ইনসাইড থট

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক প্রধান পদে সায়মার অভিষেক স্বাস্থ্যখাতের গৌরব, গর্বিত বাংলাদেশ


প্রকাশ: 31/01/2024


Thumbnail

সাম্প্রতি ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক প্রধান পদে সায়মার অভিষেক স্বাস্থ্যখাতের গৌরব, গর্বিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিপ্রেক্ষিতের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ বোরহান কবীর। বৈঠকের মূল প্রবন্ধের চুম্বক অংশ প্রকাশ করা হলো। 

১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে দায়িত্ব শুরু করছেন বাংলাদেশের মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ। গত বছরের ১ নভেম্বর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক প্রধান পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১১টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১০টি দেশ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। মিয়ানমারের সদস্যপদ স্থগিত থাকায় তারা ভোট দিতে পারেনি। ১০টি রাষ্ট্রের মধ্যে আটটি রাষ্ট্রই ভোট দেয় বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী সায়মাকে। গত ২৩ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বোর্ড সভায় সায়মার নির্বাচন অনুমোদিত হয়। আগামী পাঁচ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্ব পালন করবেন সায়মা।

অনেক জ্ঞানপাপীর মনে হতেই পারে, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা জন্যই তিনি এই পদে অভিসিক্ত হয়েছেন। আমি শুরুতেই সমালোচকদের এই তিন জিজ্ঞাসার উত্তর খুব ছোট করে দিতে চাই। প্রথমত, ৫২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একজন বাংলাদেশি আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলেন। সায়মা প্রথম বাঙালি যিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতি নির্ধারক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। শুধু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নয়, জাতিসংঘের যেকোন সংস্থার নীতি নির্ধারক পদে সায়মাই প্রথম বাংলাদেশি। তাই এটি অত্যন্ত গর্বের বিষয়। 

দ্বিতীয়ত, সায়মার এই অর্জন নি:সন্দেহে তার কাজের স্বীকৃতি। তার অবদানের পুরুস্কার। কিন্তু একই সাথে এটি বাংলাদেশের অর্জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই পদে নির্বাচনের জন্য সদস্য রাষ্ট্ররা প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। এমন প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয় যিনি স্ব ক্ষেত্রে মহিমান্বিত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যার কাজের স্বীকৃতি আছে। বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে যথার্থ ভাবেই সায়মাকে মনোনয়ন দিয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে এই পদের জন্য সায়মার চেয়ে যোগ্য আর কেউ ছিলেন না। 

তৃতীয়ত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘ কাঠামো সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম জ্ঞান আছে তারা জানেন এধরনের পদে নির্বাচিত হতে  নিজের মেধা, যোগ্যতা এবং বিচক্ষণতা লাগে। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা এখানে কোন বিবেচ্য বিষয়ই নয়। গত এক যুগের বেশী সময় ধরে সায়মা ওয়াজেদ স্বাস্থ্যের নানা ক্ষেত্রে কাজ করছেন। তবে তার কাজের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হলো মানসিক স্বাস্থ্য এবং অটিজম। সায়মাই দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই স্পর্শকাতর স্বাস্থ্য ইস্যুকে সামনে এনেছিলেন। এ বিষয়ে নীতি নির্ধারকদের উপেক্ষা এবং নীরবতা ভেঙ্গেছেন। সায়মা ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল এ্যাডভোইজারী কমিটি অন নিউরো ডেভেলাপমেন্ট ডিজঅর্ডার এ্যান্ড অটিজম এর চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের মানসিক স্বাস্থ্য ও অটিজম বিষয়ে উপদেষ্টা ছিলেন। বাংলাদেশে নিউরো ডেভলপমেন্ট ডিসএ্যাবিলিটি প্রটেকশন ট্রাস্ট এ্যাক্ট ২০১৩ প্রণয়ণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি ২০২২ এবং মানসিক স্বাস্থ্য কৌশলপত্র ২০২০-২০২৫ প্রণয়নে তিনি অবদান রেখেছেন। সায়মা আপন আলোয় উদ্ভাসিত। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা হিসেবে নয়, নিজের কাজ দিয়েই তিনি এই গন্তব্য পৌঁছেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে সায়মার অভিষেক বাংলাদেশের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা এজন্য কেন গর্বিত হব। বাংলাদেশের জন্য এই অর্জন পাঁচটি কারণে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

প্রথমত, বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা: বিশ্বয়ানের এই যুগে একটি রাষ্ট্র কতটা আধুনিক, উন্নত এবং অগ্রসর তার একটি অন্যততম মাপকাঠি হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঐ দেশের নাগরিকদের অবস্থান ও উপস্থিতি। ভারত ৮০ দশক থেকে পরিকল্পিত ভাবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থায় ভারতীয়রা যেন যোগ দিতে পারে সেজন্য সুবিন্যস্ত পরিকল্পিত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। মেধাবীদের উন্নত শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রদান, জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশ্ব কর্পোরেট জায়ান্ট হিসেবে পরিচিতি বহুজাতিক কোম্পানী গুলোতে যেন ভারতীয়রা যোগ দিতে পারে সেজন্য ‘মেধা কূটনীতি’ বা ‘ব্রেইন ডিপ্লোমেসী’ চালু করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি। ভারত তার কৌশলের সুফল ভোগ করছে আজ। জাতিসংঘের প্রায় সব সংস্থার উচ্চপদে এখন ভারতীয়দের সংখ্যা সর্বাধিক। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিপির মতো প্রতিষ্ঠান গুলো কার্যত: ভারতীয় নেতৃত্বেই চলছে। এর ফলে বিশ্বাঙ্গনে ভারতে প্রভাব বেড়েছে। বিশ্বায়নের এই যুগে বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের স্বার্থ সুরক্ষা হয়েছে সহজতর। অথচ জাতির পিতা স্বাধীনতার পরই মেধাবী বাংলাদেশ বির্নিমাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানীর সঙ্গে তিনি শিক্ষা বৃত্তির চুক্তি করেছিলেন। যুক্তরাজ্যে বহু মেধাবী তরুণ চিকিৎসক এবং আইনজীবী পাঠিয়েছিলেন উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য। কিন্তু ৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর মেধায় বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ চলতে থাকে পিছনের দিকে। স্বৈরাচারী জিয়া বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করেন অদক্ষ শ্রমিকের দেশ হিসেবে। যারা শুধু কায়িক পরিশ্রমের কাজ করবে। একারণেই ৫২ বছরেও বাংলাদেশের উপস্থিতি বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণীতে নেই বললেই চলে। দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা জাতির পিতার দেখানো পথেই হাটছেন। তিনি মেধাবীদের উন্নত শিক্ষা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তারা যেন বিকশিত হতে পারেন সে চেষ্টা করছেন। এই চেষ্টার এক বড় প্রাপ্তি হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে সায়মার নির্বাচন। এর ফলে বিশ্ব বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়বে।

দ্বিতীয়ত: আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষা: সায়মার এই নির্বাচন ও দায়িত্ব গ্রহণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যের যে নীতি নির্ধারণী কৌশল এবং সিদ্ধান্ত নেবে সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চয়ই সায়মা দেখবেন। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পারে অগ্রাধিকার।

তৃতীয়ত: বাংলাদেশের অর্জনের গল্প ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বে: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় এতোদিন নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে বাংলাদেশের কেউ ছিলেন না। বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প গুলো তাই অনেকটাই ছিলো অজানা। বিএমআরসির নতুন গবেষণা, কিংবা কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্য অথবা বিশেষায়িত স্বাস্থ্য সেবার অর্জনের গল্প গুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দেয়া ছিলো কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এখন সায়মার জন্য এই সাফল্যগাঁথা সহজেই জানবে বিশ্ব। এটি আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতিতে দেবে নতুন মাত্রা এবং প্রেরণা। 

চতুর্থত: স্বাস্থ্য খাতে বাড়বে আন্তর্জাতিক সহায়তা: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্জন অনেক। কিন্তু এখনো আমাদের পথ চলার অনেক বাকী। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ চাহিদা তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বৈশ্বিক মানে নিতে হলে প্রয়োজন বিনিয়োগ। কিন্তু এই বিনিয়োগ একা সরকারের পক্ষে সম্ভব না, এজন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহায়তা। সায়মার এই দায়িত্ব গ্রহণ বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রাপ্তিতে সহায়তা করবে।

পঞ্চমত: মেধাবী তরুণরা উজ্জীবিত হবে: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতি নির্ধারণী পদে সায়মার অভিষেক বাংলাদেশের লাখো তরুণকে উদ্বুদ্ধ করবে। সায়মা তাদের জন্য হবে প্রেরণা। মেধাবীরা সাহস পাবে। সায়মার দেখানো পথে অদূর ভবিষ্যতে বহু বাংলাদেশি তরুণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলো ছড়াবে বলেই আমার বিশ্বাস।


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭