোডিয়ার ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়ও ‘গনতন্ত্রের অবমূল্যায়নে জড়িত থাকা’ এবং ‘কম্বোডিয়া  সরকারের গণতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপের সরাসরি প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেবার ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা এসেছিল সে সময়কার একমাত্র কার্যকর বিরোধী দল সিএনআরপিকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে।

সেবারই প্রথমবারের মত কম্বোডিয়ার দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ওপর এবং বিভিন্ন বাণিজ্য সহায়তার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র।

এ ছাড়া ২০১৯ সালেও চীনের সহায়তায় কম্বোডিয়ার একটি নৌবাহিনীর ঘাঁটি তৈরির খবর প্রকাশিত হলে আবারও নিষেধাজ্ঞা আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।

এরপর ২০২১ সালের দিকেও কম্বোডিয়ায় কাজ করা চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র – যেই প্রতিষ্ঠানটি থাইল্যান্ডের উপসাগরের কাছে দারা সাকোর অঞ্চলে চীনা বিমান বাহিনীর ব্যবহারের জন্য এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করছিল। আর সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা দেয় ২০২৩ সালে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

সোমালিয়া:

জঙ্গিবাদ, খরা, দারিদ্র্য - এমন নানা সমস্যায় আক্রান্ত আফ্রিকার আরেক দেশ সোমালিয়া। সোমালিয়ার রাজনৈতিক সংকটের জায়গা হল তারা কখনোই সময়মত নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে না। রাজনৈতিক বিরোধ, অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এমন নানা কারণে নির্বাচন বারবার পিছিয়ে যায়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচন হওয়ার কথা তার এক বছর পার হয়ে যায়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ার জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করে আমেরিকা। এর উদ্দেশ্য ছিল সোমালিয়ায় যেন দ্রুত এবং সঠিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

নির্বাচন পিছিয়ে দিলে নির্বাচনে বাধা সৃষ্টির দায়ে বেশ কিছু সোমালি কর্মকর্তা ও ব্যক্তিবর্গের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয় আমেরিকা। তবে যুক্তরাষ্ট্র যাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, প্রাইভেসি ইস্যুতে কারো নাম প্রকাশ করেনি তারা।


অন্যান্য দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এ সমস্ত ধারাবাহিক নিষেধাজ্ঞার বহর আগে বাংলাদেশের জন্য কিঞ্চিৎ আতঙ্কের হলেও, বর্তমানে এ বিষয়ে দুশ্চিন্তার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, গতকালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে গতকাল অনুষ্ঠিত হয়েছে এই নির্বাচনটি। গতকাল সারাদিনই স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ চলে। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সারাদেশেই সুষ্ঠুভাবে ভোট সম্পন্ন হয়। ইতোমধ্যেই এ নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করবে আন্তর্জাতিক মহলে।

একদিকে যেখানে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ,  কম্বোডিয়ায় মুক্ত এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের অভাব বলা হচ্ছে সেখানে আরেকদিকে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের পর্যবেক্ষকরা। গতকাল সকাল থেকেই তারা নির্বাচনের বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। নির্বাচনে আসা ভোটারদের উপস্থিতি ও ভোটের পরিবেশ নিয়ে ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াও জানান তারা। অন্যান্য দেশের প্রশ্নবিদ্ধ বিতর্কিত নির্বাচনে যেখানে লোকসমাগম-ই দেখা যায়নি, ভোট পড়েছিল গুটিকয়েক শতাংশ সেখানে গতকাল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাত আটটি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা এতো ভোটারের উপস্থিতি দেখে অভিভূত হন। তারা ভোট কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তারা খুবই সন্তুষ্ট এবং ভীষণ আশাবাদীও ছিলেন। রাজধানীর বাইরে চল্লিশ থেকে ৭০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি দেখে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন তারা। বাংলাদেশের নির্বাচনের এই পরিবেশ আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরবেন বলেও জানান যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ডের পর্যবেক্ষক দল। এ ছাড়াও বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ওআইসি, রাশিয়া, ফিলিস্তিন ও গাম্বিয়ার পর্যবেক্ষকরা।

এখন পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মতামত অনুকূলেই রয়েছে। কিন্তু কখনো সেটি প্রতিকূল অবস্থায় রূপ নিতে পারে বলেও মতামত অনেকের। কারণ নির্বাচনের কিছু দিন আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারকে নির্বাচনের আগেই নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র এসব খবর আগাম প্রচার করে না। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না, এটিই সুখবর।



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭