লিট ইনসাইড

গ্রাম ও জীবনের কথা 


প্রকাশ: 15/01/2024


Thumbnail

ক'দিন হল গ্রামের বাড়িতে আছি। এবার প্রচন্ড শীত ও শৈত্য প্রবাহ যেন জেঁকে বসেছে। সূর্যের আলোর দেখা নেই সপ্তাহের অধিককাল যাবৎ। শেষবার ঢাকা থেকে সূর্যালোকের স্পর্শে স্নাত হয়ে এসেছি অন্তত চার-পাঁচ দিন আগে।

সকালের আকাশটা খুব বেশি কুয়াশাচ্ছন্ন না হলেও রোদের কোনো অস্তিত্ব নেই। এ এলাকায় তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেঃ বা কাছাকাছি নেমে এসেছে।  কিশোরগঞ্জের মত ভাটি বাংলায় বিগত ১৫-২০ বছরে এমন তীব্র শীতার্ত আবহাওয়া অনুভূত হয়নি বলে সাধারণ মানুষের মন্তব্য। শুনেছি গতকাল এ জেলার নিকলি উপজেলায় নাকি সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে। সবাই জানি, শীত মানে উত্তরবঙ্গ, চুয়াডাঙ্গা, পঞ্চগড় ইত্যাদি স্থানের জনজীবনের করুণ চিত্র। নিদেনপক্ষে, মৌলবী বাজারের শ্রী মঙ্গল এমন রেকর্ডের আওতায় থাকবেই। 

তবে একটা খুশির বিষয় নজরে পড়েছে। আমাদের শৈশব-কৈশোরের হাড়কাঁপানো তীব্র শীতে জুবুথুবু মানুষ সকাল-সন্ধ্যায় একটু উত্তাপ ও উষ্ণতার জন্য খড়কুটোর আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে পড়তো। দুটো হাত বাড়িয়ে দিত আগুনের রক্তিম শিখার দিকে। গ্রামে এখন আর এমন দৃশ্য নেই বললেই চলে। এখন বেশির ভাগ মানুষই প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র পরিধান করে আছে। মনে হয়, বস্ত্রহীন মানুষের সংখ্যা খুবই নগণ্য হয়ে এসেছে। বরং মনে হয়, দেশের  সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অন্তত দিনে একবার চায়ের পেয়ালায় ঠোঁট আর টেলিভিশনে চোখ রেখে সময় কাটাচ্ছে। নির্বাচন, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে কথা বলে চা'র দোকানে ঝড় তুলছে। 

২.
এবার বাড়ি এসে পূর্ব-পুরুষের কৃষিজ জমাজমিতে চাষাবাদ  দেখভাল করছি। অগ্রহায়ণের নবান্নের পরে পৌষের শেষ দিকে  গ্রামীণ কৃষকরা বোর ধানের বীজতলা থেকে চারা তুলে রোপণ কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ভোর বেলার প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে তারা কাদা জলে নেমে পড়ছে। শ্রমজীবী দিনমজুর শ্রেণির মানুষের এটা দিনে একবার করতে হয়। কুয়াশার চাদর ভেদ করেই মাঠের কাজে যাচ্ছে তারা। তবে মানুষকে এখন আর সেই অতীতের মত মানবেতর কষ্ট করতে হয় না। একহাঁটু পানিতে নেমে লাঙ্গলের মুঠি হাতে হাড্ডিসার গরুর পেছনে ঠেলতে হচ্ছে না। জমির চাষ হচ্ছে যন্ত্র চালিত ট্রাকটার দিয়ে। কিন্তু চাষের পরে ক্ষেতের মাটি সমান করার জন্য মই ব্যবহার করা যেনো একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছ। দেখা যায়, মানুষগুলোই মইয়ের সঙ্গে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আর গোরুগুলো দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। কেননা গোরু অনেক আগেই ভুলে গেছে এর কাঁধে জোঁয়াল তোলার কথা। বরং তারা এখন মহা সুখে মশারি ও বৈদ্যুতিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে রাত-দিন যাপন করছে। অথচ এদেশে একদিন গোরুর কাজের কোনো শেষ ছিল না। কুলুর বলদের কথা কে না জানে। চোখে ওপর ঠুলি বেঁধে স্পষ্ট একটা  দিবালোককে অন্ধকার করে দিয়ে বলদকে ঘোরাচ্ছে সরিষার ঘানিতে। একফোঁটা তেল আর একফোঁটা ঘাম একাকার হয়েছে, এসব মনে হয়,সেদিনের কথা। গোরুর গাড়ির বিচিত্র ব্যবহারের দৃশ্য আমাদের অতীত সংস্কৃতির কোথায় নেই? বরকনের যাতায়াত থেকে শুরু করে ধান পাট মাড়াই সর্বত্র গোরুর গাড়ির অস্তিত্ব ছিল। সারাদিন হালচাষ করে আবার রাতের উঠানে ধান মাড়ানোর হাজার চক্কর সবই ছিল গোরুর ওপর নির্ভরশীল।

৩.
এখন মানুষই কৌতুক করে বলে, গোরুদের অভিশাপ থেকেই নাকি মানুষের এই দশা হয়েছে। গ্রামের জমিতে তারাই গোরু হয়ে মই টানছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, ভারতবর্ষে শত শত বছর ধরে গোরুর ওপর যে অমানবিক অত্যাচার, শারীরিক মানসিক নির্যাতন হয়েছে এখন তার উল্টো  ফল ভোগ করছে মানুষ। দেশব্যাপী গোরুগণ এখন মূলত দুগ্ধ খামারের আয়েসি বাসিন্দা। তাদের খাদ্য তালিকায় থাকছে নানাবিধ বিশেষ গুণসম্পন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত আইটেম। এদেরও বিশেষ ধরনের শীতবস্ত্র রয়েছে। এমনকি তাদের জন্য পূর্ণকালীন চিকিৎসকও নিয়োজিত থাকেন। এদের কেউ কেউ আবার  মোটাতাজা করণ প্রকল্পের সম্মানিত সদস্য হয়ে জাবর কাটছে। তারাও খাবারের ব্যাপারে বেশ সচেতন,যাচ্ছেতাই হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখান এবং অভিমান করে উপোস থাকার অভিনয় করে। তবে এদের বেশির ভাগই বড়ো বড়ো সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের জন্য নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে। সর্বোপরি বছরান্তে আমাদের  পবিত্র কোরবানির জন্য এরা অপেক্ষমান বিশেষ সি আই পি মেহমান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এটা সাধারণ কোনো বিষয় নয় বরং ভাববার আছে অনেক কিছু। যে প্রাণীটি কথা বলতে পারে না, বোবা অবলা বলেই এরা যুগ যুগ ধরে গণ্য হয়ে আসছে। তাদেরও দিন পরিবর্তন হলো, অপার সুদিন ফিরে পেল। এর জন্য এদের জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন করতে হয়নি। দাবিদাওয়া নিয়ে নালিশ করতে হয়নি। তাহলে একটা বিষয় সুস্পষ্ট হল যে, দিনবদলের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করার দরকার নেই। সময়-ই এর মুখ্য নিয়ন্তা এবং নিয়তি। গোরুদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের মানুষও এমন কৌশল আমল করতে পারেন। 

৪.
গ্রামে সত্যিই অসূর্যম্পশ্যা রমণীর মত ঘরে বা উঠানের কাছাকাছি বসে সময় কাটাচ্ছি। অনেক দিন পরে শীত কত প্রকার ও কেমন তা-ও দারুণভাবে উপলব্ধি করছি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন উত্তর গ্রামীণ জনজীবনকে দেখার চমৎকার একটা সুযোগও পাচ্ছি। গণমানুষের নির্বাচন ভাবনা, তাদের সরল মূল্যায়ন, প্রার্থীদের যোগ্যতা, অযোগ্যতা নিয়ে নির্মোহ মন্তব্য সবই শুনছি। মনে হচ্ছে রাজনীতির পাঠশালার ছাত্র হওয়ার জন্য কারো বয়সের প্রয়োজন নেই। সবাই যেনো সমাজ ও রাজনীতি সচেতনতার পাঠে মনোযোগী সতীর্থ। 

আজকাল গ্রামেও রাস্তা দিয়ে নানা ধরনের পণ্যের বিজ্ঞাপনের মাইকিং চলে। ত্রিচক্র যানের ওপর বসে সুসংবাদ ও দুঃসংবাদের বাহকগণ গলা ফুলিয়ে জনগণকে অবহিত করে চলেছে। গতকাল বিকালে হঠাৎ আমার কানে এল একটা অসাধারণ বিজ্ঞাপনের ভাষা। শৈশবে রেডিওতে শোনা ভরাট কন্ঠের সেই বিজ্ঞাপনের শ্রুতিমধুর ভাষার মতন। মোবাইলের সিম (sim) বিক্রি করা হচ্ছে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে। অলিগলিতে প্রবেশ করে। 'সিম লাগবে সিম, মাত্র ত্রিশ টাকায় গ্রামীণ ফোনের সিম পাবেন, আসুন এখুনি চলে আসুন ইত্যাদি'। সকৌতুহলে আমিও বের হয়ে যাই। জিজ্ঞেস করি, মাত্র ৩০ টাকায় সিম! কখন চালু হবে? 
তারা বললো, সঙ্গে সঙ্গেই চালু হবে, এই নিন। 

আমি বিস্মিত হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি। তাৎক্ষণিক   ভাবছিলাম, আমার প্রথম সিম কেনার স্মৃতির কথা। ২০০০ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামের দু'তলা থেকে ৬০০০ টাকায় গ্রামীণের সিম। সেটের চেয়ে সিমের দাম ছিল ১০০০ টাকা বেশি। ২০১০ সালে এসে আমাদের একজন সিনিয়র সহকর্মী প্রকাশ্যে এক সভায়  বলেছিলেন, 'দ্যাখো, এমন একদিন আসবে গ্রামে-গন্জে শাকসবজির মত মোবাইলের সিম বিক্রি হবে।  এমনকি বিনামূল্যেও দেয়া হতে পারে'। আমি তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কথা মনে করছিলাম। এবং  বিনামূল্যে সিম বিতরণের সময়টার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। 

১৫ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রি. 

লেখক, গল্পকার ও কলামিস্ট


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭