ইনসাইড থট

পুঁজিবাদের দখলে বাংলা ভাষা


প্রকাশ: 03/02/2024


Thumbnail

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার আন্দোলনের বয়স প্রায় ৭২ বছর। বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। বাংলা এখন আমাদের রাষ্ট্রভাষা। আমরা বাংলায় কথা বলি, চিঠি লিখি, লেখাপড়া করি। কিন্তু এতগুলো বছর পর আজও বাংলা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রের ভাষা হতে পারেনি।

প্রকাশ্যে ও গোপনে বাংলা ভাষার ওপর যে নিপীড়ন চলছে তা সহজেই অনুমেয়। বাংলা ভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করাই ছিল ভাষা আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ভাষা আন্দোলনে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেলো। অথচ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সর্বস্তরে সেই ভাষার উপস্থিতি নেই। ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলেও শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য ছিল। তবে এখনকার চেয়ে বেশি ছিল না। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালতসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করা হোক। তবে, এই দৃষ্টিভঙ্গি ফলপ্রসূ হয়নি। আমাদের মাতৃভাষার ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া স্বাভাবিক ছিল। বাংলা ভাষা জ্ঞান, বিজ্ঞান ও দার্শনিক গবেষণার মূলে থাকা উচিত। আশ্চর্যের বিষয়, বর্তমান বাংলাদেশে এখন আর তেমন আন্দোলন বা সচেতনতা নেই। বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে প্রচার করা আমাদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা ভাষা প্রবর্তন করাও তার নিজস্ব জটিলতা তৈরি করেছে। এজন্য মৌলিক বাংলা বই তৈরি করা এবং বিদেশি বই অনুবাদ করা দুটোই প্রয়োজন। দুর্ভাগ্যবশত, বিগত বছরগুলিতে এই প্রচেষ্টাগুলি করা হয়নি, যার ফলে বাংলা ভাষায় উচ্চ শিক্ষা স্তরের বিষয়গুলি পড়াতে অক্ষমতা দেখা দিয়েছে। উচ্চ শিক্ষা স্তরে ব্যবহৃত বেশিরভাগ বই ইংরেজিতে লেখা। যদিও এটা সত্য যে বাংলা ভাষায় সাহিত্য, প্রবন্ধ এবং বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ের ভাণ্ডার রয়েছে। আমরা মৌলিক ও উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলায় বই তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। জাতীয় ভাষা আন্দোলনের বহু বছর পেরিয়ে গেলেও সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে বাংলা সাহিত্য তুলে ধরতে পারিনি। বিশ্বের কাছে আমি বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণতা তুলে ধরতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর।

ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি শাসনামলে বাংলা ভাষার বিকৃতি কম হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমান বিকৃতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি প্রকট। আমরা আমাদের স্থানীয় টেলিভিশন নাটকগুলোতে অদ্ভুত আঞ্চলিক উপভাষার ব্যবহার প্রত্যক্ষ করছি। সমস্ত চরিত্র এই অনন্য ভাষাগত শৈলীতে কথোপকথন করছে। তাছাড়া মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনে বাংলা ভাষার বিকৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শুধু ফেব্রুয়ারিকে ভাষার মাস হিসেবে মনোনীত করা ভুল। প্রকৃতপক্ষে, সারা বছর জুড়ে প্রতিটি মাস একটি ভাষার মাস। ফেব্রুয়ারি মাসে শুধু ভাষা শিক্ষার উপর মনোযোগ দেওয়া এবং অন্যান্য মাসে এটিকে অবহেলা করা অন্যায্য। দেশের সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন আউটলেটগুলি ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষাদিবস নিয়ে অসংখ্য আয়োজন করে থাকে। ভাষার প্রতি বিদ্বেষ থাকা ব্যক্তিদের প্রতি শত্রুতা থাকা আবশ্যিক। বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্তিকে অগ্রাধিকার দেয় না। কারণ এটি বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদে জড়িতদের জন্য কেন্দ্রবিন্দু নয়। ভাষার শত্রু হওয়া মানে মানুষের শত্রু হওয়া। পুঁজিবাদ আমাদের শত্রু, ভাষার বিকাশ ও চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং সামাজিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর কালক্রমে পুঁজিবাদ মুক্ত হয়েছে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদে বাঙালির কোনো স্থান নেই। কারণ বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সঙ্গে যারা যুক্ত তারা বাংলায় আগ্রহী না। ইংরেজি এবং পুঁজিবাদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর। যারা এ দেশের শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বা এখন আছেন, তারাই বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দেননি বা দিচ্ছেন না।


লেখক: শিমুল মুহাম্মাদ মল্লিক

শিক্ষক ও কলাম লেখক

semulmollik@gmail.com



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭