ইনসাইড থট

নেতার বাড়িতে অনেক মানুষ!


প্রকাশ: 11/01/2024


Thumbnail

আমাদের দেশের রাজনীতির নেতৃত্বে যারা থাকেন তাঁদের প্রতি জন-মানুষের ভালবাসার পরিমাপ করা কঠিন। পাঁচ বছর পর পর একটা সুযোগ আসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যখন এই ভালবাসায় খেদ ধরা পড়ে বা নেতার বিচ্যুতির একটা বিচার হয়। তাছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যখন সুযোগ আসে মানুষ নেতার পক্ষে-বিপক্ষে ভোট দিয়ে বিচার করে। কিন্তু নির্বাচন বা পরিমাপের সাংবিধানিক সুযোগ ছাড়া নেতার বিচারের আর কোন সুযোগ জনগণের হাতে থাকে না। থাকে, নেতা যেই দল করেন সেই দলের উপর। কিন্তু বেশিরভাগ নেতার বিচ্যুতির বিচার তার দল করে না, তখন মানুষ কষ্ট পায়।

বাংলাদেশের আমোদপ্রিয় মানুষ তার নেতাকে প্রবল ভালোবাসে ও উজাড় করে সেই ভালোবাসা সমর্পণ করে। নেতার জন্যে ভালোবাসা প্রকাশ করতে সে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করতে একবিন্দু কার্পণ্য করে না। সেই ভালোবাসা প্রকাশে মানুষ আশ্রুসিক্ত হয়, বাধভাঙ্গা জোয়ারের মত প্লাবিত চোখের পানি সে মুছে একান্ত গোপনে। পিতামাতা ও সমাজের কাছে শুনে ও জেনে শিশুরা তাঁদের জমানো পয়সা দিয়ে নেতার জন্যে চকোলেট কিনে বাবা-মায়ের হাত ধরে নেতার বাড়ি এসে ভীড় করে। নেতাকে দূর থেকে এক নজর দেখতে হাজার হাজার মানুষের ভীড় হয় সে বাড়িতে। কূলবঁধু সারারাত জেগে নেতার জন্যে শীতের পিঠা বানিয়ে নিজে সাথে করে নিয়ে আসে। সাথে আসে অসুস্থ শ্বাশুড়িও, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, নদী পেরিয়ে নেতার বাড়ি এসে দূর থেকে ঝাপসা চোখে নেতাকে দেখে বাড়ি ফিরে যায়। কারোরই মন চায়না ফিরে যেতে।

এমনই এক সম্মোহনী নেতার বিকাশ ঘটেছে ফরিদপুরের চরাঞ্চলে। নাম নিক্সন চৌধুরী। তেপান্তরের মাঠে তার দেখা মিলে, গ্রামের চায়ের দোকানে বা দরিদ্র কৃষকের ঘরে বা কোন কুমারীর বিয়ের ঘটকালী আলোচনায় বা দরিদ্র বাবা-মায়ের কণ্যা সমর্পণের অনুষ্ঠানে। কোথায় নেই সে! আন্দোলনে-সংগ্রামে, বিপদে-আপদে, অসুখে-বিসুখে মানুষের পাশে যে থাকে সেই-ই নাকি প্রকৃত নেতা। নিক্সন চৌধুরী মনে করেন ‘দল, রাজনীতি আমার জনগণের উর্ধে কিছু নয়, জনগণের সেবা করি বলেই আমি রাজনীতির কর্মী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এইটা যে আমি মানুষের কথা ভাবছি কীনা, মানুষের পাশে আছি কীনা’।

নিক্সন চৌধুরী বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ, একটু ক্ষ্যাপা চরিত্রের। তার অনুসারী দেখা গেল যতো না তরুণ তার চাইতে অনেক গুণ বেশি বয়সী মানুষ। কারণ কি? তরুণ বাইকার নেতার পেছনে তো তরুণ ছেলেপিলেরাই দৌড়াবে কিন্তু নিক্সনের বেলায় দেখা যায় উল্টো। বুড়ো মানুষেরাই তার ভক্ত বেশি। রাস্তায় পেলে বলে, “ও নিক্সন, কই যাও”, উত্তর আসে “এই তো কাকা, কালিখোলা বাজার থুনে ফিরতাছি”! শিশুরা চিৎকার করে ডাকে, “ও দোস্ত”! বঁধুরা আড়াল থেকে হাসে, ‘রাজপুত্তুরের মতো দেখতে, দেখো বালু-টালু মানেনা, কই জানি যায়”!

নেতা কি এমন হয়? নেতা তো এমন হবার কথা নয়! ধোপ-ধুরস্ত, নূরানী চেহারা, গম্ভীর ও চিন্তামগ্ন – এই না হলে তো নেতা নয়! কর্মীরা বলবে, আমার নেতা সালাম দিলে সালাম নেয় না, আর এক ক্ষুব্ধ কর্মী বলবে, সালাম দিবি না! কিন্তু যে-ই নেতা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াবে, সব কর্মী এক কাতারে! সালাম নিক বা না নিক, উত্তর দিক বা না দিক, নেতা আমার নেতাই। কিন্তু নিক্সনের এসবের বালাই নেই! সে-ও নেতা কিন্তু মানুষের সাথে অনর্গল কথা বলে, সালাম নেয় ও দেয়, কুশল বিনিময় করে, “ও চাচী, কী রান্না? দেখি খাইতি দেন, ক্ষিধা লাগছে”! এসব কোন নেতাকে মানায়?

নিক্সন নির্বাচনে জিতেছে তৃতীয়বার। কোন দল নাই, স্বতন্ত্র! শুধু আদর্শ ‘বঙ্গবন্ধু’ আর ‘শেখ হাসিনা’। কিন্তু তার বাড়িতে মানুষের ঢল নেমেছে। নেতার জ্বর ১০৪! কিন্তু কীসের কি! নেতা চোখ মুছে, সে তার মানুষের কাছে যেতে পারছে না, হাত মেলাতে পারছে না। চাদর মুড়ি দিয়ে কুয়াশার সকালে দোতলার বারান্দায় নেতা এসে দাঁড়িয়েছে আর শত-সহস্র মানুষ সেই কাকডাকা ভোরে শীত আর কুয়াশা তুচ্ছে করে নেতার বাড়িতে, সব ফটক খোলা। হাতের ফুল, পিঠা, শিশুর ভালোবাসার সেই চকোলেট সব দোতলায় ছুড়ে না মারলে নেতা পাবে কী করে! “ও নিক্সন, তুমি ঘরে যাও, জ্বর বাড়বে, আমরা আছি এই জায়গায়, সমস্যা নাই, ঘুরে ফিরে বেড়াই, তুমি বিশ্রাম নাও”।

ইউটিউবে হাজার কোলাহলে নানারকম শব্দ ভেসে আসে। নিক্সন চৌধুরী বারান্দায়, ভাবলেশহীন অসহায় চোখে দূরের দিগন্ত দেখে, কিছু একটা খুঁজে ফিরে, মনে হয়- না জানি ঝাঁপ দিয়ে মানুষের বুকে আছড়ে পড়ে! তার চোখের সীমানা জুড়ে শুধু ভালবাসার ভীড়, দূরের চরে শুধু মানুষ আর মানুষ! নিক্সন হয়তো ভাবে, আমি এদের রেখে এই দুনিয়া ছেড়ে কই যাবো? হয়তো নিজের কাছে তার প্রশ্ন, নেতার কাছে মানুষ কী চায়? হয়তো নিজেই উত্তর দেয়, ভালোবাসা!

রেজা সেলিম, পরিচালক, আমাদের গ্রাম প্রকল্প 
ই-মেইলঃ rezasalimag@gmail.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭