ইনসাইড আর্টিকেল

কেন ভারতের আ. লীগকেই পছন্দ?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: 05/04/2018


Thumbnail

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখালে আগামী ৮ এপ্রিল রোববার ঢাকায় আসছেন। গত ১৮ জানুয়ারি তিনি পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর এটাই তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। দুই দিনের এই সফরে বিজয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। কূটনৈতিক পাড়ায় খবর হলো, তিস্তা পানি চুক্তি ত্বরান্বিত করা এবং চলতি মাসে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠেয় কমনওয়েলথ সম্মেলনে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক চূড়ান্ত করতেই তিনি ঢাকায় আসছেন। কিন্তু নির্বাচনের মাত্র নয় মাস আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরের রাজনৈতিক তাৎপর্য কেউই উড়িয়ে দিতে পারছে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা এখন আর লুকোচুরির বিষয় নয়। বিশেষ করে ২০১৪’র ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ভারত খোলাখুলি ভাবেই আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সে সময়ও ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় ঝটিকা সফরে এসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনতে সুজাতা এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ভারত ওই নির্বাচনকে বৈধতা দেয়। মূলত: ভারতের সমর্থনের জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য ওই নির্বাচন নিয়ে আর প্রশ্ন তোলেনি। তখন ছিল সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেস সরকার। কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের আলাদা একটা মাত্রা আছে। এরপর ভারতে নির্বাচন হয় এবং কংগ্রেসকে হটিয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। সে সময় অনেকে মনে করেছিল, দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের টানাপোড়েন হবে। আওয়ামী লীগের সব কিছুতেই বিজেপি সায় দেবে না। উল্লসিত বিএনপি নেতারা বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর মিষ্টি বিতরণ করে আনন্দ উল্লাস করেছিল। লন্ডন থেকে তারেক জিয়া পাঠিয়েছিল অভিনন্দন বার্তা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মোদি শেখ হাসিনার উপরই আস্থা রাখলেন। তাঁকে পূর্ণ সমর্থন দিলেন। যদিও প্রথম বলা হচ্ছিল, ৫ জানুয়ারির মতো এক তরফা নির্বাচন মোদি সরকার সমর্থন দেবে না। গত অক্টোবরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফর করে স্পষ্ট করেই বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। এমন নির্বাচন চাই যাতে জন আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।’ কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে ততোই স্পষ্ট হচ্ছে, ভারতের  আস্থা শেখ হাসিনাতেই। কংগ্রেসের মতো বিজেপি সরকারও চায়, একটি সেক্যুলার, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণকারী দল আগামী নির্বাচনে জয়ী হোক। বিজেপি সরকারও যে বিএনপির উপর এখনো ভরসা করতে পারছে না, তা বিএনপি নেতাদের হতাশাতেই স্পষ্ট।  সুযোগ পেলেই ভারতকে ইঙ্গিত করে বিএনপি নেতারা বলেন, ‘তাবেদার সরকার’ ‘ভারতকে খুশি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে ইত্যাদি কথাবার্তা। কিন্তু ভারতের কূটনীতিতে এতে কোনো হেরফের হয়নি। বাংলাদেশে ভারতের ইচ্ছাই অন্যান্য দেশগুলোর ইচ্ছা। তাই প্রশ্ন, কেন ভারত আওয়ামী লীগকে চায়? কেন তাঁরা এখনো আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কাউকে ক্ষমতায় দেখতে অস্বস্তি বোধ করে। বাংলা ইনসাইডার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কূটনীতিক এবং ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে, এর ১০টি কারণ খুঁজে পেয়েছে। এগুলো হলো:

১. বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের জিরো টলারেন্স নীতি। বিভিন্ন আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে ভারতের বছরে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হতো। আর বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য ছিল বাংলাদেশ। এখানে বিভিন্ন গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ারও অভিযোগ ছিল। ২০০৮ সালে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে, ঘোষণা করে ‘বাংলাদেশের মাটি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। ভারতের আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ দমন হয়েছে শেখ হাসিনার দৃঢ়তায়। একারণেই এই অবস্থা অটুট রাখতে ভারত আওয়ামী লীগকে চায়।

২. ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য আছে যে, বিএনপির সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আইএসআই ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সবচেয়ে বড় মদদদাতা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার সঙ্গে উলফাসহ বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যোগাযোগ আছে বলে ভারতের কাছে তথ্য আছে। বিশেষ করে ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপক মদদ দিয়েছিল। দশ ট্রাক অস্ত্র তার বড় উদাহরণ। এজন্য বিজেপি সরকার খাল কেটে কুমির আনতে চায় না।

৩. আওয়ামী লীগ সরকার সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে বিশেষ করে হিন্দুদের ব্যাপারে অনেক বেশি দায়িত্ববান। এখনো হিন্দু নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটলেও তাতে কোনো রাষ্ট্রীয় মদদ নেই বলেই ভারত বিশ্বাস করে। একারণে বিজেপি সরকারের প্রথম পছন্দ আওয়ামী লীগ।

৪. শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ দমনে বিশ্বের রোল মডেল- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর অন্তত তিনটি বক্তৃতায় এমন মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হলে তা ভারতের জন্যও বিপদের। বিএনপির সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পর্ক রয়েছে বলে ভারত মনে করে। এজন্য মোদির আস্থা শেখ হাসিনায়।

৫. ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ১৯৭৫ এর পর থেকে খারাপ হতে থাকে। এক সময় এটা তিক্ততার পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু শেখ হাসিনা দুই দেশের  সম্পর্ককে সম্মানজনক সমঝোতার দিকে নিয়ে এসেছেন। অনেক অমীমাংসিত সমস্যা তিনি সৌহার্দের মাধ্যমে সমাধান করেছেন। এই অগ্রযাত্রায় ভারত ছেদ চায় না। ট্রানজিটসহ দ্বিপাক্ষিক অনেক ইস্যুতে ভারত লাভবান হয়েছে। এই সুবিধাগুলোকে ভারত হুমকির মুখে ফেলতে চায়না।

৬. ভারতের জন্য এই অঞ্চলে সবথেকে বড় হুমকি চীন। চীনের অর্থনৈতিক আগ্রাসন এখন ভুটান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো হলেও তা ভারতের কাছাকাছি নয়। অন্যদিকে বিএনপি চীন পাকিস্তানমুখী কূটনীতিতে আগ্রহী।বাংলাদেশে চীনের কর্তৃত্ব বাড়লে সবচেয়ে ক্ষতি হবে ভারতের।

৭. বাংলাদেশ- পাকিস্তান সম্পর্ক এখন স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ। এটা ভারতের জন্য খুবেই আনন্দের। অথচ বিএনপি এখনো পাকিস্তানমুখী।

৮. আওয়ামী লীগ পছন্দের একটি বড় কারণ হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি জাতির পিতার কন্যা। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ভারতের রাজনীতিবিদদের কাছে খুবই শ্রদ্ধার পাত্র। তাই কংগ্রেস, বিজেপি যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, শেখ হাসিনা আলাদা মর্যাদা সব সময়ই পান। আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রমাণ করেছেন, কথা ও কাজে তাঁর অসম্ভব মিল। এ কারণে শেখ হাসিনা ভারতে সম্মানের পাত্র।

৯. ভারতের অপছন্দের তালিকায় প্রথম দিকেই আছে তারেক জিয়া। ভারতে তারেক দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ হিসেবেই পরিচিত। ভারতের অভিযোগ, তারেকের সঙ্গে দাউদ ইব্রাহিমের সম্পর্ক রয়েছে। ভারত বহুবার তারেক জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। সর্বশেষে সুষমা স্বরাজও বেগম খালেদা জিয়াকে এ বিষয়ে ভাবতে বলেন। কিন্তু ভারত বুঝে গেছে তারেক জিয়াকে বিএনপি থেকে বাদ দেওয়া অসম্ভব।

১০. ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপির প্রভাবশালী নেতার সবচেয়ে পছন্দের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে তিনি কূটনীতিও ভুলে যান। তার প্রকাশ্য শেখ হাসিনার প্রতি পক্ষপাত-ভারতের রাজনীতিতে কারও অজানা নয়।

Read in English- https://bit.ly/2IwAFIR

বাংলা ইনসাইডার/জেডএ



প্রধান সম্পাদকঃ সৈয়দ বোরহান কবীর
ক্রিয়েটিভ মিডিয়া লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান

বার্তা এবং বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ২/৩ , ব্লক - ডি , লালমাটিয়া , ঢাকা -১২০৭
নিবন্ধিত ঠিকানাঃ বাড়ি# ৪৩ (লেভেল-৫) , রোড#১৬ নতুন (পুরাতন ২৭) , ধানমন্ডি , ঢাকা- ১২০৯
ফোনঃ +৮৮-০২৯১২৩৬৭৭