ইনসাইড পলিটিক্স

বড় নেতারা কি কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর পেলেন?


প্রকাশ: 12/01/2024


Thumbnail

আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় এবার একটি রাজনৈতিক আবহ দৃশ্যমান হয়েছে। বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতা এবার মন্ত্রিসভা অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন। গত বারের মন্ত্রিসভায় ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এবার তিনি একই পদে বহাল রয়েছেন। এছাড়াও গত বারের মন্ত্রিসভায় ড. হাছান মাহমুদের পদোন্নতি হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় তাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ আলী আরাফাত তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। যেহেতু এই মন্ত্রণালয়ের কোন পূর্ণমন্ত্রী নেই, কাজেই মোহাম্মদ আলী আরাফাত-ই এই মন্ত্রণালয়ে আপাতত চালাবেন এটা সুস্পষ্ট। কিন্তু বাকি যে সমস্ত কেন্দ্রীয় নেতারা আছেন, তারা ভালো মন্ত্রণালয় পাননি—এমন আলোচনা আওয়ামী লীগের মধ্যে রয়েছে। এই নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছু হতাশাও আছে। 

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খানকে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নয়। বিশেষ করে এখন যখন তৃতীয় টার্মিনালের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে এবং বিমানকে একটি বিশ্বে মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা সরকার করছে তখন ফারুক খানকে এখানে যথেষ্ট অবদান রাখতে হবে। তবে তিনজন মন্ত্রীর মন্ত্রণালয় নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে। এদের মধ্যে জাহাঙ্গীর কবির নানককে দেওয়া হয়েছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। জাহাঙ্গীর কবির নানকের মতো পোড়খাওয়া ত্যাগী রাজনীতিবিদ কেমন করে পাট এবং বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মত কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পেলেন—এ নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে নানা রকম আলাপ আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ হতাশাও প্রকাশ করছেন। 

একই অবস্থা আওয়ামী লীগের আরেক জনপ্রিয় এবং হেভিওয়েট নেতা আব্দুর রহমানের বেলাতেও। তাকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ দেওয়া হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও সাধারণ বিচারে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় না, বরং এটিকে অনেকে দ্বিতীয় গ্রেডের মন্ত্রণালয় মনে করে। একইভাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ডা. দীপু মনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সমাজকল্যাণে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা হচ্ছে। 

প্রশ্ন উঠেছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশল কী? বড় নেতাদের তিনি কী ইচ্ছে করে কম গুরুত্ব মন্ত্রণালয় দিচ্ছেন নাকি তার পিছনে অন্য কোন রাজনৈতিক দর্শন রয়েছে? 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন যে, এটির পিছনে সুস্পষ্ট দর্শন রয়েছে। যে তিনটি মন্ত্রণালয় আওয়ামী লীগের তিনজন হেভিওয়েট নেতাকে দেওয়া হয়েছে। তিনটি মন্ত্রণালয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আত্মনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার জন্য এই মন্ত্রণালয়গুলোতে অনেক কিছু করার আছে। এটি পঁচাত্তরের পরবর্তী সংস্কৃতি যে বস্তু ও পাট মন্ত্রণালয় কিংবা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে কম গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। অনির্বাচিত অবৈধ সরকাররা এই মন্ত্রণালয়গুলোকে গুরুত্বহীন করে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে এই মন্ত্রণালয় গুলোকে ক্রমশ পাদপ্রদীপে এবং গুরুত্বপূর্ণ করার জন্য বিভিন্নরকম উদ্যোগ নিচ্ছেন। তিন হেভিওয়েট নেতাকে এই তিন মন্ত্রণালয় দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার অর্থনৈতিক দর্শনের একটি সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটল বলেই মনে করছেন কেউ কেউ। 

বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বাংলাদেশ পূনর্গঠনের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন সেখানে তিনি পাট এবং বস্ত্র অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, আমার পাট আছে। বাংলাদেশে পাট ছিল সোনালী আঁশ। একসময় পাট ছিল আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাটকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। বস্ত্র খাতে একই রকম অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। 

গত কয়েক বছর ধরে সরকার গার্মেন্টসকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বস্ত্র আনার জন্য একটি প্রক্রিয়া করছে। যদি গার্মেন্টসকে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসা হয়, সেক্ষেত্রে এই মন্ত্রণালয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয় পরিণত হবে। এই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমাদের গার্মেন্টস কেন্দ্রিক রপ্তানির বদলে পাট এবং পাটের বৈচিত্র্যময় পণ্য, উদ্ভাবন এবং বিপণনের কাজটি জাহাঙ্গীর কবির নানকের মতো দক্ষ মাঠের রাজনীতিবিদ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন বলে হয়তো প্রধানমন্ত্রী মনে করছেন। আর এই কারণেই বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মতো মন্ত্রণালয় জাহাঙ্গীর কবির নানককে দেওয়া হয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কেও অনেকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। একটা সময়ে এটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগ ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বে এখন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত খাদ্য নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভারতে এই মন্ত্রণালয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাবে বিবেচিত হয়। আব্দুর রহমানও একজন ত্যাগী রাজনীতিবিদ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে বাংলাদেশ যদি স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষ বা খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে বাংলাদেশ থাকবে না। সামনের দিনগুলোতে যখন খাদ্য সংকটের নানা রকম আওয়াজ শোনা যাচ্ছে তখন আব্দুর রহমানকে এই মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার দীঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি এই খাতকে আরও এগিয়ে নেবেন। এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে একটি নীরব বিপ্লব ঘটেছে। বিশেষ স্বাদু পানির মাছ আহরণে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করা, কোরবানিতে ভারত নির্ভরতা বাদ দিয়ে নিজস্ব প্রাণি দিয়ে কোরবানির ব্যবস্থা করার মতো সাফল্যগুলো হয়েছে খুবই নীরবে। এই রকম বাস্তবতায় আব্দুর রহমান এই মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে নিবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু তার রাষ্ট্র বিনির্মাণের চিন্তায় লাইভস্টক খাতের কথা তার বৃক্ততায় উল্লেখ্য করেছিলেন। সেদিক থেকে আব্দুর রহমানের মতো হেভিওয়েট নেতার এই মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়াটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

ডা. দীপু মনিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া বিষয়টি নিয়েও নানা রকম আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়টি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। বর্তমানে এই মন্ত্রণালয়ের আওতায় অনেকগুলো সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনীর কার্যক্রম হয়ে আসছে। এই মন্ত্রণালয়ের করা অনেক কিছুই আছে। কিন্তু একটি মনস্তাত্বিক কারণে এই মন্ত্রণালয়কে সকলে ডাম্পিং মন্ত্রণালয় মনে করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই মন্ত্রণালয়ের অনেক কিছু করার আছে। দীপু মনি একজন সৃজনশীল এবং সৃষ্টিশীল মেধাবী রাজনীতিবিদ। তিনি এই মন্ত্রণালয়কে নতুন রূপ দিবেন এবং তাহলেই সরকারের যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সহ সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের একটা পূর্ণতা পাবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭