ইনসাইড বাংলাদেশ

শাড়ি বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের কিন্তু নিয়ে গেল ভারত-এ কেমন প্রহসন?


প্রকাশ: 07/02/2024


Thumbnail

টাঙ্গাইল শাড়ি- নামটাই যেখানে এ শাড়ির পরিচয় বহন করে সেই শাড়ি নাকি ভারতের! তাতশিল্পে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের এই নামকড়া জেলাটি যে ভারতের অংশ সেটি বোধকরি বাংলাদেশের এই জনপ্রিয় পণ্যটি ভারত গোপনে নিজেদের করে হাতিয়ে নেয়ার আগে আমরা কেউই জানতাম না!

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজস্ব জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বলে, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত। এটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর মিহি গঠন, বৈচিত্র্যময় রং এবং সূক্ষ্ম জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত। এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।’

উদ্ভট এবং সেই সাথে হাসি পাওয়ার মতো ঘটনা মনে হলেও আদতে এই নির্মম সত্য যে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষের মনে বিশেষ করে টাঙ্গাইলবাসীর মনে প্রতিনিয়ত কাঁটার মতো বিঁধছে সে খবর কারোরই অজানা নয়।

বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার তাতী ভাইদের আবেগ এই টাঙ্গাইল শাড়ি। এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও ইতিহাস। যে শাড়ি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন কুটির শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করে সে শাড়ির স্বত্ব একরকম হুট করেই সবার অগোচরে ভারত নিজের নামে জিআই স্বত্ব করে নিয়ে গেল এবং এবারও ঠিক আগেকার মতোই ‘রসগোল্লা’ এবং ‘নকশিকাঁথা’র জিআই স্বত্বের মতো আমরা আমাদের নিজস্ব পণ্যের অধিকারের স্বীকৃতি পাওয়া থেকে বঞ্চিত। তবে এ পরিণতিতে আমাদের নিজেদের দোষ কম নয়, বরং বেশিই! এমন করে প্রতিনিয়ত এক এক করে যে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আমাদেরই হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী সম্পদ তাতে কার কি আসে যায়!

এই যে জবাবদাহিতার অভাব, নিজেদের সম্পদ নিজেদের করে ধরে রাখার দায়বদ্ধতার অভাব, এসব দায় কাদের? কবে ঘুম ভাঙবে বাংলাদেশের প্যাটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) কর্মকর্তাদের?

নিজেদের অধিকার ও সম্পদ নিয়ে আমরা বরাবরই উদাসীন। কেউ এসে নিজেদের সম্পত্তিতে টান না দিলে যেন আমাদের টনক নড়ে না। কৃষ্টিতে, সংস্কৃতিতে এত সমৃদ্ধশালী আমাদের এই দেশটির এটিই প্রথম সম্পদ খোয়ানো নয়। নিজেদের পূর্বপুরুষদের হাতে গড়ে তোলা বহু সম্পদের স্বীকৃতি খোয়ানোর নজির আমাদের আগে থেকেই আছে। এর আগে পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমে ভারত ‘রসগোল্লা’ এবং ‘নকশিকাঁথা’র জিআই স্বত্ব নিয়ে গেছে। অথচ দুই পণ্যের জন্মও কিন্তু ছিল পূর্ব বাংলায়।

তাঁতশিল্প আমাদের অতি প্রাচীন এক ঐতিহ্য। কিন্তু এই ঐতিহ্যবাহী সম্পদ রক্ষণের দিকে আমরা কতটা যত্নশীল? সংস্কৃতির দিক দিয়ে এতটা ধনী আমাদের এই দেশের কৃষ্টি, শিল্প থেকে এক এক করে হারিয়ে যাচ্ছে বহু ঐতিহ্যবাহী সব শিল্প। কত হাজার তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে পেটের তাগিদে, কত লাখ তাঁতশ্রমিক বেকার হয়ে এই ব্যবসা ছেড়েছে সে খবর কে রাখে? কেউ রাখার প্রয়োজনও মনে করে না। অথচ, বিশ্বের কাছে নিজেদের এসব শিল্প তুলে ধরে সম্মান বয়ে আনা কতই না সহজ ছিল আমাদের জন্যে। যে কাজটা ভারত বারংবার করছে। সমালোচনা করলেও তাদের এই সক্ষমতার প্রশংসা করতে দ্বিধা নেই। 

তবে দেরীতে হলেও বাংলাদেশের মানুষের এবং সেই সাথে পেটেন্ট কর্তৃপক্ষের যে টনক নড়েছে এটিই আশার কথা। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের এহেন ঘোষণায় বাংলাদেশের মানুষ বর্তমানে ব্যাপক ক্ষুব্ধ। ভারত মন্ত্রণালয়টির করা ফেসবুক পোস্টের নিচে বাংলাদেশের হাজারো মানুষ প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। সবার মনে একটিই প্রশ্ন, টাঙ্গাইল শাড়ি কীভাবে ভারতের হয়? আদৌ ভারত কি এ দাবি করতে পারে? টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের বলে দাবি করার পেছনে যেসব যুক্তি দেয়া হচ্ছে সেসব যুক্তি অনেকে খণ্ডনও করছেন। অনেকে আবার এমন মন্তব্যও করেছেন যে, "জনপ্রিয় নায়িকা সুচিত্রা সেন পশ্চিমবঙ্গের জন্য জনপ্রিয় সব সিনেমা কাজ উপহার দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় এই গুণী অভিনেত্রীকে কে না চেনেন-জানেন। কিন্তু তাই বলে কি তার জন্মস্থান বাংলাদেশের পাবনা জেলায় এ কথাটি বদলে যাবে? এও কি সম্ভব?"

টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গেই এর নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা ভৌগোলিক অবস্থান যুক্ত। মানে এটি এমন একটি শাড়ি, যার উৎপত্তিই হচ্ছে টাঙ্গাইলে। আর এই টাঙ্গাইল হচ্ছে বাংলাদেশের একটি জেলা। 

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সভাপতি চন্দ্র শেখর সাহার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্বের দাবি কোনোভাবেই ভারত করতে পারে না। কারণ, ভৌগোলিকভাবে টাঙ্গাইল কোনোকালেই পশ্চিমবঙ্গের ছিল না। তারা অন্য নামে তাদের শাড়ির জিআই স্বীকৃতি দিতে পারে, কিন্তু সেটির সঙ্গে টাঙ্গাইল নাম থাকলে কোনোভাবেই তা যৌক্তিক হবে না।

এছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাইফুর রহমান বলেন, 'টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি নিয়ে ভারত যা করেছে, তা মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। জামদানির জিআই হাতছাড়া হওয়ার পর থেকে তারা সুযোগ খুঁজছিল।'

তিনি বলেন, ‘গত মাসে ভারতের এ কার্যক্রমের বিষয়টি জানতে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করলে বুঝতে পারি, তিনি এ-সংক্রান্ত কিছুই জানেন না। এমনকি তাঁত বোর্ডের জিআই পণ্যের আবেদনবিষয়ক কমিটির অনেকেও জানেন না এবং এ-সংক্রান্ত ফাইল দুই মাস ধরে পড়ে আছে। ফলে ভারতের কাছে আপত্তি বা আবেদন জানানোর সুযোগ থাকলেও তা করা যায়নি।’ তবে বাংলাদেশেরও টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার সুযোগ আছে বলে জানিয়েছেন ডিজাইন, পেটেন্ট ও ট্রেড মার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) মো. রাশিদুল মান্নাফ কবীর।

তিনি বলেন, ‘তখন এটি হবে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি বা আলাদা করে দেশের নাম উল্লেখ থাকবে।’ আমরা বাংলাদেশের সকল মানুষও সেটাই আশা করি। ঘরের পণ্য ঘরেই ফিরে আসবে। যে জেলার নাম পর্যন্ত ভারত কোনোভাবে বহন করে না, টাঙ্গাইল নামে যেখানে কোনো জায়গা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে নেই সেখানে "টাঙ্গাইল শাড়ি" নামক পণ্যটি ভারত নিজের নামে করে বসে আছে। এর চেয়ে প্রহসন আর কিইবা হতে পারে!


প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭